সেন্ট পিটার্সবার্গ, রাশিয়া।
দিনটি শনিবার।
রাত বারোটা বেজে তেতাল্লিশ মিনিট। শহরের প্রধান সড়ক ছাড়িয়ে ভেতরের দিকের রাস্তাঘাট গুলো এখন প্রায় নিশ্চুপ। গাড়ি ঘোড়ার শব্দ ক্বচিৎ শোনা যায়।
মাঝে মাঝে দুই একটা গাড়ি হুশ করে বেরিয়ে যায়। এইরকমই একটি রোড সংলগ্ন এক কামরার একটি ফ্ল্যাটে বাস করে বোরিস ও তার বউ আন্না। দুজনের ছোট সংসার।
বোরিসের বয়স প্রায় পঁয়ত্রিশ। দেহ কাঠামো বেশ মজবুত এখনো।
তবে পাদুটি এখন অচল। বোরিস তার ইজি চেয়ারে আধ শোয়া। চোখ বোজা। মুখে জ্বলন্ত সিগারেট। আধ পোড়া।
প্রতিদিনের মতই স্মৃতি ঘোরপাক খাচ্ছে তার মস্তিস্ক জুড়ে।
আন্নার সেই হাসি মাখা মুখ। ড্রাইভিং সিটে বসে বোরিস। তারপাশেই আন্না। রেডিওতে বাজছে ওদের দু জনেরই প্রিয় আরাশের একটি গান।
গানের তালে তালে ওর কাঁধে মাথা রেখে শরীর নাচাচ্ছে আন্না। বেশি দিন তো নয়। কবে কার কথা। বছর খানেক হবে।
এর মাঝেই হটাৎই বোরিসের মনে পরে জর্জিয়ার সাথে যুদ্ধের ভয়াবহতা।
সেদিন একটি গ্রেনেড যা কিনা আচমকাই বিস্ফোরিত হয়। বোরিস বুঝতে ও পারে নি কিন্তু জ্ঞান হারায়। তারপর পরের কিছুই মনে পরে না। জ্ঞান ফিরে ও নিজেকে আবিষ্কার করে একটি হাসপাতালে। চারপাশে ওর মতই অসংখ্য জন।
আহত। অদ্ভুত সব চিৎকারে ভারী হয়ে আছে ভেতরকার পরিবেশ। সেই সাথে নাকে ঢুকে হাসপাতালের সেই কড়া বীভৎস দুর্গন্ধ। যা কিনা ওর অপরিচিত নয়। ওর বাবা গাড়ি এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে থাকা অবস্থায়ই বোরিস প্রথম জীবনে ওই গন্ধের সাথে পরিচিত হয়।
একসময় ভিজিটিং ডাক্তার আসে। ওকে শুনতে হয় জীবনের কঠিনতম নির্মম সত্যটি। ওর পা দুটি আর কখনো চলবে না। ওই দিন ও কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় নি। শুধু ওর চোখদুটো ভিজে উঠেছিল।
মনে পরে গিয়েছিল শৈশবের স্মৃতি। চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল জন্ম দিন উপলক্ষে বাবার কিনে দেয়া সাইকেলটি। যা কিনা ছিল ওর শৈশবের সব চেয়ে বড় সঙ্গী।
আন্না। অতি সুন্দরী এক তরুণী।
বয়শ আঠাইশ। যৌবনের পূর্ণতায় এখনো ভরা কলসই বলা যায়। চুল গুলো জন্ম থেকেই সোনা বর্ণের। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল ওর নীল বর্ণের ডাগর ডাগর চোখ দুটি যা কিনা ওর গোল শেপের মুখটির সাথে বেশ মানিয়ে যায়। স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করা আন্নার ইংরেজিটা ও ভালো জানা।
পিটারের নামি দামি একটি ব্যাংকে জব করে ও। মাস শেষে যা পায় তা দিয়েই সংসারটাকে চালাতে হয় ওর।
শহরের মধ্যখানে নেভস্কি প্রসপ্যাক্ট এলাকায় একটি ক্লাবে হাতে বিয়ারের গ্লাস নিয়ে বসে আছে আন্না। মাঝে মাঝে চুমুক দিচ্ছে গ্লাসে। বিয়ারের ফেনা লেগে যাচ্ছে ওর ঠোঁটের আসেপাশে।
এই জিনিসটা ওর কখনোই পছন্দ নয়। কিন্তু আজ কেন জানি খারাপ লাগছে না। চোখ দুটি নিবদ্ধ সামনে বসা মানুষটির দিকে। এক মনে তাকিয়ে আছে ও পুরুষালি চেহারার মানুষটির দিকে। মনে মনে ভাবছে এতো সুন্দর ও কি মানুষ হয়।
তারপর নিজেই নিজেকে ধমক লাগায় ও। কি সব উলট পালট ভাবছে ও। দুজনের মাঝে বারতি কোন কথা নেই। শুধু চোখে চোখে যত টুকু কথা বলা সম্ভব তত টুকু হচ্ছে।
সামনে বসা অপরিচিত লোকটিই প্রথম ওকে অফার করে তার সাথে নাচার জন্য।
প্রথমে আন্না একটু অবাক হয়। পরে কিছুটা কৌতূহল বশতই ওর সাথে নাচার জন্য সম্মতি জানায়। চেহারাটা ঠিক ওদের মানে রাশানদের মতো নয় কিন্তু রাশানটা বলে বেশ চোস্ত । এই ব্যাপারটিই আন্নাকে কৌতূহলী করে তুলে। মনের কোন এক দুর্বল জায়গা থেকে তাগাদা অনুভব করে ও।
আজ তো শনি বার। উইকেনডস। কিছুটা আমোদ ফুর্তি করার জন্যই তো আসা এই ক্লাবে। তাছারা বোরিসের সঙ্গটাও আজকাল ও উপভোগ করতে পারে না ও। বেশ ক্লান্ত অনুভূত হয় ওর।
এভাবে আর কত দিন। তারপরই আবার নিজেকে নিজে ধমক লাগায়। বোরিসকে তো ওই ভালবেসে বিয়ে করেছে। তাহলে কি ওর শারিরিক অক্ষমতা ............ না না আন্না ভাবতে চায় না।
লোকটিই প্রথম জিজ্ঞেস করে ওকে।
তা আপনার নামটা জানতে পারি কি? হুম। কেন নয়? অনেকটাই দ্বিধা নিয়ে উত্তর করে আন্না। আমি আন্না। আন্না আম্বারসুমোভনা। আর আমি জুকার।
জ্যাক জুকার। । বলেই হাত বাড়িয়ে দেয় লোকটি। আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। এরপর টুকটাক অনেক কথা বার্তা চলতে থাকে ওদের।
রাতের আঁধার ঘনীভূত হয়ার সাথে সাথে ওদের আলাপচারিতা ও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। সেই সাথে ঘনিষ্ঠতা। নাচ ও হয় কয়েক প্রস্থ। নাচের মাঝে কয়েক বারই আন্না জুকারকে বেশ ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখা যায়। তার পর বিদায় লগ্নে সবশেষে হয় ওদের সেল ফোন নাম্বারের আদান প্রদান।
সারা রাত্রির ঘনিষ্ঠতার পর খুশি হয়েই আন্নাকে জুকার তার নতুন কেনা বিএমডব্লিউ গাড়িতে করে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে। আন্নাও খুব খুশি হয়ে তার কথায় সাড়া দেয়। আন্নার ফ্ল্যাটের সামনের রাস্তায় জুকার বেশ ফুর্তি ফুর্তি ভাব নিয়ে ওর গাড়িটিকে একপাশে কায়দা করে থামায়। তারপর জুকার নিজে বের হয়। আন্নাকে বের হওয়ার জন্য ওর পাশের দরজাটি খুলে দেয়।
গাড়ি থেকে নেমেই কোন কিছু না ভাবেই আন্না জুকারকে ওর বাহুডোরে গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে। ওর গোলাপি ঠোঁট দুটো ডুবিয়ে দেয় জুকারের ঠোঁটে। তারপর কিছুটা সময় নিয়েই ওরা পরস্পরের থেকে বিদায় নেয়।
আন্না তার গালের পাশে পরে থাকা চুল গুলোকে কানের পেছনে নিতে নিতে গেটের লকে নাম্বার বাটন গুলো চাপতে থাকে। আর গুন গুনিয়ে উঠে নিজের অজান্তেই।
ওর প্রিয় গানের সুর। নিজের ভেতরে কেমন এক ধরনের অদ্ভুত ভালো লাগা বইতে থাকে ওর। খুব অবাক হয় ও। এরকম তো ওর গত এক বছরে ও হয় নি।
সংক্ষিপ্ত করিডোর পেরিয়ে সিঁড়ির গোঁড়ায় পারা দিতেই ওর মন সেই পুরনো বিষন্নতায় ছেয়ে যায়।
ধীর পায়ে সিঁড়ি গুলো ভাংতে শুরু করে। গত জন্মদিনে বোরিসের গিফট করা লাল ব্যাগটি হাতড়ে চাবি বের করে ও। ধীর হাতে কি হোলে চাবি ঢোকায় ও।
ঘড়িতে তখন ভোর প্রায় ছয়টা। ওর চোখ চলে যায় দরজা বরাবর ইজি চেয়ারটির দিকে।
চেয়ারটিতে আধ শোয়া বোরিস। চোখ বন্ধ অবস্থায় মাথাটি এক কাঁধের উপর শান্ত ভাবে ঝোলানো। চেয়ারের এক পাশে প্রায় খালি ভোদকার একটি বোতল আর অন্য পাশের এশট্রে ছাড়িয়ে ফ্লোর ভর্তি সিগারেটের ছাই। ঘুমন্ত বোরিসের মায়া কারা ওই মুখটিতে অসহায়তার স্পষ্ট ছাপ। চমকে উঠে আন্না।
কখনো তো এভাবে লক্ষ করে নি ও। ভেতরটা নিজের অজান্তেই মুচড়ে উঠে ওর। বাঁধভাঙ্গা আবেগে চোখ দুটি ভিজে উঠে ওর উষ্ণ নোনা জলে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।