আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিশীথ সূর্যের দেশ - নরওয়ে

ইউরোপের রাজতান্ত্রিক দেশ নরওয়ে। মধ্যরাতেও এখানে সূর্যের দেখা মেলে। বিশ্বজুড়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশটির পরিচিতি ‘নিশীথ সূর্যের দেশ’ হিসেবে। নরওয়ের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর অসলো। নরওয়ের মোট আয়তন ৩ লাখ ৮৫ হাজার ১৭৮ বর্গকিলোমিটার।

২০১৩ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী মোট জনসংখ্যা ৫১ লাখ ৩৬ হাজার ৭০০। প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ১৫ জন। মাথাপিছু আয় ৫৫ হাজার ৩৯৮ মার্কিন ডলার। মোট জনসংখ্যার ৮২ দশমিক ৪ শতাংশ খ্রিস্টান ও ২ দশমিক ৪ শতাংশ মুসলিম ধর্মাবলম্বী। বাকিরা বৌদ্ধ, হিন্দু, ধর্মহীন ও অন্যান্য।



নরওয়েতে উত্তর গোলার্ধের গরমে কয়েক মাস সূর্য অস্ত না গিয়ে সবসময়ই আকাশ আলোকিত রাখে, বিপরীতে শীতকালে কয়েক মাস সূর্য উঠেই না। আর তখন প্রায়ই উত্তরের আলো বা ‘অরোরা বোরিয়ালিস’ দেখা যায়। ৬০ ডিগ্রি অক্ষাংশে অবস্থিত নরওয়ের রাজধানী অসলোয় জুন-জুলাই মিলিয়ে দুমাস সবসময় দিনের আলো থাকে। অর্থাত্ এ সময়ে এখানে সূর্য কখনও সম্পূর্ণ অস্তমিত হয় না। এর ফলে এ সময় রাতের অন্ধকারের পরিবর্তে গোধূলীর আলো বজায় থাকে সারারাত।

অসলো শহর দেশটির প্রায় দক্ষিণ অংশে অবস্থিত। আরও উত্তরে ৭২ ডিগ্রি অক্ষাংশে আরও বেশিদিন এ সময় সূর্যালোক থাকে। শুধু অসলো নয়, প্রায় একই অক্ষাংশে অবস্থিত সুইডেনের স্টকহোম বা ফিনল্যান্ডের হেলসিংকিতে ও রাশিয়ার বহু অঞ্চলে এর কাছাকাছি ঘটনা দেখা যায়। তবে বিশ্বজুড়ে নরওয়েই মধ্যরাতের সূর্যের দেশ হিসেবে চিহ্নিত।

প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক এখানে এই আশ্চর্য অলৌকিক মহাজাগতিক দৃশ্য দেখার জন্য আসেন।

রাতে সূর্যের আলো দেখা সত্যিই এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। পৃথিবীর অক্ষরেখা তার সমতলের ২৩.৫ ডিগ্রি ঝুঁকে যাওয়ার ফলে

প্রতিটি গোলার্ধ গ্রীষ্মকালে সূর্যের দিকে হেলে যায়, আবার শীতকালে সেখান থেকে সরে যায়। ফলে সুমেরু ও কুমেরু অঞ্চলে বছরের একটি বিশেষ সময় মধ্যরাতেও সূর্য দেখা যায়। কিন্তু যখন কুমেরু অঞ্চলে শীতকাল, তখন দিন ও রাতের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা যায় না। কারণ সূর্য সেখানে উঠেই না।

পুরো কুমেরু অঞ্চল অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। ঠিক তখন (এপ্রিল থেকে জুলাই) সুমেরু অঞ্চল পুরো ২৪ ঘণ্টাই সূর্যালোকিত দিন উপভোগ করে। যথানিয়মে সূর্য উঠে এবং অত্যন্ত ধীরগতিতে পরিভ্রমণ শুরু হয়। সন্ধ্যায় সূর্য অস্ত যেতে যেতে দিগন্ত রেখা পর্যন্ত পৌঁছায় কিন্তু তারপর স্বাভাবিক নিয়মে সম্পূর্ণ অস্ত না গিয়ে পুনরায় উঠতে শুরু করে। সুমেরু অঞ্চলে প্রায় দুমাস এ অবস্থা চলতে থাকে।

তবে প্রকৃত মধ্যরাতের সূর্য দেখা যায় ২১ জুন। ছয়মাস পর সুমেরু অঞ্চল অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায় এবং কুমেরু অঞ্চল সূর্যালোকিত হয়। কুমেরু অঞ্চলে মধ্যরাতে সূর্য দেখা যায় নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত। উত্তর অক্ষাংশের প্রান্তিক অঞ্চলকেও কখনও কখনও মধ্যরাতের সূর্যের দেশ আখ্যা দেয়া হয়। উত্তর কানাডার বাইলট টিপের কাছেও মধ্যরাতে সূর্য দেখা যায়।



বিশ্বজুড়ে নরওয়ে শান্তির দেশ হিসেবেও চিহ্নিত। প্রতি বছর আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে (১০ ডিসেম্বর) অসলোর বিশ্ববিখ্যাত সিটি হল থেকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়। শান্তির প্রতীকস্বরূপ অসলোর জাহাজবন্দরে একটি শিখা চিরপ্রজ্বলিত আছে। অসংখ্য অভিযাত্রী আর আবিষ্কারকের দেশ হিসেবেও নরওয়ে বিশ্ব-বিখ্যাত। বেশ কয়েকটি মিউজিয়ামে তার চমত্কার ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে।

অসলোর ভাইকিং মিউজিয়ামে এক হাজার ২০০ বছরেরও আগে সমুদ্র পাড়ি দেয়া ভাইকিং অভিযাত্রীদের ব্যবহূত কাঠের নৌকা রাখা আছে। ‘পোলার শিপ ফ্রাম’ মিউজিয়ামে যে জাহাজে করে ন্যানসে ১৮৯৫ সালে সুমেরুর খুব কাছে (৮৬ ডিগ্রি) পৌঁছেছিলেন তাতে উঠে ঘুরে দেখা যায়। কুমেরু বিজয়ী আমুন্ডসেলের (ডিসেম্বর ১৯১১) ব্যবহূত জিনিসপত্র তাঁবু, রুট ম্যাপ, স্লেজ ইত্যাদি সাজানো আছে। কনটিকি মিউজিয়ামে দুঃসাহসী অভিযাত্রী থর হেয়েরডালের ব্যবহূত মূল কনটিকি ভেলা, নৌকাসহ তার ব্যবহূত নানা সাজসরঞ্জাম আছে। বালসা কাঠ নির্মিত এই কানটিকি ভেলা করেই তিনি ১৯৪৭ সালে উত্তাল প্রশান্ত মহাসাগরে ৫ হাজার মাইল পথ ১০১ দিনে পাড়ি দিয়ে পেরু থেকে পলিনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছান।

এছাড়াও অন্যান্য মিউজিয়ামের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ১৫০টি ছোটবড় বাড়ি নিয়ে গড়ে ওঠা সুবিশাল ফোক মিউজিয়াম। সেখানে বিভিন্ন প্রান্তের অধিবাসীদের প্রাচীন ও বর্তমান জীবনধারা, লোকসংস্কৃতি ইত্যাদি হুবহু তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ আকর্ষণ উত্তর নরওয়ের এক্সিমোদের ঈগলু।

অসলো অপেরা হাউস: নরওয়ের রাজধানী অসলোর কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত অসলো অপেরা হাউস। ২০০৭ সালে এটি নির্মিত ভবনটি ২০০৮ সালের ১২ এপ্রিল এ অপেরা হাউসটি উদ্বোধন করা হয়।

৩৮ হাজার ৫০০ বর্গমাইলজুড়ে বিস্তৃত অপেরা হাউসটিতে রয়েছে ১১০০টি রুম এবং প্রতিটিতে সিট রয়েছে ১৩৬৪। মূল স্টেজটি ১৬ মিটার চওড়া এবং ৪০ মিটার গভীরতা বিশিষ্ট হাউসটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩০০ মিলিয়ন নরওয়েজিয় ক্রোন। ২০০৮ সালে বারসিলোনার ওয়ার্ল্ড আর্কিটেকচার ফেস্টিভ্যালে সেরা কালচারাল অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয় অপেরা হাউসটি।

অসলো সিটি হল: অসলোতে অবস্থিত অসলো সিটি হলের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৩১ সালে। হলটির ডিজাইন করেন আইনস্টেইন আর্বাগ ও ম্যাগনাস পাউলসন।

প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর অসলো সিটি হলে আনুষ্ঠানিকভাবে নোবেল পদক প্রদান করা হয়।

ভাইকিং সম্প্রদায়: নরডিক সম্প্রদায়ভুক্ত ভাইকিংরা স্ক্যান্ডিনেভীয় উপদ্বীপের বাল্টিক ও আটলান্টিকের তীরে বাস করত। নরওয়ের রাজা হ্যারল্ড ফেরার হেয়ার নবম শতাব্দীতে লুটেরা ভাইকিংদের দেশ থেকে বিতাড়িত করলে তারা স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের আশেপাশে ছোট ছোট দ্বীপে বসবাস শুরু করে। ৭৫০-৯৯৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইউরোপে ভাইকিংরা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। এদের দলনেতা ছিলেন এরিক দ্য রেড।

দক্ষিণ মেরু বিজয়ী বিখ্যাত অভিযাত্রী অ্যামুন্ডসেন ছিলেন ভাইকিংদের শেষ বংশধর।

অর্থের পাহাড় নিয়ে বিব্রত: ইউরোপীয় অঞ্চলের সমৃদ্ধির উপদ্বীপ হিসেবেই খ্যাত নরওয়ে! কিন্তু দেশটির এত বেশি পরিমাণ অর্থ রয়েছে যে কীভাবে এর ব্যবহার করবে কর্তৃপক্ষ তাও বুঝতে পারছে না! প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ ও সম্পদ থাকায় স্ক্যান্ডেনেভিয়ান অঞ্চলের এই রাষ্ট্রের নাগরিকরাও বিব্রতও! এ জন্য দেশটি অর্থনৈতিক ক্ষতি ছাড়াই কিভাবে এতো বেশি পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ খরচ করা যায় তার চিন্তায় বিভোর প্রশাসন! গত সেপ্টেম্বরে নরওয়ের বৃহত্তম ব্যাংক ডিএনবির প্রধান অর্থনীতিবিদ ওয়েস্টেন ডোরাম বলেন, আমাদের প্রতিবেশী সব দেশ তাদের খরচ কমাচ্ছে। অর্থ বেশি বলে আমরা অপচয় করতে পারি না। আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো, মানহীন প্রকল্পে ছেড়ে দিয়ে পর্যাপ্ত লাভ ছাড়া যাতে তেল সম্পদের বিশাল ভাণ্ডার অপচয় না করে ফেলি। ১৯৯০ সালের পর থেকেই নিশীথ সূর্যের দেশটিতে অর্থনৈতিক গতিশীলতা লক্ষ্য করা যায়।

তারপর দেশটির রাজস্বে অলস অর্থ জমা হতে থাকায় সরকারের পক্ষ থেকে স্টক, বন্ড ও রিয়েল স্টেটে বিনিয়োগ করা হয়! এমনকি অর্থের অপচয় ঠেকাতে বিদেশেও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিনিয়োগ করা হয়!

উচ্চশিক্ষা: উচ্চশিক্ষায় আগ্রহীদের জন্য আদর্শ দেশ নরওয়ে। এখান থেকে ব্যাচেলর, মাস্টার্স ও ডক্টরেট বা পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা যায়। প্রচলিত প্রায় সব বিষয়েই উচ্চশিক্ষার সুযোগ রয়েছে দেশটিতে। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নরওয়েজিয়ান ভাষায় পড়ানো হয়। তাই ইংরেজির পাশাপাশি নরওয়েজিয়ান ভাষায় দক্ষতা থাকাও গুরুত্বপূর্ণ।

বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তির ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষা যোগ্যতা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে আইইএলটিএস স্কোর ৫.০ থেকে ৬.০ চাওয়া হয়। ভর্তিসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পাওয়া যাবে অনলাইনে। কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে আবেদনপত্র ডাউনলোড করে আবেদন করতে পারবেন। নরওয়ের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যাচেলর ও মাস্টার্স পর্যায়ের কোর্স শুরু হয় আগস্ট থেকে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের আবেদনের সুযোগ থাকে ১৫ জানুয়রি থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অফার লেটার পাওয়ার পর ভিসার আবেদন করতে হয়। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদনপত্র সঠিকভাবে পূরণ করতে হবে। আবেদনপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে শিক্ষাগত যোগ্যতার সব সনদ ও নম্বরপত্র, আইইএলটিএস বা টোফেল টেস্টের ফল, পাসপোর্টের ফটোকপি, মেডিক্যাল রিপোর্ট, স্পন্সরের কাছ থেকে প্রাপ্ত আর্থিক দায়-দায়িত্বের চিঠি ও সত্যায়িত পাসপোর্ট সাইজের ছবি। প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র অবশ্যই ইংরেজিতে হতে হবে। সুইডেন ও জার্মানির মতো ইউরোপের এই দেশটিতেও টিউশন ফি নেই।



আন্ডার গ্র্যাজুয়েট, মাস্টার্স ও পিএইচডি প্রোগ্রামের জন্য শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি দিতে হয় না।

তবে একাডেমিক ফি বাবদ প্রতি সেমিস্টারে বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে ৩০০ থেকে ৬০০ নরওয়েজিয়ান ক্রোনার দিতে হয়। এ ছাড়া একজন শিক্ষার্থীর থাকা-খাওয়া, যাতায়াত খরচ তো রয়েছেই। উল্লেখ্য, প্রতি নরওয়েজিয়ান ক্রোনারের মূল্যমান ১১.৮০ টাকা । ছুটির সময় নরওয়েতে শিক্ষার্থীরা ফুলটাইম কাজের সুযোগ রয়েছে।

তবে সে ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। এখানে প্রতি ঘণ্টায় আয় করা যায় সাত থেকে ২২ মার্কিন ডলার। নরওয়েতে ক্যাফে, বার, রেস্টুরেন্ট, কম্পিউটিং, এনজিও, সেলস, কল সেন্টার, ট্রাভেল, লাইব্রেরি, টিচিং প্রভৃতি ক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। নরওয়েতে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য বেশকিছু প্রতিষ্ঠানে স্কলারশিপের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এই স্কলারশিপ অনেকটাই নির্ভর করে শিক্ষার্থীর ফলের ওপর।

নরওয়ের উল্লেখযোগ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রয়েছে ইউনিভার্সিটি অব অসলো, ইউনিভার্সিটি অব বার্গেন, ইউনিভার্সিটি অব ট্রমস, নরওয়েজিয়ান ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, নরওয়েজিয়ান ইউনিভার্সিটি অব লাইফ সায়েন্সেস, ইউনিভার্সিটি অব স্টাভানগার, ইউনিভার্সিটি অব আগদির প্রভৃতি।

আরো পড়ুনঃ
কৃত্রিম জীবন তৈরি শিগগিরই
টিভির সামনে ৬ মাস ধরে মৃত এক মহিলা!
কম দামে ৮ কোর প্রসেসর এর অসাধারন মোবাইল ফোন: JIAYU S2

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।