আমার এই ব্লগের কোনো লেখা বা লেখার কোনো অংশ আমার লিখিত অনুমতি ছাড়া যে কোনো প্রকার মিডিয়াতেই প্রকাশ করা যাবেনা। যদি তা করা হয়, তাহলে আমি আইনগত এবং অবস্থাভেদে ব্লগের আইন/প্রসিজিওর অনুযায়ী ব্যাবস্থা নিতে বাধ্য হব
জামাতের ভাড়া করা তথাকথিত আইনজীবি স্টিভেন কে কিউসি বর্তমানে পুরো পৃথিবী জুড়েই বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল নিয়ে নগ্ন মিথ্যাচার করে যাচ্ছেন। এই নগ্ন মিথ্যাচারের স্বরূপ উন্মোচন করবার লক্ষ্যেই আমার এই সিরিজ। যারা আমার এই লেখার ১ম পর্ব মিস করেছেন তারা পর্বটি এখান থেকে দেখে নিতে পারেন। আজ দিলাম পর্বঃ২।
বিভিন্ন মিডিয়াতে তথা পত্রিকা, টিভি, ম্যাগাজিন, অনলাইন, সভায়, সেমিনারে স্টিভেন বলে বেড়াচ্ছেন যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যেই ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আইনে হচ্ছে তাতে নাকি লেখা রয়েছে যে-
ট্রাইব্যুনালের কাছে সাধারণ জ্ঞান বা কমন নলেজ দিয়েও বিচারের কথা বলা হয়েছে । এতে ন্যায় বিচার ব্যাহত হবে। হাইকোর্টে রিভিউয়ের বিধান না রেখে সরাসরি আপিলেট ডিভিশনে আপিল করার বিধানও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ আপিল বিভাগে আর্গুমেন্ট কয়েকটি বিষয়ের মধ্যে সীমিত থাকে ।
এই মিথ্যা কথার আইনী উত্তরঃ
“সাধারণ জ্ঞান বা কমন নলেজ ( এখানে ঐতিহাসিক ঘটনা বা তার প্রেক্ষাপট বোঝানো হচ্ছে) দিয়ে বিচারের কথা বলা হয়েছে” কথাটি ঠিক এই ভাবে বললেন স্টিভেন , ঠিক যেভাবে জামাতীরা প্রোপাগান্ডা ছড়ায় “ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে দেশ ভারতের কাছে বিক্রি হয়ে যাবে” কিংবা এই ১৯৭৩ সালের আইন নিয়ে জামাতীরা ইদানীং গল্প ছড়াচ্ছে এমন যে, “এই আইনে নাকি গল্পের বই-ও এভিডেন্স হিসেবে ব্যাবহার করা যাবে” ।
এসব কিছুই হচ্ছে প্রপাগান্ডা । মিথ্যায় ভরা প্রচার ।
১৯৭৩ সালের আইনে কি বলা হয়েছে , আসুন দেখি-
এই আইনের ১৯(৩) ধারায় বলা হয়েছে যে,
“A tribunal shall not require proof of facts of common knowledge but shall take judicial notice thereof”
আবার, ১৯(৪) ধারায় বলা হচ্ছে যে ,
“A tribunal shall take judicial notice of offiicial governmental documents and reports of the UN and its subsidiary agencies or other international bodies including non-governmental organisations”
এই ধারা গুলোর মানে কি ? ধারা গুলোর মানে কি এই দাঁড়ায় যে কমন নলেজ ও সাধারণ জ্ঞান দিয়েই বিচার হয়ে যাবে ? একেবারেই তা না । বাংলাদেশের আইনে ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষিতে আইনগত প্রভিশন রয়েছে কমন “ল” তে এবং স্ট্যাটিউটরী আইনেও ।
স্ট্যাটিউটরী লিগাল প্রভিশনে এভিডেন্স এক্ট ১৮৭২ এর সেকশন ৯০ এ বলা আছে এই রেয়াফারেন্সের কথা যদিও ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইন ১৯৭৩ সালের আইনটিতে গ্রহণযোগ্য নয় ।
কিন্তু এই ক্ষেত্রে আমাদের জুডিশিয়াল জুরিসপ্রুডেন্স কিংবা মামলার রেফারেন্স যে কোনো কমন নলেজ তথা ঐতিহাসিক ফ্যাক্ট গুলোর প্রমাণে সাহায্য করতে পারে । এবং এই সাহায্য ট্রাইবুনাল নিবে না, এমন কথা কিন্তু ১৯৭৩ সালের আইনে কোথাও বলা নেই । খুব স্পষ্ট করে বরংচ, জুডিশিয়াল নোটিস এর কথা বলা আছে ।
আবার উদাহরন স্বরূপ বলা যেতে পারে যে , এই ধরনের প্রভিশন না থাকলে , ১৯৭১ সালে যে আমাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ হয়েছে , এই কথাটি প্রমাণ করবার জন্যই তো বছরের পর বছর লেগে যাবে । সাধারণ ব্যাপারগুলো বা যা সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে বিবেচ্য সেগুলো কে একটি স্পেশাল ট্রাইবুনালে এনে দড়ি পাকানো হলে , এই মামলা তো সাধারণ ফৌজদারী আদালতেই করা যেতে পারত ।
তবে আর স্পেশাল ট্রাইবুনাল কেন ? আর যুদ্ধাপরাধ বিচারের ক্ষেত্রে স্পেশাল ট্রাইবুনালের উদাহরণ তো ভুরি ভুরি। যেমন-
যুগাস্লোভিয়া ট্রায়ালে, কম্বোডিয়া ট্রায়ালে, রুয়ান্ডা ট্রায়ালে, নুরেবার্গ ট্রায়ালে, ম্যানিলা ট্রায়ালে, মুনাইয়েঞ্জা (কানাডা) ট্রায়ালে।
আমরা এই ক্ষেত্রে NURUL ISLAM AND OTHERS VS THE STATE এর মামলা টি দেখি যেখানে কোর্ট বলছে , পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট কোর্টে গ্রহণ করা যেতে পারে কোনো রকম প্রমাণ ছাড়াই । যদিও 55 DLR 299 এর মাধ্যমে আমরা বলতে পারি যে , এই ক্ষেত্রে যিনি সাক্ষ্য প্রোভাইড করছেন , তার রিপোর্টের প্রমাণ লাগবে ।
কিন্তু Shaid mia –Vs- Litonমামলায় আবার দেখা যাচ্ছে যে , কোর্ট বলছে , যদি কোনো রিপোর্ট বা ডকুমেন্ট ৩০ বছরের পুরোনো হয় তবে কোর্ট সেই ডকুমেন্টকে অথেন্টিক বলে গ্রহণ করবে ।
[5 Bangladesh Law chronicles(AD) 74]
সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যেটি হচ্ছে , সেটি হলো, ঠিক এই ধরনের ক্ষেত্রে কোনো আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী বিচারের ট্রায়ালেই কিন্তু কোনো ভাবেই ঐতিহসিক ঘটনার(যা কমন নলেজ বলে অভিহিত হচ্ছে)প্রমাণ চাওয়া হয় নি কিংবা এই জাতীয় কোনো প্রভিশন উক্ত আইন গুলোতে নেই ।
উদাহরণ স্বরুপ উল্লেখ করা যেতে পারে-
১)Art 15 of the ICTY 1993(ইয়াগস্লোভিয়া ট্রায়াল)
2)Art 14 of the ICTR 1994(রুয়ান্ডা ট্রায়াল)
3)Art 14(1) of the Statute of the special court for Sierra Leone, 2002
যেখানে International Crimes (Tribunals) Act-1973 একটি বিশেষ ট্রাইবুনাল । একটি বিশেষ বিচার ব্যাবস্থা , সেখানে কি করে তিনি ফৌজদারি আইনের প্রক্রিয়া টেনে আনছেন “বাধ্যতামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে” তা আমার বোধগম্য নয় । আর তিনি তার এই দাবী সংবিধানের কোন ক্ষমতাবলে তুলছেন, সেটিও আমার বোধগম্য নয় ।
৩২ ডি এল আর ১ ( এ ডি) অনুযায়ী- বিশেষ সংবিধি কর্তৃক গঠিত একটি বিশেষ ট্রাইবুনাল একটি ফৌজদারী আদালত হইলেও ফৌজদারী কার্যবিধি সংহিতার অর্থে উহা কোনো ফৌজদারী আদালত নহে ।
আবার ,
Bangladesh vs Shahjahan Siraj (32 DLR AD)- তে বলা হচ্ছে-
A special Tribunal although a criminal court, constituted by the special Statute, is not a criminal court within the meaning of the Code of Criminal Procedure .
আমি ঠিক জানিনা , স্টিভেন কি এই উদাহরণ বা জাজমেন্টগুলো সম্পর্কে অবহিত নন ? এর চেয়েও সবচাইতে বড় সাংবিধানিক “প্যাঁচ” যেখানে রয়ে গেছে , স্টিভেন তা খুব সুন্দর ভাবেই এড়িয়ে গেছেন বলে আমার বিশ্বাস ।
ধরা যাক , ১৯৭৩ সালের আইনটিতে এমনটি বলা আছে যে , এই আইনের যে কোনো রায়ের বিরুদ্ধে প্রথমে হাইকোর্টে আপীল করতে পারবে । কি হতো তাহলে ?
সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদের ২ দফায় বলা আছে যে-
“ হাইকোর্ট বিভাগের রায় , ডিক্রী , আদেশ বা দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপীল বিভাগের নিকট সেই ক্ষেত্রে অধকারবলে আপীল করা যাইবে , যে ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগ ,
ক) এই মর্মে সার্টিফিকেট দান করিবেন যে , মামলাটির সহিত এই সংবিধানের ব্যাখ্যার বিষয়ে আইনের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জড়িত রহিয়াছে-
এখন যদি ব্যাপারটি এমন দাঁড়ায় যে , হাইকোর্ট তার ডিস্ক্রেশনারী ক্ষমতা বলে , সার্টিফিকেট প্রদান করলেন না ( ধরা যাক, যেই ক্ষেত্রে কোনো ব্যাক্তির যাবজ্জীবন বা মৃত্যুদন্ড হয় নি এমন ব্যাক্তির), সেক্ষেত্রে কি হবে ? ১৯৭৩ এর আইনে বলা আছে আপিল বিভাগে আপীল করতে পারবেন আর হাইকোর্ট এইদিকে সার্টিফিকেট দিলো না , কি হবে তাতে ? আর কিছুই না , একটি সাংবিধানিক অনিশ্চয়তা তৈরী হবে । বিচার ব্যাহত হবে । অথচ এই আইনে বার বার বলা হয়েছে যে , “সুষ্ঠু বিচারের স্বার্থে” এই আইনটি প্রণীত হয়েছে ।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ সংবিধান থেকে আমি উদ্ধৃত করতে চাই তা হলো , বাংলাদেশের সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদের ৪ ধারা । যেখানে বলা হয়েছে যে,
“ সংসদ আইনের দ্বারা ঘোষনা করিতে পারিবেন যে , এই অনুচ্ছেদের বিধানসমূহ হাইকোর্ট বিভাগের প্রসঙ্গে যেরূপ প্রযোজ্য , অন্য কোনো আদালত বা ট্রাইবুনালের ক্ষেত্রেও তাহা সেই রূপ প্রযোজ্য হইবে”
সবশেষে আমাদের সংবিধানের ৪৭(৩) এর ধারাতে খুব স্পষ্ট করে উল্লেখ আছে –
“দন্ডদান করিবার বিধান-সংবলিত কোন আইন বা আইনের বিধান এই সংবিধানের কোন বিধানের সহিত অসমঞ্জস্য বা তাহার পরিপন্থী, এই কারনে বাতিল বা বেআইনী বলিয়া হবে গণ্য হইবে না কিংবা কখনও বাতিল বা বেআইনী হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে না। ”
তাহলে সংবিধান যেখানে স্পষ্টাক্ষরে উক্ত কথা বলে দিয়েছে সেখানে কি করে , ট্রাইবুনালে নিয়োগকৃত বিচারপতিদের নিয়ে কথা উঠতে পারে বা রিট হতে পারে ?
আবারো প্রমাণিত হলো স্টিভেনের মিথ্যাচার। এইভাবে পুরো পৃথিবীতে আমাদের যুদ্ধাপরাধ আইন নিয়ে মানুষকে বোকা বানাচ্ছে স্টিভেন কে কিউসি এবং বাংলাদেশের আইন ও আদালতকে পৃথিবীর মানুষের সামনে হেয় প্রতিপন্ন করে যাচ্ছে।
চলবে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।