স্বপ্ন বুনছে:
ফরিদগঞ্জের অধিকাংশ প্রতিবন্ধী ভিক্ষুকেরা আয়বর্ধকমূলক কাজে সম্পৃক্ত
আজমাল হোসেন মামুন
ফরিদগঞ্জ উপজেলার ১৫ নং রূপসা (উত্তর) ইউপির রুস্তমপুর গ্রামের মোঃ বিল্লাল হোসেন (৪৫) একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। সেই বেশি দিনের কথা নয়, ৯৫ সালের পূর্বে সে রাজ মিস্ত্রির কাজ করে স্বাভাবিকভাবে সাচ্ছন্দে জীবন অতিবাহিত করতো। কিন্তু বিধি-বিড়ম্বনার কারণে হঠাৎ প্যারালাইজডে্ আক্রান্ত হয়ে নিম্নাঙ্গ অবশ হয়ে যায়। প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় করতে না পেরে গ্রাম্য ডাক্তারের নিকট চিকিৎসা গ্রহণ করে। সময়মত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নিকট না যাওয়ায় ১৯৯৬ সালে শারীরিক প্রতিবন্ধিতার শিকার হন।
আর্থিক অবস্থা সচ্ছল না হওয়ায় বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করা আরম্ভ করে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি (বিপিকেএস) ‘‘উন্নয়নে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্ব-উদ্যোগ (পিএসআইডি)’’ এপ্রোচ বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে। সেখান থেকে সে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ পেয়ে আত্মপ্রত্যয়ে বলিয়ান হয়ে ওঠে। সংশ্লিষ্ট সংগঠন থেকে কিছু সহযোগিতাও পায়। ফলে সে ট্রাইসাইকেলের পিছনে এক অতিরিক্ত বক্স তৈরি করে।
যাতে ৭০ থেকে ৮০ কেজি মালামাল বহন করা যায়। সেই ট্রাইসাইকেলে একা চলমান দোকানে বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বিক্রি করে স্বাবলম্বী।
ফরিদগঞ্জ উপজেলার ১৬ নং রূপসা (দক্ষিণ) ইউপির ৭ নং ওয়ার্ডের উত্তর সাহেবগঞ্জ গ্রামে হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম মোঃ মামুন হেসেন (২৫) নামের এক শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সে একা প্রতিবন্ধী এবং মেজ।
মামুনের বয়স যখন মাত্র ৫ বছর তখন পোলীয়তে আক্রান্ত হয়ে দুই পা একেবারে অকেজো হয়ে যায়।
ফলে ঘরের কোনে বসে পরিবারের বোঝা হিসেবে মূল্যবান ১৪ টি বছর অতিক্রম করে। পরিবার তাকে দু মুঠো ভাত দিলেও আউট খরচ দেওয়ার মত সামর্থ ছিল না। ফলে বিয়ারিং-এর গাড়িতে চড়ে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা আরম্ভ করে। এই দৃশ্য দেখে ফরিদগঞ্জের এক শিল্পপতি লায়ন হারুনার রশীদ তাকে বিনা মূল্যে একটি হুইলচেয়ার প্রদান করেন। কিন্তু সে হুইলচেয়ারটি বিক্রি করে এবং পূর্বের মত ভিক্ষা চালিয়ে যায়।
ভিক্ষা ছেড়ে আয়বর্ধকমূলক কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার ব্যাপারে ‘‘চাঁদপুর-ডিজএ্যাবল্ড পিপলস্ অর্গানাইজেশন টু ডেভেলপমেন্ট (চাঁদপুর-ডিপিওডি)’’ তাকে ৫ হাজার টাকা সাহায্য করে। উক্ত টাকায় একটি ছোট দোকান দিয়ে মালামাল ক্রয়-বিক্রয় আরম্ভ করে। ১৬ নং রূপসা(দক্ষিণ) ইউপি চেয়ারম্যান ফরিদগঞ্জ উপজেলা সমাজ সেবা অধিদপ্তর থেকে প্রতিবন্ধী অসচ্ছল ভাতার ব্যবস্থাও করে। তারপর থেকেই ক্রমেই ব্যবসার উন্নতি হচ্ছে।
শুধু মোঃ বিল্লাল ও মোঃ মামুন হোসেন-ই নয়।
তাদের মত অসংখ্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নিজেদের তৈরি সংগঠন ‘চাঁদপুর-ডিপিওডি’ নামক সংস্থার মাধ্যমে ভিক্ষার পরিবর্তে এবং বেকার জীবন থেকে আয়বর্ধকমূলক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হয়েছে । চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলায় এই দৃশ্য অহরহ চোখে পড়ে। কোন প্রতিবন্ধী ট্রাইসাইকেলে কাটা কাপড়, কোন প্রতিবন্ধী ট্রাইসাইকেলে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি গৃহিনীরে দ্বারে-দ্বারে পৌঁছিয়ে থাকে, কেউ দোকানদারী করছে, কেউ পোল্ট্রি ফার্ম, কেউ মৎস্য খামার, দর্জীসহ বিভিন্ন কাজ। সপ্তাহের ছুটির দিন বা সুবিধামত সময়ে সুখ-দুঃখের কথা, সমস্যার সমাধান সম্বন্ধে পরস্পরের মধ্যে আলোচনা করে থাকে ফরিদগঞ্জের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা।
জানা যায়, ১৯৯৯ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে কর্মরত ‘বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি (বিপিকেএস) নামক জাতীয় পর্যায়ের একটি বে-সরকারি সংস্থা ‘‘উন্নয়নে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্ব-উদ্যোগ (পিএসআইডি)’’ এপ্রোচ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার ৩টি ইউপিতে একটি প্রকল্পের কাজ আরম্ভ করে।
উক্ত প্রকল্পের আওতায় ৯ নং গোবিন্দপুর (উত্তর), ফরিদগঞ্জ পৌরসভা ইউডি ও ১৫ নং রূপসা (উত্তর) ইউপিতে প্রাথমিকভাবে এক জরিপ চালিয়ে প্রায় ১ হাজার বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী নারী-পুরুষ ও শিশুদের চিহৃিত করেন। ওসব প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা একত্রিত হয়ে তৃণমূল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন নামে ছোট ছোট ৩০ টি সংগঠন তৈরি করে। উক্ত ৩০টি সংগঠন মিলে ২০০৩ সালে ১৬ অক্টোবর ‘‘চাঁদপুর ডিজএ্যাবল্ড পিপলস্ অর্গানাইজেশন টু ডেভেলপমেন্ট (চাঁদপুর-ডিপিওডি) নামে একটি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আত্মসহায়ক সংগঠন তৈরি করে নিজেরা সঞ্চয় আরম্ভ করে। বর্তমানে তাদের সঞ্চয়ের পরিমান ৯৭ লাখ ৭৫৩ টাকা । সেই সংগঠনটি সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধনকৃত।
বর্তমানে উক্ত সংগঠনের সদস্য সংখ্যা পুরুষ ৩৯৪ জন, মহিলা ৩৬৬ জন এবং শিশু ৭৩ জন। তন্মধ্যে শারীরিক ৩২৪ জন, দৃষ্টি ৭৭ জন, শ্রবণ প্রতিবন্ধী ১৪ জন, বাক প্রতিবন্ধী ১৮ জন এবং ১৪৬ জন বহুমুখী প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রয়েছে। শিক্ষিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে ৪ জন মহিলা ও ১ জন পুরুষ প্রতিবন্ধী বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি পেয়েছে। ৬২ জন পুরুষ ও ৩২ জন মহিলা প্রতিবন্ধী উক্ত সংগঠন থেকে চলাফেরা উপযোগী বিভিন্ন সহায়ক উপকরণ পেয়েছে। ১২০ জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে স্বাস্থ্য বিষয়ক ও শিক্ষা বিষয়ক পরামর্শ দিয়েছে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে চাঁদপুর জেলার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটি, সিভিল সার্জন, সমাজ সেবা অধিদপ্তর, ব্যাংক, হাসপাতাল ও স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথে অ্যাডভোকেসি ও লবিং করে থাকে। এছাড়াও ৯৮ জন প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রীদের বিনামূল্যে বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ প্রদান করেছে।
চাঁদপুর-ডিপিওডি’র পরিচালক মমতাজ উদ্দিন মিলন জানান, ২০০৩ সাল থেকে ‘চাঁদপুর ডিজএ্যাবল্ড পিপলস্ অর্গানাইজেশন টু ডেভেলপমেন্ট (চাঁদপুর-ডিপিওডি) চাঁদপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সকল ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে সম-সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে আসছে। ফলে অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ভিক্ষা ছেড়ে দিয়ে আয়বর্ধকমূলক কাজের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতা প্রয়োজন।
লেখক-
আজমাল হোসেন মামুন
(উন্নয়নকর্মী এবং সাংবাদিক)
বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি (বিপিকেএস)
দক্ষিণখান, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০।
মোবাইল নং-০১১৯১০৮৯০৭৫ (প্রয়োজনে মিস কল)।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।