দিন যায় রাত আসে । গাছে ফুল-ফল ধরে । আকাশে কালো মেঘ করে বৃষ্টি পড়ে । আবার বৃষ্টির অভাবে মাটি শুকিয়ে যায় । গৃহিনীরা তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন- হিন্দি টিভি সিরিয়ালের জন্য ।
দিনের বেলা অফিস গুলোতে ব্যস্ততা, রাস্তায় জনতার কলাহল । আবার রাতের বেলা সব নিঝুম । কেউ কেউ না ঘুমিয়ে পার করে দেয় সারারাত । অনেক দূর থেকেও কেউ কেউ প্রিয় মানূষের জন্য চোখের জল ফেলেন । খুব একা চুপ-চাপ দূরে গিয়ে বসে থাকেন ।
প্রতিটি দিন সব মানুষকেই কোনো না কোনো অভিনয়ে অংশ নিতে হয় -আমি ভালো আছি, এই দেখো না হাসছি ! মানূষের গতি-বিধি সব লক্ষ্য রাখছেন একজন দূরে বসে । তিনি দূর থেকে সব দেখেন, কখনো কখনও মিটি মিটি হাসেন । এইভাবেই চলছে প্রতিদিনের জীবন যাত্রা ।
গুল্লুর খুব প্রিয় একটা কবিতা আছে, কাজী নজরুল ইসলামের-" বন্ধু গো আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে !/ দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কি মুখে। / রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা,/ তাই লি্খে যাই এ রক্ত-লেখা,/ বড় কথা বড় ভাব আসে না'ক মাথায়, বন্ধু বড় দুঃখে !/ অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু যাহারা আছ সুখে !
অবশেষে অনেক নাটিকীয়তার পর গুল্লুর সাথে হিমির বিয়ে হয় ।
এখন গুল্লু বুঝতে পারছে বিয়ে মানেই যন্তনা । বিয়ে করাটা বিরাট বোকামি হয়েছে । সন্ধ্যার পর থেকেই হিমি ফোন করতে শুরু করে- তুমি কই, তাড়াতাড়ি বাসায় আসো । সেই কখন অফিস ছুটি হয়েছে । এত আড্ডা কিসের ? গুল্লু লক্ষ্মী ছেলের মত বাসায় ফিরে আসে ।
হিমি এলোমেলো নানান গল্প বলে যায়, গুল্লুর তা শুনতে হয় । গুল্লু বিয়ের পর যা পেয়েছে তা হলো- চা । রাত দুইটায় হিমিকে চা বানাতে বললেও সে বিরক্ত হয় না হাসি মুখে চা বানিয়ে দেয় । গুল্লুকে আদর করে ঘুম পাড়িয়ে দেয় হিমি- তারপর নিজে ঘুমোয় ।
হাসি আর আনন্দেই চলে যায় গুল্লু আর হিমির সংসার ।
ছয় বছরের মধ্যে হিমির তিন টা বাচ্চা হয় । বড় মেয়েটার নাম-টাপুর, মেজ ছেলেটার নাম-টুপুর আর ছোট ছেলেটার নাম- গেদু । টাপুর টুপুর নাম টা রাখেন- নীলা নামের একজন মায়াবতী । হয়তো রবীন্দ্রনাথের " বৃষ্টি পরে টাপুর টুপুর নদে এলো বান " থেকেই নেওয়া হয়েছে টাপুর-টুপুর । আরা গেদু নামটা গুল্লু- হিমি দুইজন মিলেই রাখে ।
টাপুর-টুপুর হওয়ার পর গুল্লু চাকরী নিয়ে লন্ডন গিয়েছিল । কিন্তু রাতে কিছুতেই ঘুমাতে পারতো না গুল্লু । বার বার টাপুর-টুপুর আর হিমির কথা মনে পড়ত । তখন গুল্লু ভাবলো- সুখে থাকার চেয়ে স্বস্তিতে থাকা অনেক ভালো । পনের দিন পরেই চলে আসে নিজের বাচ্চা আর বউ এর কাছে ।
গুল্লুর পরিবার সুন্দর একটি পরিবার । কোনো দুঃখ নেই, কষ্ট নেই । প্রতি শুক্রবার গুল্লু সারাদিন বাচ্চাদের সাথে কম্পিউটারে গেমস খেলে, মুভি দেখে । গল্প করে । এক শুক্রবার গুল্লু বাচ্চাদের সাথে গেমস খেলছে- তখন হিমি এসে বলল- বাজারে যাও ।
ফ্রিজে কিছু নেই । গুল্লু রেগে গিয়ে বলল- গতকাল কেন বলোনি ? জানো না, সপ্তাহে একটি দিন আমি বাচ্চাদের সাথে সারাদিন থাকি । হিমি বলল- বাজার আনার পর রান্না বসাবো । বাচ্চারা খাবে তুমি খাবে । গুল্লু বাজারে যায় ।
এক সপ্তাহের বাজার করে নিয়ে আসে । হিমি গুল্লুকে এক কাপ চা হাতে দিয়ে বলল- গোছল করে জুম্মার নামাজ টা পড়ে এসো । তারপর সবাই একসাথে মিলে খেতে বসব ।
গুল্লু নামাজ পড়ে এসে দেখে গেদু কাঁদছে । টাপুর-টুপুরও মন খারাপ করে বসে আছে ।
গুল্লু, গেদুকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে রে বাবা ? গেদু বলল- মাম মেরেছে । তখন টাপুর টুপুর এসে বলল বাবা- মাম আমাদেরও বকেছে, আইসক্রীম চেয়েছিলাম বলে । হঠাৎ করে আমার মাথা গরম হয়ে গেল । ফ্রিজে দুই বাটি আইসক্রীম আছে । হিমির রান্না শেষ, হিমি টেবিলে খাবার সাজাচ্ছিল ।
গুল্লু হিমির কাছে কি জানতে চাইলো বাচ্চাদের মেরেছো কেন ? হিমি বলল- এত বিরক্ত করে না ! গুল্লু রেগে গিয়ে চিকৎকার করে বলল- তোমাকে হাজার দিন মানা করেছি না, বাচ্চাদের বকবে না , মারবে না । ওদের যা খুশি ওরা তাই করবে । তোমার রাগ হয়েছে তুমি চার টা গ্লাস ভেঙ্গে ফেলতে । গুল্লুর এত রাগ লাগছিল সে চার টা গ্লাস আর দুইটা মগ ভেঙ্গে ফেলল । মগ দুইটা হিমির খুব প্রিয় ছিল ।
দুপুরে কেউ না খেয়ে চুপ-চাপ বসে আছে । গুল্লু একেবারেই ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না । গেদু কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে মেজেতে । টাপুর-টুপুর সোফায় চুপ করে বসে আছে । হিমি ব্যাগ গুছিয়ে গুল্লুর কাছে এসে বলল- আমি চললাম ।
টেবিলে খাবার দেওয়া আছে, বাচ্চাদের নিয়ে খেয়ে নিও । গুল্লুর আরো বেশী রেগে গিয়ে বলল- যাও, তুমি । লাগবে না তোমাকে । আমি বাচ্চাদের সুন্দর ভাবেই পালতে পারব । হিমির চোখ থেকে দু'ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো ।
গুল্লু দেখল না তা । হিমি চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল । বাচ্চারা কিছু বুঝতে না পেরে একবার বাবা'র দিকে আর একবার মা'র দিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল ।
সন্ধ্যা পর্যন্ত অনেক চেষ্টা করেও গুল্লু বাচ্চাদের খাওয়াতে পারে নি । বাচ্চাদের না খাইয়ে গুল্লুও খেতে পারে না, তাই সেও না খেয়ে আছে ।
বাচ্চাগুলো সারাদিন কত খেলা-ধূলা করে, কিন্তু আজ সবাই চুপ করে আছে । গুল্লুর বুকের ভেতর কেমন চাপ চাপ কষ্ট ঢোল পিটাচ্ছে । রাত ৯ টায় গেদু বলল- বাবা, মা'র কাছে যাবো । টাপুর টুপুর বলল- মাম এলে তার পর খাবো । গুল্লু টুপুর কে বলল ফোন করো তোমার মাকে ।
টাপুর বলল- বাবা মামকে অনেক বারই ফোন করেছি, মোবাইল বন্ধ । রাত ১১ টায় গুল্লু বাচ্চাদের নিয়ে গেদুর মামা বাড়ি গেল । নিচ থেকে হিমি কে খবর পাঠানো হলো । হিমি পাঁচ তলার বারান্দা থেকে দেখল- বাচ্চারা উপরে দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর দু'হাত তুলে মাকে নিচে নামতে বলছে । হিমি দৌড়ে কাঁদতে কাঁদতে নিচে নেমে এসে বাচ্চাদের জড়িয়ে ধরল ।
গুল্লু তখন পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল ।
সেই রাতে গুল্লুরা বাসায় ফিরে, হিমি বাচ্চাদের খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে তারপর গুল্লুকে নিয়ে খেতে বসে । হিমি গুল্লুকে বলে -এই আস্তে আস্তে খাও । গুল্লু , হিমি কে বলে তোমার মনে আছে সেবার নীলগিরি থেকে আসার পর তুমি গেদুর অস্তিত্ব প্রথম টের পেয়েছিলে ? আচ্ছা, ডাক্তার কেন বলল- আরা বাচ্চার দরকার নাই ! মাত্র তিনটা বাচ্চা ! ঘর ভরতি বাচ্চা-কাচ্চা না থাকলে ভালো লাগে । খাওয়া শেষ করে গুল্লু বারান্দায় গিয়ে বসে , হিমি দু মগ চা বানিয়ে নিয়ে এসে গুল্লুর পাশে বসে ।
এই সময়ই সংসারের নানান কথা হয় হিমির সাথে । বাচ্চারা বিছানায় ঘুমায় । গুল্লু আর হিমি ফ্লোরে বিছানা পেতে ঘুমায় । কিন্তু সকালে হলে দেখা যায় তিন বাচ্চা'ই বাবা-মা'র পাশে এসে ঘুমিয়ে থাকে ।
যে রাত্রে হিমির ঘুম আসে না, সে রাত গুলোতে গুল্লু হিমিকে কবিতা আবৃত্তি করে শোনায় ।
" তোমাকে শুধু তোমাকে চাই, পাবো ?/ পাই বা না পাই এক জীবনে তোমার কাছেই যাবো। / ইচ্ছে হলে দেখতে দিও, দেখো । / হাত বাড়িয়ে হাত চেয়েছি রাখতে দিও, রেখো । .... আবার যে রাত গুলো গুল্লুর ঘুম আসে না, হিমি গান গেয়ে শোনায় । একটা গান লিখো আমার জন্য/ যে গান যেন আমায় উজার করে নেয়/ যে গান যেন আমায় ব্যকুল করে দেয়/ আমি যেন হই তোমার মাঝে ধন্য.....
( নন্দিনী খান এবং আশরাফুল মুসাদ্দেক ।
এই লেখাটা উৎসর্গ করা হলো এই দুই জনকে । তারা দুই জনই আমার খুব প্রিয় । তারা ভালো থাকুক । ভালো থাকুক গুল্লু ও হিমির পরিবার । ভালো থাকুক সমগ্র মা্নব জাতি ।
) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।