জনশক্তি রপ্তনি তথা রেমিটেন্স প্রবাহ আমাদের দেশের অর্থনীতিকে দিনের পর দিন দিয়ে যাচ্ছে নতুন প্রাণের সঞ্চার। জিডিপির এক দশমাংশ আসে এই খাত থেকে, স্বাধীনতা পরবর্তী প্রতিটি সরকারের পররাষ্ট্রনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করছে এটি। যদিও এই ক্ষেত্রে সবার অর্জন সমান হয়নি। সরকার ভেদেও অনেক সময় হেরফের হয়েছে এটির। যার ধারাবাহিকতা বর্তমানেও যথারীতি অপরিবর্তিত বললে কাউকে দুঃখিত বলতে হবে না।
আমরা যদি বিগত এক দশকের চিত্র ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হই, তাহলে বুঝতে আর কাউকে বিশেষ জ্ঞানীর সম্মুখীন হতে হবে না। প্রথমে দেখা যাক প্রবাসী বাংলাদেশী কর্মজীবীর সংখ্যা এবং প্রেরিত রেমিটেন্সর হিসাবের দিকে।
অর্থ বছর কর্মজীবীর সংখ্যা প্রেরিত অর্থের পরিমাণ
মিলিয়ন মার্কিন ডলার শতকরা পরিবর্তন (%)
২০০১-০২ ১,৯৫,০০০ ২৫০১.১৩ ৩২.৮৯
২০০২-০৩ ২,৫১,০০০ ৩০৬১.৯৭ ২২.৪২
২০০৩-০৪ ২,৭৭,০০০ ৩৩৭১.৯৭ ১০.১২
২০০৪-০৫ ২,৫০,০০০ ৩৮৪৮.২৯ ১৪.১৩
২০০৫-০৬ ২,৯১,০০০ ৪৮০১.৮৮ ২৪.৭৮
২০০৬-০৭ ৫,৬৪,০০০ ৫৯৭৮.৪৭ ২৪.৫০
২০০৭-০৮ ৯,৮১,০০০ ৭৯১৪.৭৮ ৩২.৩৯
২০০৮-০৯ ৬,৫০,০০০ ৯৬৮১.১৬ ২২.৪২
২০০৯-১০ ৪,২৭,০০০ ১০৯৮৭.৪০ ১৩.৪০
২০১০-১১
(জুলাই-এপ্রিল) ৩,৪২,০০০ ৯৫৮৭.১৫ ৪.৩০
চিত্রঃ প্রবাসী বাংলাদেশী কর্মজীবীর সংখ্যা এবং প্রেরিত অর্থের পরিমাণ।
উক্ত চিত্র থেকে আমরা দেখতে পাই, ২০০১-১১ পর্যন্ত কর্মজীবী প্রেরণ ও রেমিটেন্সের ক্ষেত্রে কিছুটা বৈচিত্র্যতা ধারণ করছে। ২০০৩-০৪ সনে রপ্তানি বাড়লেও কমছে রেমিটেন্স, পক্ষন্তরে ২০০৪-০৫ সনে জনশক্তি রপ্তানি কমলেও বেড়েছে রেমিটেন্স, অন্যান্য ক্ষেত্রে তেমন হেরফের হয় নি, কিন্তুু জনশক্তি রপ্তানি সর্বোপরি উন্নতির দিকে ছিল।
কিন্তুু আমরা দেখতে পাই হঠাৎ করে ২০০৮-০৯ থেকে জনশক্তিতে ধস নেমে যায়। কিন্তুু রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই ক্ষেত্রে লক্ষণীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে আবার উভয়ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হারে উন্নতি পরিলক্ষিত। সেই ক্ষেত্রে জনশক্তি রপ্তানি কমে গেছে কিন্তুু রেমিটেন্স বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ হল, ১. রেমিটেন্স প্রবাহ পূর্বের মোট জনশক্তি বৃদ্ধির কারণে বাড়ছে কিন্তুু শতকরা পরিবর্তন এই ক্ষেত্র কমেছে। ২. শ্রমবাজারে অনিশ্চয়তার কারণে মানুষ বেশী বেশী ফেরত আসা।
শ্রেণীভিত্তিক প্রবাসী বাংলাদেশীর সংখ্যা হিসেব করলেও আসে বৈচিত্র নান রকমের তথ্য, দিন থেকে দিন দক্ষ শ্রমশক্তি রপ্তনির পরিমাণ হৃাস পাচ্ছে।
সাল পেশাজীবী দক্ষ আধা দক্ষ স্বল্পদক্ষ মোট
২০০১ ৬৯৪০ ৪২৭৪২ ৩০৭০২ ১০৯৫৮১ ১৮৮৯৬৫
২০০২ ১৪৪৫০ ৫৬২৬৫ ৩৬০২৫ ১১৮৫১৬ ২২৫২৫৬
২০০৩ ১৫৮৬৮ ৭৪৫৩০ ২৯২৩৬ ১৩৬৫৬২ ২৫৪১৯০
২০০৪ ১৯১০৭ ৮১৮৮৭ ২৪৫৬৬ ১৪৭৩৯৮ ২৭২৯৫৮
২০০৫ ১৯৪৫ ১১৩৬৫৫ ২৪৫৪৬ ১১২৫৫৬ ২৫২৭০২
২০০৬ ৯২৫ ১১৫৪৬৮ ৩৩৯৬৫ ২৩১১৫৮ ৩৮১৫১৬
২০০৭ ৬৭৬ ১৬৫৩৪৪ ১৮৩৭৫৪ ৪৮২৮৩৫ ৮৩২৬০৯
২০০৮ ১৮৬৪ ২৮১৪৪৪ ১৩২৮১০ ৪৪৭৩৩৮ ৮৭৫০৫৫
২০০৯ ১৪২৬ ১৩৪২৬৫ ৭৪৬০৪ ২৫৫০৭০ ৪৭৫২৭৮
২০১০ ৩৮৭ ৯০৬২১ ১২৪৬৯ ২৮৭২২৫ ৩৯০৭০২
চিত্রঃ শ্রেণী ভিত্তিক প্রবাসী বাংলাদেশীর সংখ্যা
উক্ত চিত্রে আমরা দেখতে পাই আধা-দক্ষ ও স্বল্পদক্ষ জনশক্তি রপ্তনির হার উধ্ধমুখী, অন্যদিকে পেশাজীবীর সংখ্যা নিম্নমুখী, দক্ষ লোকের সংখ্যাও শতকরা হারে যথেষ্ট অসন্তোষজনক। তাই শুধু বৈদেশিক শ্রমবাজারের জন্য হন্য হয়ে, অহেতুক চেষ্টা করলে চলবে না। তার জন্য প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি তৈরী করা। আমাদের দেশে শ্রমিকের মান ও সুযোগ অত্যন্ত কম, সরকারও চেতনাহীন।
আরেক হিসাবে আমরা দেখতে পাই, আমাদের জনশক্তির ৮০% হচ্ছে মধ্যপাচ্যে, দেখা যাক সে দিকের অবস্থাঃ
সাল সৌঃ আরব কুয়েত ইউএই ওমান মালেশিয়া সিঙ্গাপুর অন্যান্য মোট
২০০১ ১৩৭২৪৮ ৫৩৪১ ১৬২৫২ ৫৪৬১ ৪৯২১ ৯৬১৫ ৬৬৫৬ ১৮৮৯৬৫
২০০২ ১৬৩২৫৪ ১৫৭৬৭ ২৫৪৩৮ ৩৯২৭ ৮৫ ৬৮৭০ ৪৫৪৫ ২২৫২৫৬
২০০৩ ২৬২১৩১ ২৬৭২২ ৩৭৩৪৬ ৪০২৯ ২৮ ৫৩০৪ ১১১৪৮ ২৫৪১৯০
২০০৪ ১৩৯০৩১ ৪১১০৮ ৪৭০১২ ৪৪৩৫ ২২৪ ৬৯৪৮ ২৫০০৬ ২৭২৯৫৮
২০০৫ ৮০৪২৫ ৪৭০২৯ ৬১৯৭৮ ৪৮২৭ ২৯১১ ৯৬৫১ ৩৫১৬৫ ২৫২৭০২
২০০৬ ১০৯৫১৩ ৩৫৭৭৫ ১৩০২০৪ ৮০৮২ ২০৪৬৯ ২০১৩৯ ৪০৯৭৯ ৩৮১৫১৬
২০০৭ ২০৪১১২ ৪২১২ ২২৬৩৯২ ১৭৪৭৮ ২৭৩২০১ ৩৮৩২৪ ৬৮১৮৮ ৮৩২৬০৯
২০০৮ ১৩২১২৪ ৩১৯ ৪১৯৩৫৫ ৫২৮৯৬ ১৩১৭৬২ ৬৮৫১ ৬৮৮৩৬ ৮৭৫০৫৫
২০০৯ ১৪৬৬৬ ১০ ২৫৮৩৪৮ ৪১৭০৪ ১২৪০২ ৩৯৫৮১ ৮০১৪১ ৪৭৫২৭৮
২০১০ ৭০৬৯ ৪৮ ২০৩৩০৮ ৪২৬৪১ ৯১৯ ৩৯০৫৩ ৭৫৮৪০ ৩৯০৭০২
চিত্রঃ দেশভিত্তিক প্রবাসী বাংলাদেশী জনশক্তির সংখ্যা
উক্ত চিত্রে আমরা দেখতে পাই বিগত কয়েক বৎসর মধ্যপাচ্যে জনশক্তি রপ্তানিতে ব্যাপক ধস নেমেছে। আরব আমিরাত ছাড়া অন্যান্য দেশে কমছে বিগত বৎসরের তুলনায়, মালেশিয়ার যা বেড়েছে তাও সেখানে অবস্থানকারীদের অবস্থা আমরা অবগত। যা অনেকটা পাঠানো হয়েছে প্রতারণা এবং অদক্ষ লোকবল। সৌদ এবং কুয়েত হঠাৎ করে প্রায় শূন্যের কোটায়, বাহরাইন ও ওমানে বাড়লেও যা সল্প মজুরির কারণে। অসহায় জনবল গিয়েছে।
এইক্ষেত্রে মহাআশ্চার্যের বিষয় হচ্ছে, সরকার নতুন নতুন শ্রমবাজার তৈরীর জন্য উদগ্রীব হয়ে গেছে, কিন্তুু বিদ্যমান শ্রমবাজার গুলো ধরে রাখতে পারলে এর আর প্রয়োজন হয় না। এমনকি পুরানো শ্রমবাজার গুলো থেকে জনবল প্রেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গিয়াছে। তাই সরকারকে নতুন করে ভাবতে হবে। কারণ মধ্যপাচ্যে এখন উপমহাদেশের অন্যান্য দেশ থেকে জনবল নিলেও নিচ্ছেনা বাংলাদেশ থেকে। প্রয়োজন বোধে পরারাষ্টনীতিতে আনতে হবে পরিবর্তন।
সার্বিক প্রেক্ষাপঠে আজকে বিশ্ব-শ্রমবাজারে বাংলাধেশের জনশক্তি রপ্তানি হুমকির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে, যা অনেকটা আমাদেরই কৃত্রিম সৃষ্টি। আমাদের ধারাই, শ্রমবাজার স¤প্রসারণ তো দূরের কথা, টিকিয়ে রাখাটাই আজকে বড় প্রশ্ন। তাই এইক্ষেত্রে অন্তত আমাদের ফের বদল নয়, স্থির থাকতে পারলেই হল!
তথ্য সূত্রঃ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো প্রবাসী কল্যাণ ও মন্ত্রনালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, ও অর্থনৈতিক সমীক্ষা।
মোহাম্মদ তরিক উল্যাহ
আইন বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।