তৃণমূল পর্যায়ে হতাশা ও ক্ষমতাসীনদের ভবিষ্যৎ
ফকির ইলিয়াস
============================================
দেশে একটা রাজনৈতিক পরিবর্তন আসন্ন মনে হচ্ছে। গাজীপুর সিটি নির্বাচনেও হেরে গেছে সরকারী দল আওয়ামী লীগ। এই হেরে যাওয়া বড় শোচনীয়। চেষ্টা কম করা হয়নি। কিন্তু পারা যায়নি কোনোভাবেই।
আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমদ বলেছিলেন, গোপালগঞ্জের পর গাজীপুরই আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি। সেই ঘাঁটিতেই ধ্বস নেমেছে আওয়ামী লীগের। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ব্যঙ্গ করে বলেছেন, তার এক বন্ধু আওয়ামী লীগ নেতা বলেছেন গাজীপুর আওয়ামী লীগের আরেক গোপালগঞ্জ। যদি গাজীপুর নির্বাচনে এই অবস্থা হয় তাহলে আগামী নির্বাচনে গোপালগঞ্জের অবস্থা কী হবে? মওদুদ আহমদ বলেছেন, সরকার বলছে তারা সাড়ে চার বছরে অনেক উন্নয়ন করেছে। কিন্তু সরকারের উন্নয়নের জোয়ার ভোটের জোয়ারে ভেসে গেছে।
আগামী পাঁচ মাসে এ সরকার আরো ভুল করবে। সরকারের জনপ্রিয়তা তলানিতে চলে গেছে। এই রুগ্ণ সরকার এ অবস্থা থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারবে না। তারা শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ' এই প্রশ্ন গোটা দেশবাসীর।
আওয়ামী লীগ কী করলো গেল পাঁচবছর। কেন তারা নিজেদেরকে শোধরাতে পারলো না?
জাতীয় পাটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ শেষ মুহুর্তে এসে এডভোকেট আজমত উল্লাহ খানকে সমর্থন দিয়েছিলেন। এতে কোনো কাজ হয়নি। কাজ হওয়ার কথা নয়। কারণ মানুষ এরশাদের কাছে দায়বদ্ধ ছিল না যে, তার হুকুম তামিল করতে হবে।
একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, প্রতিটি বড় দলেই এখন আভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকট। বড় তিনটি দলের নিজের ভেতরে গণতন্ত্র না থাকায় তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের মাঝে রাজনীতি ও দল নিয়ে হতাশা বেড়েছে। মানুষ এখন আর কারো চাপিয়ে দেয়া মতবাদ মানছে না। মানতে চাইছে না। এর প্রধান কারণ রাজনীতিকরা মানুষের কাছে দেয়া ওয়াদা পূরণ তো করেনইনি, বরং লুটপাট করেছেন অবলীলায়।
২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি যা করেছিল, তা মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিয়েছিল। এর ফলেই আওয়ামী লীগের অনেক অযোগ্য প্রার্থীকেই ভোট দিয়ে জিতিয়েছিল সাধারণ মানুষ। আওয়ামী লীগ সেই সম্মান ধরে রাখতে পারেনি। বরং তারা ‘ধরাকে সরা জ্ঞান’ করেছে। একটি দেশের স্থিতীশীলতার জন্য রাজনৈতিক সহনশীলতা খুবই দরকারি ছিল।
লুটপাটকে উৎপাটন করা জরুরি ছিল। আওয়ামী লীগ তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার মাশুল এসেছে পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে। বর্তমান সরকারের এই যে পতনধ্বনি শোনা যাচ্ছে, তারপরও সরকারের নেতারা বড় বড় বুলি আওড়াচ্ছেন। পরিবেশ ও বনমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ বলেন, গাজীপুরসহ পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিতরা জয়ী হলেও আগামী জাতীয় নির্বাচনে এর কোনো প্রভাব পড়বে না।
বাংলাদেশের সর্বত্রই এখন ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। মানুষ অনেক সচেতন হয়েছে। আগামীতে সরকার পরিবর্তনের যে রায় দেবে তখন তারা ভালোভাবে চিন্তা করে দেবে। ’ কথা হচ্ছে, মানুষ আর কী চিন্তা করবে? কতোটুকু চিন্তা করবে?
ড. হাসান মাহমুদ আরো বলেছেন, ‘স্থানীয় নির্বাচনে স্থানীয় সমস্যাগুলো বেশি উঠে আসে। তাই এ নিবার্চনে মানুষ যাকে ভালো মনে করেন তাকে ভোট দেন।
সে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হোক বা বিএনপিরই হোক। জাতীয় নির্বাচনে জনগণ বোমাবাজ, গ্রেনেড হামলাকারী ও হাওয়া ভবন দখল আর দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ান হবে নাকি বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আর উন্নয়ন দেশ হবে তা বিবেচনা করবে। আশা করি জাতীয় নির্বাচনে জনগণ তাদের সুচিন্তিত রায় দেবে। মানুষ ভাবনা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেবেন। বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বা পাকিস্তান বানাবেন না।
’
এদিকে, আওয়ামী লীগ ভুল করে থাকলে জনগণ তা শোধরানোর সুযোগ দেবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। তিনি বলেন, আমরা হতাশও নই, শঙ্কিতও নই। আমাদের ভুল আছে- ত্রুটি আছে, কেউ আমরা অস্বীকার করতে পারি না। এ ভুলের কারণে যদি কেউ আমাদের ভুল বুঝে থাকে তাহলে অনুরোধ করবো যে এ ভুল সংশোধনের সুযোগ করে দেন।
মোহাম্মদ নাসিম বলেন, পাঁচ সিটি করপোরেশ নির্বাচনের পরাজয়ে আওয়ামী লীগ হতাশ ও শঙ্কিত নয়।
পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের পরাজয়ের কারণ খতিয়ে দেখা হবে। আর দলের সাময়িক বিপর্যয় হলেও চূড়ান্ত লড়াইয়ে আমাদের বিজয় হবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের আত্মবিশ্বাস আছে, ভুল সংশোধন করে অবশ্যই জাতীয় নির্বাচনে জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে নিয়ে ইনশাল্লাহ আমরা বিজয় ছিনিয়ে আনবোই। যে কোন বিপর্যয়ের সময় ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে জানে আওয়ামী লীগ। বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসনের চিত্র তুলে ধরে সাবেক স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে- দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখবে, নাকি জঙ্গিবাদি শাসন ব্যবস্থায় ফিরে যাবে।
দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের নেতারা মুখে যত বড় কথাই বলুন না কেন, তাদের যে গৃহদাহ চলছে, তা তারা স্বীকার করতে রাজি হচ্ছেন না। আওয়ামী লীগের সহযোগী কিছু সংগঠনের নেতা কর্মীরা যেভাবে লুটপাট করেছে- করছে এর বিরুদ্ধেও তারা যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। অতিসম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) প্রকাশিত এক প্রতিবেদন দেশবাসীকে নতুন তথ্য দিয়েছে। ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑ বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়েছে এবং রাজনৈতিক দলগুলো ও পুলিশ বিভাগ সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সরকারি সেবা গ্রহণে কোনো না কোনো একটি সেবায় ঘুষ বা নিয়মবহিভূত অর্থ দেওয়া হয় ভারতে।
এ অবস্থানে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি এক সংবাদ সম্মেলনে গ্লোবাল করাপশন ব্যারোমিটার-২০১২ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত দুই বছরে বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়েছে বলে মনে করেন ৬০ শতাংশ উত্তরদাতা। জরিপে অংশ নেওয়া উত্তরদাতাদের ৯৩ শতাংশের ধারণা, বাংলাদেশে সর্বোচ্চ দুর্নীতিপ্রবণ খাত বা প্রতিষ্ঠান হলো রাজনৈতিক দল ও পুলিশ। আর ৮৯ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, এর পরের খাতই হলো বিচারব্যবস্থা।
এছাড়া ভূমি সেবা, রেজিস্ট্রেশন, পারমিট সেবা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা, পরিসেবা এবং কর ব্যবস্থাও দুর্নীতিগ্রস্থ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম। ৭৬ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, সরকারি খাতে দুর্নীতি খুবই গুরুতর সমস্যা। তবে ৯২ শতাংশ মানুষই মনে করেন, সাধারণ মানুষ দুর্নীতি প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারেন ও তারা কোনো না কোনোভাবে ভূমিকা রাখতে চান। এদিকে দুর্নীতির এই জরিপে উত্তরদাতারা নিজেদের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন- স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ভূমি, বিচার, কর এসব ক্ষেত্রে দুর্নীতি কিছুটা কমেছে। জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের তথ্যদাতাদের ৩২ শতাংশের অভিমত হল দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারৗ পদক্ষেপ অকার্যকর।
দুর্নীতির ঘটনা জানানোর ক্ষেত্রে উত্তরদাতাদের ৩১.৪ শতাংশ জনপ্রতিনিধিদের ওপর আস্থাবান। দুর্নীতি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওপর ১৮.৮ শতাংশের আস্থা রয়েছে। আর দুদকের কাছে জানতে চান ১১.৪ শতাংশ উত্তরদাতা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘুষ গ্রহীতা খাতগুলো হলো: পুলিশ ৭২ শতাংশ, বিচার ব্যবস্থা ৬৩ শতাংশ এবং ভূমি সেবা ৪৪ শতাংশ। ঘুষ প্রদানের কারণ হিসেবে ৫৮ শতাংশ মনে করেন সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে এটাই একমাত্র পথ।
টিআইবি’র পরিচালিত জাতীয় খানা পরিপ ২০১০ এর তুলনায় ২০১২ তে সেবাখাতে ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দেওয়ার হারও তুলনামূলকভাবে কমেছিল। যে বিষয়টি সাধারণ মানুষ খুব বেশি পীড়া দিচ্ছে, তা হলো জাতি একটি নির্দিষ্ট কালো-বলয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। মানুষ শান্তির পথ দেখছেন না। এর ফাঁকে দেশে পরাজিত মৌলবাদী শক্তি তাদের ফণা দেখাবার চেষ্টা চালাচ্ছে। সরকারকে যেসব বিষয়গুলো বেশি বেকায়দায় ফেলেছে এর মধ্যে রয়েছে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থীদের ভরাডুবি, তত্ত্বাবধায়ক প্রথার দাবী, মতিঝিলের হেফাজত ইস্যু, গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকারের অপতৎপরতা, হলমার্ক ও ডেসটিনি কেলেঙ্কারি,পদ্মাসেতু ইস্যু, জিএসপি সুবিধা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হওয়া ইত্যাদি।
সরকার তা কাটিয়ে ওঠার যথেষ্ট চেষ্টা করছে বলে মনে হচ্ছে না। সবমিলিয়ে দেশের মানুষ পরিবর্তন চাইছেন। কিন্তু কীভাবে হবে সে পরিবর্তন? পবিত্র রমজান মাস শুরু হয়েছে। রমজানের পরই দেশে আন্দোলন-হরতাল কর্মসূচি শুরু হতে পারে। তা রাষ্ট্র ও জনগণকে নির্বাচনের দিকে নিয়ে যাবেÑ না কি অন্য কোনো শক্তির হাতে দেশকে তুলে দেবে তা এমুহুর্তে বলা কঠিন।
তবে যে কথাটি বলা দরকার, তা হলো কোনোভাবেই দেশকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়া উচিৎ নয়। আর এই দায়িত্ব ক্ষমতাসীনদেরই বেশি।
সরকার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে এমন কোনো সম্ভাবনা অন্ততঃ আমি দেখছি না। কারণ এ দেশের অনেক বিশ্লেষক, সমাজ সচেতন মানুষেরা সরকারকে নানাভাবে সংকেত দিয়েছেন। তা শীর্ষ ব্যক্তিত্বদের গোচরে যদি আসতো, তবে তারা সতর্ক হতে পারতেন।
সবশেষে যে কথাটি বলতে চাই, তা হলো নির্বাচনে জিতে শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পর বলেছিলেন- যাদেরকে মন্ত্রী করা হয়েছে তারা প্রত্যাশা পূর্ণ করতে না পারলে বাদ দেয়া হবে। কারণ এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। আমার প্রশ্নটি হচ্ছে, এই কেবিনেটে অনেক ব্যর্থ মন্ত্রী ছিলেন। তাদেরকে বাদ দিয়ে নতুন মন্ত্রী নিয়োগ দেয়া হয়নি কেন? এতো ব্যর্থতার খবর জানার পরও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কেন কঠোর হতে পারলেন না? তৃণমূল পর্যায়ে হতাশা ক্ষমতাসীনদের পতন ত্বরান্বিত করে। যা বিএনপির বেলায় ২০০৯ এ হয়েছিল, সেটা এবার আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও হচ্ছে কি?
-----------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥: শনিবার, ১৩ জুলাই ২০১৩
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।