মেঘমুক্ত নীলাভ দিঘীর কবোষ্ণতা খুঁজছে মন!
বাবা, তুমি আমার দিকে আরেকটু চেয়ে থাকো!
আমি একটু বিব্রত হই। এ ধরনের অনুরোধে আমি অভ্যস্ত হলেও আশপাশের সবাই নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়।
জ্বী চাচী, আমি চেয়ে আছি।
তিনি আবার চোখ বুজলেন।
অনেকদিন পর উনাকে দেখতে এলাম।
বছর কয়েকআগে উনিই আসতেন আমাকে দেখতে নিয়মিত। সেটার প্রতিদানই হয়তো দিতে আসি, নাকি অন্যকিছু-কৃতজ্ঞতা! হতে পারে।
আমার মধ্যে অনুভূতি খুব কম। জগতের অনেক কিছুর উপর সীমাহীন বিতৃষ্ণা আছে। অথচ আমার মত ভাগ্যবান কিন্তু খুব কমই আছে।
দুটো ব্যাপার কি পরস্পরবিরোধী হয়ে গেল না। বলা যায়, মা কিছুটা জোর করে প্রতিবছর অন্তত একবার করে আমাকে পাঠায় উনার সাথে দেখা করতে।
হাসপাতালের বেডটা ধবধবে সাদা। সাদা রঙের মধ্যে মন খারাপ করা একটা ব্যাপার আছে। অথচ আশপাশের ডাক্তার-নার্স সবার কান্ড দেখ-নিজেদের পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে সবকিছু যেন সাদা রঙে ডুবিয়ে এনেছে।
মাথার উপরে একটা বিদঘুটে মনিটরে আঁকাবাঁকা একটা রেখা ক্রমাগত দৌড়াচ্ছে। বেডের আশেপাশে থাকা উনার কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন সেটার দিকে ভাবলেশীন মুখে মাঝে মধ্যেই তাকাচ্ছে। ওই রেখাটা শীঘ্রই একটা সরল রেখা হয়ে যাবে-ডাক্তারের কথা ভুল প্রমাণিত না হলে। সেটার জন্যই কি সবাই অপেক্ষা করে আছে!
এক গম্ভীর চেহারার মধ্যবয়স্ক লোক আমার দিকে বিরক্ত মুখে তাকিয়ে আছে। উনি মহিলার ভাই, ছোট ভাই।
এই শোকস্তব্ধ পরিবেশে মৃত্যুপথযাত্রী, বেডের সাথে মিশে থাকা তার বোনের পাশে প্রধান অবলম্বন হয়ে বসে থাকা আমার মত অনাত্মীয় উটকো কাউকে ওনার পছন্দ হচ্ছে না তা বোঝাই যাচ্ছে।
মহিলা সামান্য চোখ খুলে আবার আমার দিকে তাকালেন।
জানো, ও খুব ছটফটে ছিল। খুব কথা বলতো! আর তুমি ঠিক উল্টোটা।
এ কথাটাও আমার বহুবার শোনা।
বহুবার মনে মনে বিরক্ত হয়েছি-আমার সাথে মিলানোর কী আছে? আজকে বিরক্ত হতে পারলাম না। মনে হল, তাইতো, আমি এত হৃদয়হীন কেন, মৃত্যুপথযাত্রী এক বয়স্ক মহিলাকে কেন কোন সান্ত্বনাবাক্য শোনাতে পারছি না।
তিনি চেয়ে রইলেন আমার দিকে, চেয়েই রইলেন। ঠিক আমার দিকে নয়, আমার দুই চোখের দিকে, আমি জানি তিনি কখনোই আমার মুখের দিকে তাকান না, সেটা তার কাছে অপরিচিত।
একসময় বিদঘুটে মনিটরের লাইনটা সরল হয়ে যায়, আশপাশে মৃদু কান্নার আওয়াজ শোনা যায়।
কোথায় যেন কে কাকে খুব ধমকাচ্ছে, বিপ বিপ আওয়াজটা বাড়তে থাকে। অথচ আমার কানে যেন কিছুই যায় না। আমি চেয়ে থাকি একদৃষ্টিতে ওই চোখের দিকে।
হাসপাতালের বাইরে এসে আমি আবিষ্কার করি আমার চোখ দুটো ভেজা। ব্যক্তিগত ভাবে আমি বেশ রূঢ় হৃদয়ের।
আমি জানি এ জল আমার চোখের নয়। এ জল অন্যকারো!
বছর পাঁচেক আগে তার ছেলের মরনোত্তর চক্ষুদানের কারনে আজ আমি দৃষ্টিসর্বস্ব। আমি নীচে নেমে হাঁটা দেই-একটা ট্যাক্সির খোঁজে। অনেক দূর থেকে এসেছি।
খুব প্রার্থনা করছিলাম যেন আমি আসার আগেই সব শেষ না হয়ে যায়।
আমার পথ চেয়ে থাকা একজন মা যেন তার সন্তানের চোখে চোখ রেখে শান্তিতে ঘুমাতে পারেন। স্রষ্টা আমার প্রার্থনা পূরণ করেছেন। বলেছিলাম না- আমি অনেক ভাগ্যবান!
( লেখাটি মরনোত্তর চক্ষুদান নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন 'সন্ধানী'র প্রকাশিতব্য দেয়ালিকার জন্য লেখা)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।