অকর্মা, ভীতু, কাপুরুষ ষ্টেশনে ঢুকেই আতিকের হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল। ১নং প্ল্যাটফর্ম খালি। একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালেন, রাত ৯টায় ট্রেন এখন সাড়ে ৮টা কোথায় তোমার ট্রেন ?
খিল খিল করে হেসে উঠল তনিমা, আমার ট্রেন মানে, আর আমার উপর রাগছ কেন ? ঐ দেখ ৩ নং প্ল্যাটফর্মে সীমান্ত এক্সপ্রেস দাড়িয়ে আছে, এখনি লাগাবে হয়ত।
তনিমা,রাগব কেন ? জান কাল সকালেই ঈদ, একদিন আগে ছুটি পেলেও তোমার এ্যাডভেঞ্চার এর সাধ জাগল, এতো রিক্স নেয়ার দরকার টা কি ছিল ?
দুর রিক্সএর কি আছে ? রাত আড়ায়টায় আমরা নাটোর পৌছুব আর সাথে সাথে ঢাকার নাইটকোচ পেলে দেড় ঘন্ঠায় চাঁপাই। দেখবে ভোর সাড়ে ৪টার মধ্যে আমরা চলে যাব।
আমার সব চেয়ে দুঃখ হচ্ছে দুপুরে সাগরদাড়ি ছিল ওতে আমরা রাজশাহী পর্যন্ত যেতে পারতাম এতক্ষত বাড়িতে থাকতাম।
হ্যঁ তা থাকতাম তবে আমার জানুকে নিয়ে রাতের জার্নির এই মজা কি পেতাম ?
আমরা কাল রাতেও যেতে পারতাম
হু, তবে এই ঈদের রাতে যাচ্ছি খুলনা টু নবাবগঞ্জ এটা আরো এক্সাইটিং, আলাদা এ্যাডভেঞ্চার, আলাদা মজা, আহ্ ! তনিমা আতিকের ডান হাতকে নিজের বুকে আকড়ে ধরে।
রাত প্রায় একটা সাঁ সাঁ করে ট্রেন চলছে কপাল ভালো ট্রেন ঠিক সময়েই ছেড়েছে এছাড়া কোন ষ্টেশনে নির্ধারিত সময়ের বেশী ১ সেকেন্ডও দাড়াচ্ছে না ট্রেনের গতিও অন্যান্য দিনের চাইতে ভালো, আতিক ধরেই নিল ট্রেন ড্রায়ভারের বাড়ি দিনাজপুর যার জন্য এমন অবস্থা আজ, ও বেচারাও বাড়ি গিয়ে ঈদ করবে, একটু যেন শাহস পেল আতিক।
তনিমা তার বুকে হেলান দিয়ে কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে, জানালা দিয়ে আসা বাতাস তনিমার খোলা চুল গুলি আতিকের চোখে মুখে আছড়ে পড়ছে। আতিকের ভীষন অপচ্ছন্দ খোলা চুলে রাতে জার্নি করা কিন্তু কথাটা কি কোনদিন তনিমাকে বলেছে, মনে হয় না আর বললেও ওর কিছু যায় আসত না।
আতিক চিন্তার মহাসাগরে ঝাপ দিল, সে কি তার স্ত্রীকে ভয় করে ? নাকি গরীব বাবার শিক্ষিত ছেলে হয়ে একটি সরকারী চাকুরীর বিনিময়ে ধনী পিতার একমাত্র মেয়েকে বিয়ে করে কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে তার সব আব্দার রক্ষা ! তাদের বিয়ের দুই বছর পার হয়েছে গত মাসে । এখন আতিক চায় একটা বাচ্চা সে তাদের ভাই বোনের মধ্যে বড় তাই তার বাবা মারও ইচ্ছে কিন্তু ভয়ে এ ব্যাপারে আতিকের মা এ বিষয়ে কোনদিন বৌমাকে কিছু বলতে পারেনি, আতিক একদিন বলেছিল
তনিমা চিৎকার করে উঠে, বলো কি তুমি আতিক এত জলদি তুমি আমার ফিগার নষ্ট করে দিতে চাও ? আর এই পেট ? অয়াক ! কি জঘন্য দাগ......
ট্রেনের হুইসেলে নড়ে উঠে আতিক , আশ্চর্য বাইরে কত চাঁদনী ! আজ না চাঁদের দশ তবে দশ দিনেই এতো আলো ! ট্রেনের গতি কমতে থাকে সাথে বাজতে থাকে হুইসেল । ট্রেনটা দাড়িয়ে পড়ে । এমন শুনশান জায়গায় ট্রেন দাড়ান দেখে আত্না কেপে উঠে আতিকের, ডাকাত নয়তো ? এই তনিমা উঠ
কি হল ?
মনে হয় ডাকাত, আতিকের আতংকিত উত্তর।
নড়ে বসে তনিমা , অয়াও ! নতুন অভিজ্ঞতা ..
বিরক্ত আর ভয় মেশানো চেহারায় তাকায় আতিক।
ঠিক তখনি ট্রেনের মাইকে ঘড় ঘড় করে উঠে,
আমরা আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি, এই মূহুর্তে আমরা আব্দুলপুর জংশন থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছি, পার্বুত্যীপুর থেকে ছেড়ে আসা খুলনাগামি লোকাল ট্রেন ডাউন ৪৪৩২ ট্রেনটি আব্দুলপুর জংনের ১ নং লাইনে লাইনচ্যুত ও পাশের অন্য লাইনগুলিতে তেলের ট্যাংকার ও মালবাহী অয়াগান জটের ফলে লোকাল ট্রেন ডাউন ৪৪৩২ কে পূনরায় লাইনে না উঠানো পর্যন্ত আমাদের এখানেই অবস্থান করতে হবে , অনাকাংখিত এই বিলম্বের জন্য আমরা আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।
আতিকের পায়ের তলা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত হিম হয়ে গেল । আশ্চর্য এমন পরিস্থিতিতে মেয়েটার হাসি আসছে কোথা থেকে ?
এত চিন্তা করনাতো, সব সময়মতো হয়ে যাবে।
আতিক জবাব দেবার মতো কিছু খুঁজে পেলনা সমস্ত কম্পাটমেন্ট জুড়ে নাটোরের যাত্রি, রীতিমতো হৈচৈ শুরু হয়েছে চারদিকে অথচ তনিমার সরল দৃষ্টি যেন এটাই স্বাভাবিক !
সময় যেন আর কাটতে চায়না। আতিক বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে, তনিমা হেসে আতিককে বললো.
তুমি লাষ্ট ১ মিনিটে ক’বার ঘড়ি দেখেছ জান ? ৪ বার, হিহিহিহি....চল নিচে যায় একটু হাটাহাটি করলে সময় কাটবে
সময় কাটানোর জন্য ঠিক নয় বৌ বলেছে তাই অনিচ্ছা নিয়ে আতিক কে নামতে হল।
বাইরে একটা হিম হিম ভাব। দুরে
ষ্টেশনের আলো দেখা যাচ্ছে।
এই চলনা আমরা ষ্টেশনে যায় আমার খুব চা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে
আতিক খুবই আহত হলো ,সকালে ঈদ, বাড়ি যাওয়া অনিশ্চিত আর চা খাওয়ার শাধ হল ! এই অন্ধকারে কিভাবে যাব ? শুনেছি রেললাইনের স্লিপারের নিচে সাপ থাকে। আর লাগেজে সবার ঈদের বাজার আমার বেতন বোনাসের টাকাও আছে , ওগুলি রেখে যাওয়া কি ঠিক হবে ?
আরে দুর তুমি শুধু নেগেটিভ চিন্তা করো আমার মতো পজেটিভ চিন্তা করতে শেখ , পায়ের গুল্লা চেড়ে উঁচু হয়ে তাদের পাশের যাত্রি বলল , ভাই আমাদের ব্যাগগুলি একটু দেখবেন আমরা একটু দেখে আসি কি অবস্থা ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে হাসল , চলেন এর আলোতে আশাকরি পিছলে পড়বেন না হিহিহি,,,
আতিক কোন কথা বলছে না সে পেছনে হাটছে একবার শুধু ভাবল, হায়রে আমার পজেটিভ অয়ালী, তোমার পজেটিভ চিন্তার জন্য আজ কি মসিবতেই না পড়লাম।
ট্রেনের ১টি অয়াগানের ৩টি চাকা নিচে নেমে গেছে , রেলের কিছু লোক জ্যাক ও বড়বড় মোটা কাঠ নিয়ে কাজে ব্যাস্ত, তনিমা গলা বাড়িয়ে বলল, এই যে ভাই আর কতক্ষন লাগবে ?
এই ঘন্ঠা তিনেক আপা।
দেখছ আতিক, তুমি খামখা চিন্তা করছিলা এখন আড়াইটা তিন ঘন্ঠা মানে সাড়ে ৫টা এখান থেকে নাটোর যেতে আধা ঘন্ঠা মানে ৬টা, আরো আধা ঘন্ঠা বেশী নাও , সাড়ে ৬টায় বাসে উঠলে ৮টায় বাড়ি ।
আতিক কিছু বললনা, এখনো তনিমার পেছন পেছন হাটছে, তনিমা ষ্টেশনের শেড পার হতে দেখে বলল,
কোথায় যাচ্ছ ?
এখানে খুব গ্যানজাম, চল প্যাটফর্মের শেষ মাথায় বসে চা খায়।
ওদের দাড়িয়ে দাড়িয়ে চা খেতে দেখে এক পিচ্চি এগিয়ে এলো, মাদুর ভাড়া লইবেন ?
কত ভাড়া ?
১ রাইত ২০ টেকা আফা
এখনতো ভোর রাত সকাল হতে আর অল্প বাকী
১৫ টাকা হইলে নেন
আচ্ছা দে...
আব্দুলপুর রেল জংশনের একদম শেষ প্রান্তে বসে আছে আতিক, তনিমা তার কেলে মাথা রেখে শুয়ে আছে , সকালের আভা ফুটতে শুরু করেছে আতিক তনিমাকে ডাক দিল এই উঠ ওদের কথা অনুযায়ি সময় হয়ে এলো, ট্রেনে ফিরতে হবে।
উঠে বসল তনিমা দুই হাত উপরে তুলে আড়মড়া ভেংগে বলল,
ট্রেনে ফেরার দরকার কি ? সীমান্তের আব্দুলপুরে ষ্টপেজ আছে ,জাননা ? এখানে তো এমনিতেই থামবে।
সকালবেলা একটু হাটা হলো, চলো
লাইনচ্যুত ট্রেনটি ধীরে ধীরে পেছনে আসছে দেখে লাফিয়ে উঠে তনিমা এই ট্রেন উঠেছে কিন্তু পেছনে যায় কেন ?
আমাদের ট্রেনকে সাইড দিতে
ও চলনা আরেক কাপ চা খেয়ে নি
চা শেষ করে ওরা ষ্টেশনের মূল শেডের দিকে চলল, এই দেখ আমাদের ট্রেন আসছে , আতিকের চেহারায় উজ্জলতা , হাটার গতি বেড়ে যায় ওদের
মূহুর্তে আতিকের মুখ থেকে সব উজ্জলতা উধাও , তনিমার হাত ছেড়ে দৌড়ালো এক লোকের দিকে।
ভাই ঘটনা কি আপনি সবুজ পতাকা দেখাচ্ছেন ?
হ যারা নামার তারা নেমেছে আর উঠার তারাও উঠে পড়েছে আর থেমে কি করব ?
কিন্তু আমরা ?
কেন মাইকে শনেননি ?
আমরা ঐ দিকটাতে ছিলাম
ওখানে যাইয়া আবার বসেন গা
ভাই প্লিজ , আপনি লাল পতাকা দেখান
আপনি ষ্টেশন ম্যানেজারকে বলেন
আতিক ছুটে গেল ষ্টেশন ম্যানেজারের রুমের দিকে , তালা বন্ধ
আতিক তালা ধরে জোরে ঝাকুনি দিল, ঠিক তখনি সীমান্ত এক্সপ্রেস প্রবাল শব্দে ষ্টেশনকে কাপিয়ে চলে গেল
আতিকের মনে হলো ট্রেনটা বুঝি তার বুকের উপর দিয়ে চলে গেল ।
_______________________________________________শেষ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।