আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জননেতা রাজ্জাকের জন্যে শীতরাত্রির প্রার্থনা

ফিদা হাসান রিসলু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি রাজনৈতিক দলের সৌন্দর্যকে লালন করেন, ধারণ করেন তার সাথে সম্পর্কিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। গড়ে তোলেন নিজস্ব ভাবমূর্তি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে তেমন এক ব্যক্তিত্ব তোফায়েল আহমেদ। সম্প্রতি মন্ত্রীশূণ্য জাতীয় সংসদের অধিবেশনে এসে অনুভব করেন, ‘কোথাও কেউ নেই’। লন্ডনের কিংস কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দেশীয় রাজনীতির অন্যতম দিকপাল, দীর্ঘ জীবনের সহকর্মী- বড়ভাই আব্দুর রাজ্জাককে দেখতে গিয়ে সেখানকার হাইকমিশনার অধ্যাপক সাইদুর রহমানসহ কর্তাব্যক্তিদের অজানা উদাসিন্যতা তাকে ব্যাথিত করে।

রাজনীতির পোড়ামুখ জুড়ে সেই বেদনকে ধারণ করে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাড়িয়ে প্রকাশ করেন তার ক্ষোভোক্তি। তিনি দুঃখ করে বলেন, জননেতা রাজ্জাক মৃত্যুর সংগে লড়ছেন। পাঁচ সপ্তাহ পর তার যকৃৎ ও বৃক্ক প্রতিস্থাপিত হবে। অথচ হাইকমিশনার তাকে দেখতে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে বলেন, মন্ত্রী সাহেবদের জন্য তার বিমানবন্দরে যেতে হয়।

তোফায়েল আহমেদ তাকে জানান, ‘রাজ্জাক ভাই কেবল একজন সাংসদ নন, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক’। একথা বলার পর হাইকমিশনার তাকে দেখতে যান। কথায় বলে, ‘রতনে রতন চেনে, শুকুরে চেনে কচু-ঘেচু’। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক তোফায়েল আহমেদের চেনা অগ্রজনেতা আব্দুর রাজ্জাকের ভার-ধার তাদের মেধা-মননে প্রতিফলিত হওয়ার কথা নয়। গত শতকের ষাটের দশকে আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ।

এসময় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখছেন, ‘প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য/ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা’। ধ্বংসের উপর পা দিয়ে পৃথিবীর সব ফুলের গন্ধ বুকে নিয়ে তিনিই আবার লিখছেন, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক/আজ বসন্ত’। ঘৃণা-ভালোবাসার স্পষ্ট অবস্থানের প্রেক্ষিতে ভয়ংকর সুন্দর (ট্রিমেনডাস বিউটি) এক সময় তখন। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে চোখ-কান খুলে যাওয়া বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিজয় রথে দৃপ্তমান তারুণ্য সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নে বিভোর। নিজেকে চিনতে পারার পরে যেমন হয়, আলোর পেখম মেলে দিয়ে আকাশ দেখতে শেখা! অতীতের নষ্ট-ভ্রষ্ট সবকিছুকে বর্জন-বিসর্জন করে বাঙালি প্রথমবারের মত স্বয়ংসম্পন্ন মানুষ হয়ে উঠে।

ষাটের দশক ছিল পরিপূর্ণ মানুষের দশক। এই দশকের আলোময় তারুণ্য-যৌবনের নেতা ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। পাকিস্তানের প্রথম সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের ‘প্রভু নয়, বন্ধু’র মুখোশে পূর্ব-পশ্চিম মিলিয়ে চল্লিশ-চল্লিশ আশি হাজার মৌলিক গণতন্ত্রীর বিপরীতে লক্ষ-কোটি মানুষের ইহজাগতিক উত্থান। ৫৬ ভাগ বাঙালিকে বঞ্চিত করে সামন্ত-আমলা অধ্যুষিত পশ্চিমি সামাজিকায়নে অর্থনৈতিক স্ফিতির উল্টা পিঠে অবহেলিত-উপেক্ষিত বাঙালির ক্ষোভ থেকে ক্ষরণ আর ক্ষরণ থেকে মরণপণ লড়াইয়ের স্পন্দন-কম্পন। ‘পূর্ব বাংলা শ্মশান কেন’-প্রশ্ন নিয়ে উত্তর খুঁজে ফেরা বাঙালির হৃদয় মন্দিরে শেখ মুজিবুর রহমানের একচ্ছত্র আধিপত্য।

সাধারণের নাগালের বাইরে জনবিচ্ছিন্ন সামরিক-বেসামরিক আমলা তৈরীর হীন উদ্দেশ্যজাত কুখ্যাত হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনের জোয়ারে উথাল-পাতাল ছাত্রসমাজ। নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ-মূল্যাবোধের সুরে-সুরে বাঁশি ভরিয়ে আগুনের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন মোহাম্মদ ফরহাদ, কাজী জাফর আহমেদ, শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী, হায়দার আকবর খান রনো, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, তোফায়েল আহমেদ। সাহিত্য-সংস্কৃতি-চিত্রকলা-সংগীত-চলচ্চিত্র হয়ে উঠছে ‘জীবন থেকে নেয়া’। প্রথা ভেংগে ভেংগে আগুনের পরশমনির ছোঁয়ায় উদ্ভাসিত হচ্ছেন আহমদ ছফা, হুমায়ুন আজাদ, সেলিম আলদিন, আলতাফ মাহমুদ, শাহাবুদ্দিন, জহির রায়হান, নির্মলেন্দু গুণ, শাহাদত চৌধুরী। রাজনৈতিক সংস্কৃতির এমন অমল-ধবল রাতুল চরণে মঞ্জুরিত আমাদের আল্পনিক আংগিনা।

উঠোন জুড়ে জাতীয়তাবাদী জাগরণের উথাল-পাতাল জোয়ারের সাথে বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রগাঢ় প্রভাব মিলে মিশে তারুণ্য যেন খাপ খোলা তলোয়ার। কাল মাকর্সের থিউরিকে বাস্তব ভিত্তির সাথে মিলিয়ে নিয়ে লেনিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর মাও-সেতুংয়ের গণচীনের অভ্যুদ্বয় পৃথিবীর দেশে দেশে নতুন এক রাজনৈতিক নির্দেশনার বার্তা নিয়ে আসে। পূজিবাদের মোড়ল আমেরিকার খুব কাছে ফিদেল কাষ্ট্রোর নেতৃত্বে বাস্তিল দূর্গের পতন ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক কিউবার অভ্যুদ্বয় আর কিউবা বিপ্লব সম্পন্ন করে বিশ্ববিপ্লবের দূর্নিবার আকাঙ্খায় ল্যাটিন আমেরিকাময় চে গুয়েভারার উজ্জ্বল আবির্ভাব যৌবন জল তরঙ্গে মাতম তোলে। প্রথমে একত্রিত, পরে সোভিয়েত-চীন ঘরানার দুই ছাত্র ইউনিয়নের পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের মাঝেও তার উৎসরণ জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে যোগ করে নতুন মাত্রা। ছাত্রনেতা আব্দুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খান, কাজী আরেফ আহমেদ প্রমুখদের সাথে করে গঠন করেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী নিউকিয়ার্স।

এর লক্ষ্য ছিল, মেধা-মননে সমৃদ্ধ ছাত্রলীগ কর্মীদের নিয়ে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। লক্ষ্যের প্রতি অবিচল আব্দুর রাজ্জাক পরবর্তীতে দুই-দুবার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব মাঝে সেই চিন্তার প্রসার ঘটান। ছাত্র সমাজের চেতনাকে শক্ত ভিত্তির উপর দাড় করান। বিশাল-বর্ণাঢ্য, কর্মী-সংগঠন বেষ্টিত ছাত্রলীগকে নিয়ে আসেন সামনের প্রথমায়। ষাট দশকের প্রায় পূরোটা সময় ছাত্র ইউনিয়নের ঝলমলে প্রতিপত্তিকে টপকিয়ে উনষত্তুরে এসে ডাকসু-রাকসু সর্বত্র জুড়ে ছাত্রলীগের বিজয় রথ।

নতুন দেশ, নতুন সমাজ নির্মাণের আকাশ সমান আকাংখা নিয়ে ছাত্র সমাজের সর্ববৃহৎ এই সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব। মূলতঃ জাতীয়তাবাদী ধারার ডান-বাম মিশ্রিত ছাত্রলীগ থেকে বামবান্ধব প্রগতিশীল ছাত্রলীগ নির্মাণে যাদের ভূমিকা ছিল অগ্রসর, তাদের মধ্যে আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন অগ্রগণ্য। তিনি এবং তারা মিলেই শেখ মুজিবকে বানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু আর স্বাধীকারের গলায় পড়িয়েছেন স্বাধীনতার মালা। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে যুবনেতা আব্দুর রাজ্জাক অপর তিন বিখ্যাত সংগঠক শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদের সাথে করে গঠন করেন বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ)। মুজিব বাহিনী নামে এর পরিচিতি রয়েছে।

এরা মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক নেতৃত্বের কেউ নন। ঘোর তমসার ভিতরে ঝাঁক ঝাঁক আলো হয়ে মুক্তিযুদ্ধের মূলধারা ছুঁয়ে থাকা এই দৃশ্যমান অদৃশ্যরাজি স্বাধীনতা যুদ্ধকে পৌঁছে দিয়েছেন সঠিক পরিনতির দিকে। ইতিহাসের সত্য বলছে, স্বাধীনতা পূর্ব রাজনৈতিক অংগীকারে আব্দুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খানের নিকটবর্তি হলেও স্বাধীনতা উত্তর রাজনৈতিক আবহে তারা ছিলেন বিপরীত মেরুতে। সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রেণী সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে সিরাজুল আলম খানের নৈপথ্য নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হলো জাতীয় সামাজতান্ত্রিক দল-জাসদের। অন্যদিকে আব্দুর রাজ্জাকের উপলদ্ধিতে, আধা সামন্ত-আধা পূজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় প্রথম করণীয় হচ্ছে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করা এবং সেপথ বেয়েই সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হওয়া।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সেপথেই এগুতে চেয়েছেন তিনি। স্বাধীন দেশের সরকারে নয়, দলের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের যে নতুন প্রজন্ম স্বাধীন দেশের হাল ধরতে চাইলেন, তার সার্বিক প্রনোদনায় ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। নেতৃত্বের সহজাত বিভায় তিনি আন্দোলিত করেছেন তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের। তাইতো বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী জাতীয় চারনেতা বিহীন আওয়ামী লীগে তিনিই ছিলেন নিয়ামক।

সামরিক অক্টোপাসে বন্দি দেশে বার বার ভয়-ভীতি, লোভ-লালসার মুখে পড়েছেন। সবকিছু তুচ্ছ জ্ঞান করে শক্ত হাতে দলের হাল ধরেছেন। সম্ভাব্য ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দলকে প্রবল প্রতিকুলতার মধ্যে আগলে রেখেছেন। সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে উপহার দিয়েছেন আস্ত আওয়ামী লীগ। ঘর ছেড়ে অন্য ঘর করেছেন।

সেখানেও ‘ঐ মহামানব আসে’। নীতি-আদর্শ ত্যাগ করেননি, স্বপ্নের সলিল সমাধি ঘটাননি। নিজেদের মত করে কিছু করতে না পারার দায় নিয়েই নিকটজনদের কাছে ফিরে এসেছেন। মন্ত্রী হয়েছেন, দলের শীর্ষ নেতাদের একজন থেকেছেন। প্রথমতঃ তিনি আওয়ামী লীগার, শেষ পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগার।

মাঝখানের সবটুকু জুড়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মুক্তির সংগঠক। মানুষের সাথে থেকে, মানুষকে সাথে নিয়ে, মানুষের শোককে শক্তিতে পরিণত করে সংগঠন নির্মাণ করেছেন। মানুষের ভরসা হতে চেয়েছেন। লেবাননের বিখ্যাত কবি, দার্শনিক কাহলিল জিবরানের মত করে বার বার বলেছেন, সামর্থের চেয়ে বেশি দেওয়া আর প্রয়োজনের চেয়ে কম নেওয়ার মধ্যেই মানুষের উদারতা নিহিত। আকাশের মত উদার, বাতাসের মত স্বচ্ছ, সাগরের মত গভীর আর পাহাড়ের মত স্থির এই রাজনৈতিক মানুষ বেদনাদায়কভাবে আজ বড়ো বেশী উপেক্ষিত, অবজ্ঞেয়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরি ভবনে আব্দুর রাজ্জাকের সান্নিধ্য পেতে একদিন যে অধ্যাপক সাইদুর রহমান ছাত্রলীগ নেতাদের তোষামোদি করতেন, আজ তিনি কিংবা তার মতো আরো আরো নবরতেœর একধরণের ভীতি তাড়িত উদাসিন্যতা জাতি হিসাবে আমাদের হীনস্মন্যতাকেই তুলে ধরছে মাত্র। আমরা ভুলে যাচ্ছি, সম্মানিত ব্যক্তিকে সম্মান দিলে নিজেকেই সম্মানিত করা হয়। আমরা যারা তার কর্মী ছিলাম, তার শিক্ষায় দিক্ষা নিয়ে দেশের জন্য, দশের জন্য ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত ছিলাম, অনেক অনেক দূরে থেকে সেরকম শত-সহস্র মানুষের পক্ষ থেকে জননেতা আব্দুর রাজ্জাককে উৎসর্গ করতে চাই, আধুনিক বাংলা কবিতার বিস্ময়কর প্রতিভা কবি বুদ্ধদেব বসুর ‘শীতরাত্রির প্রার্থনা’। উচ্চারণ করতে চাই তার কিছু অংশ-‘ডুবতে হবে মৃত্যুর তিমিরে, নয়তো কেমন ক’রে বেঁচে উঠবে আবার?/লুপ্ত হ’তে হবে পাতালে, নয়তো কেমন ক’রে ফিরে আসবে আলোয়?/ তুমি কি জানো না, বার-বার মরতে হয় মানুষকে, বার-বার, /দুলতে হয় মৃত্যু ও নবজন্মের বিরামহীন দোলায়/ সত্যি যদি বাঁচতে হয় তাকে’। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.