তরুণ নামের জয়মুকুট শুধু তাহার, বিপুল যাহার আশা, অটল যাহার সাধনা কবি কাজী নজরুল ইসলাম তখন থাকতেন মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে। তার সাথে থাকতেন আফজাল উল হক, মুজাফফর আহমদ ও আকবর আলী খান।
এই আকবর আলী খান কাজী নজরুল আসার আগে থেকেই এ অফিসে থাকতেন। তার কাজ ছিল পত্রিকার জন্য বিভিন্ন জেলার ছোট ছোট ভৌগলিক বিবরণ লিখে দেওয়া, তিনি প্রাথমিক শ্রেণীর ছাত্রদের জন্য কিছু পাঠ্যবই লেখারও চেষ্টা করেছিলেন।
তার বইগুলোর জন্য কবি নজরুল লিচুচোরসহ বেশ কিছু ছোটদের কবিতাও লিখে দিয়েছিলেন।
আকবর আলী খান কয়েকটি নাটকও লিখেছিলেন এবং এগুলোর মধ্যে ‘ভিশতি বাদশাহ’ ‘বাবর’ মোটামোটি ভাল হয়েছিল। তার বাড়ী ছিল তৎকালের ত্রিপুরা জেলাধীন আজকের কুমিল্লায়, দৌলতপুর গ্রাম্
আকবর আলী খানের স্বভাব চরিত্র নিয়ে সবাই নিন্দা করত। তিনি ছিলেন অসৎ, মিথ্যা বলতেন এবং সেইসাথে বেশ অহংকারীও। কবি নজরুলের প্রতিভা দেখে তিনিও ভিতরে ভিতরে ফন্দি আঁটছিলেন কীভাবে কবিকে বাগে আনা যায়। খেয়ালীমনা নজরুল কি আর অতশত বুঝতেন।
অনাদরে লালিত নজরুল কেউ তাকে বাড়ীতে নিয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ দিলে তখনই তার সাথে রওয়ানা হতেন।
আকবর আলী খানও সুযোগ বুঝে একদিন কবিকে তাদের বাড়ীতে যেতে নিমন্ত্রণ করলেন, কবিও তখনই সম্মতি দিলেন। শুধু কি সম্মতি, সাথে সাথে রওয়ানাও হলেন তার সাথে। মুজাফফর আহমদ তাকে নিষেধ করছিলেন লোকটির সাথে যেতে, তবু তিনি গেলেন। কারো বারণ না শোনাই তো কবির স্বভাব।
আলী আকবর খানের এক বন্ধু সহপাঠীর নাম ছিল বীরেন্দ্রকুমার। তার বাবা ইন্দ্রকুমার ছিলেন কুমিল্লার কোর্ট সাব ওয়ার্ডসের ইন্সপেক্টর। তারা থাকতেন কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে। বীরেন্দ্রকুমারের মায়ের নাম ছিল বিরজাসুন্দরী দেবী। বীরেন্দ্রকুমারের জ্যেঠিমা গিরিবালা দেবীও তাদের সাথে ওখানে থাকতেন।
গিরিবালা দেবী ছিলেন বিধবা, তার স্বামী বসন্তকুমার সেনগুপ্ত ত্রিপুরা রাজ্যে নায়েবের কাজ করতেন এবং তার মৃত্যুর পরই গিরিবালা দেবী একমাত্র কন্যা প্রমীলাকে নিয়ে ভাইয়ের কাছে কুমিল্লায় চলে আসেন। প্রমীলার ডাক নাম ছিল দুলি। তাদের আসল বাড়ী ছিল ঢাকার মানিকগঞ্জে তেওতা গ্রামে। পুরো পরিবারটির আর্থিক স্বচ্ছলতা তেমন ভালো না হলেও সাহিত্য, সঙ্গীতের একটি আবহাওয়া বিরাজ করতো তাদের পরিবেশে।
মাত্র কিছু সময় অবস্থানকালে কাজী নজরুলও পরিবারটির সাথে মিশে যান এবং আলী আকবর খানের মতো তিনিও বিরজাসুন্দরী দেবীকে মা বলে ডাকা শুরু করলেন।
আকবরের বন্ধু বীরেন্দ্রকে তিনি ডাকতেন ‘রাঙাদা’ বলে। হাসি আর আনন্দে নজরুলও কয়েকদিন আকবর আলীর সাথে এ বাড়ীতে কাটিয়ে তারপর দৌলতপুরে আকবর খানের বাড়ীতে রওয়ানা হলেন।
নজরুলের তখন ভরা যৌবন, তার উপর তিনি কবি। যেনতেন কবি নয়, হাস্যরসে ভরপুর বিপুর প্রতিভার দাদাকবি। প্রমীলাকে কি তার তখন থেকেই একটু একটু ভালো লেগেছিল নাকি পিতৃহীন প্রমীলাকে বিধবা মায়ের সাথে আশ্রিতা দেখে করুণা হয়েছিল, নজরুল গবেষকরা এখানে একেবারে নীরব।
যাই হোক, কাজী নজরুল এখন এসেছেন আকবর আলী খানের বাড়ীতে। কুমিল্লার মুরাদনগরে দৌলতপুর গ্রামে। আকবরের মা ছিলেন সংসারের সর্বময় কর্ত্রী। এমন উচ্ছৃ্খংল নজরুলকে তিনি মায়ের মতো করে আপ্যায়ন করলেন।
আকবরদের বাড়ীর একটু দূরে থাকতেন তারই এক বোন।
তার স্বামীও মৃত। বিধবা এই বোন নজরুলকে দেখতে প্রায়ই তাদের বাড়ীতে আসতেন। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলেটি জাহাজে চাকরী করে, আর মেয়েটির বয়স তখন বিয়েছোঁয়া।
মায়ের সাথে এই মেয়েটিও নজরুলকে দেখতে আসতো।
নাম- সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিস বেগম। চোখে চোখে তখন থেকেই প্রেমের বিনিময় শুরু হল।
এক উদাস দুপুরে নজরুলের বাঁশীর সুর শুনে মেয়েটি গভীর প্রেমে ডুব দেয় নজরুলের। কবির প্রেমতরী খুব শিগগিরই ঘাটে ভিড়লো। আকবর আলী খানের দৌড়াদৌড়িতে তাদের দুজনের বিয়ে স্থির হলো।
হুট করে এভাবে বিয়ে করছে নজরুল, এমন সংবাদে তার বন্ধুরা মোটেও খুশী হলো না।
পবিত্র গঙ্গোপধ্যায় এ খবর পেয়ে একটি চিঠি পাঠালেন নজরুলকে। তিনি লিখেছিলেন, নজরুল, যখন আজ তোর এই চিঠিতে জানলুম যে তুই স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে তাকে বরণ করে নিয়েছিস, তখন অবশ্য আমার কোনো দুঃখ নেই। তবে একটা কথা, তোর বয়স আমাদের চাইতে ঢের কম, অভিজ্ঞতাও। ফিলিংস এর দিকটা তোর অসম্ভব রকম বেশী।
কাজেই ভয় হয় যে হয়তো দুটি জীবনই ব্যর্থ হয়। এ বিষয়ে তুই যদি কনশাস, তাহলে অবশ্য কোন কথা নেই। যৌবনের চাঞ্চল্য আপাত মধূর হলেও ভবিষ্যতে না পস্তাতে হয়। তুই নিজে যদি সব দিক ভেবে চিন্তে বরণ করাই ঠিক করে থাকিস, তাহলে আমি সর্বান্তকরণে তোদের মিলন কামনা করছি। ’’
এ প্রেম ও বিয়েকে কেন্দ্র করে কাজী নজরুল তখন ভাসছিলেন ভাব, উম্মাদনা ও বিচলতার সাগরে।
বন্ধুদেরকে এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, যাকে পেয়েছি সে-ই আমার চিরজনমের হারানো গৃহলক্ষী। এক অচেনা পল্লী বালিকার কাছে এত বিব্রত আর অসাবধান হয়ে পড়েছি যে, যা কখনো কোন নারীর কাছে হইনি। ’’
এ বিয়েকে কেন্দ্র করে আরও কিছু কান্ড করেছিলেন খেয়ালী নজরুল যা তার কোন কোন বন্ধুদের কাছে শোভনীয় মনে হয়নি।
এ বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র তৈরী করেছিলেন কাজী নজরুল। এতে খানিকটা অহমিকার পরিচয় পাওয়া যায়।
যেমন- এ নিমন্ত্রণপত্রে কাজী নজরুলকে পরিচয় দেয়া হয়েছিল ‘মুসলিম রবীন্দ্রনাথ’ বলে আর তার পিতা মরহুম হাজী ফকীর আহমদকে পরিচয় দেয়া হয়েছিল ‘চুরুলিয়ার আয়ামাদার’ বলে।
নজরুলের অনুরোধে তার বিয়ের খবর ছাপা হয়েছিল মোহাম্মদী পত্রিকায়। ফলে সবার মাঝে তা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। আরেকটি পত্রিকা ‘বাঙালী’ তেও ‘অপূর্ব নিমন্ত্রণপত্র’ নামে এটি ছাপা হয়েছিল।
কবির বন্ধু মুজাফফর আহমদ এসব কান্ড দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন নজরুলকে নিয়ে।
১৯২১ সালের ২৬ জুন প্রেরিত অত্যন্ত গোপনীয় এক চিঠিতে তিনি কাজী নজরুলকে লিখেছিলেন, নিমন্ত্রণ পত্রের ভাষা দু এক জায়গায় বড় অসংযত হইয়াছে। একটু কেমন যেন দাম্ভিকতা প্রকাশ পাইয়াছে। আপনার হাত দিয়ে অমন লেখা বাহির হওয়া কিছুতেই ঠিক হয়নাই। আমার ভয় হয়, খান সাহেবের সংস্রবে থাকিয়া আপনিও আবার না দাম্ভিক হইয়া যান। ”
বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক হয়েছিল ৩ আষাঢ় ১৩২৮, ১৮ জুন ১৯২১ ইং।
বিয়ের সব দাওয়াতপত্র বিলি করা হয়েছিল।
কলকাতা থেকে তখন ট্রেন ও লঞ্চের ধর্মঘট চলছিল, কাজেই কলকাতা থেকে তার কোন বন্ধু বান্ধব এ বিয়েতে আসতে পারেনি।
বিয়ের দাওয়াত পেয়ে কুমিল্লা থেকে বীরেন্দ্রকুমারের পরিবার থেকে তার মা বিরজাসুন্দরী দেবীসহ দশজন অতিথি এসে পৌঁছান ২রা আষাঢ়।
কিন্তু এদিকে বিয়ে যতই ঘনিয়ে আসছে, আকবর আলী খান ও নার্গিসের ব্যবহারে কেমন যেন অহংকারী মনোভাব স্পষ্ট হতে লাগল। তাদের কোন কোন ব্যবহারে নজরুল বেশ অপমানিত হলেন ঘরে।
আলী আকবর খাঁ চাচ্ছিলেন যে কোনোভাবেই কবিকে করায়ত্ব করতে। তাই মনে মনে ফন্দি এঁটেছিলেন দরিদ্র ভগ্নির সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে কবিকে বিয়ে দিয়ে চিরদিনের মতো তাকে হাত করতে। এ কাজে তিনি অনেকটা সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু অতিরিক্ত খেলে যেমন বদ হজম হয়, বেশি চিপলে লেবু যেমন তেতো হয়, তেমনি অল্পতেই সম্পর্কটা খুবই তেতো করে ফেলেন।
কবির জীবনে কোনো লাম্পট্য ছিল না।
প্রেম-ভালোবাসায় তিনি ছিলেন ভরপুর। মাস খানেকের মধ্যে কবির সঙ্গে সৈয়দা খাতুনের (কবির দেয়া নাম নার্গিস) বিয়ে স্থির হয়। কবি তখনকার দিনে সাহিত্যের জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র আর নার্গিস গ্রামের একেবারে লেখাপড়া না জানা সাধারণ মেয়ে।
তাই অতি চালাক আলী আকবর খাঁ কবিকে তার পছন্দের মেয়ে নার্গিসকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলার সুযোগ না দিয়ে নিজেই তাকে কবির জন্য উপযুক্ত পাত্রী হিসেবে তৈরি করতে রাত-দিন তালিম দিতে থাকেন। লেখাপড়া, ভালো করে সাজগোছ করা, গানবাজনা এসব আর কী।
আলী আকবর খাঁর ভাগ্নীকে অত যোগ্য বানাবার চেষ্টায় কবি কিছুটা বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। কারণ তিনি জীবনে কখনো কোনো মেকি বা কৃত্রিমতা পছন্দ করতেন না। গ্রামের মেয়ে হিসেবে নার্গিস যা ছিলেন তাতেই তিনি খুশী। কিন্তু প্রকাশক অতিরিক্ত ঘষা-মাজা করতে গিয়ে কবির ভাবীবধূর ছাল-বাকল তুলে ফেলেন।
বিয়ের কাবিননামা লেখতে গিয়ে চতুর পুস্তক প্রকাশক মারাত্মক খামখেয়ালি করে বসেন।
তিনি কাবিননামায় শর্ত জুড়ে দেন, কবি সৈয়দা খাতুন বা নার্গিসের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে মুরাদনগরের দৌলতপুরে বসবাস করবেন। তিনি অন্যত্র গেলেও নার্গিসকে স্ত্রী হিসেবে দৌলতপুরের বাইরে নিতে পারবেন না। এমনিতেই কবি ছিলেন বিপ্লবী স্বাধীনচেতা মানুষ। বিয়ে করে স্ত্রীর সঙ্গে ঘরজামাইয়ের মতো দৌলতপুরে বসবাস করতে হবে, তিনি বাইরে গেলেও স্ত্রীকে কোথাও নিতে পারবেন না এমন পূর্বশর্ত দেখে তিনি বিগড়ে যান। প্রকাশকের ফন্দি ছিল তাকে নিজের করায়ত্বে রাখা।
আর কবি ছিলেন মুক্ত বিহঙ্গ। সেখানেই বিবাদের সূত্রপাত। ’’
বিয়ের অতিথি হয়ে আসা বিরজাসুন্দরী দেবীকে তিনি সব খুলে বললেন। এসব শুনে বিরজাসুন্দরী তাকে এ বিয়ে করতে নিষেধ করলেন।
কিন্তু বিয়ের তারিখ তো আগামীকাল।
অতিথিরাও চলে আসছেন।
এখন কী করা? বাধ্য হয়ে কবি বিয়ের আকদ মজলিসে গেলেন। যথারীতি আক্দ হল।
কিন্তু তারপর এল বাসর রাত। অপমানিত নজরুল অভিমানী নজরুল কী করলেন সে রাতে?
তার ২য় বিয়ে এবং এর ঘটক কে ছিলেন? এসব নিয়ে থাকছে পরবর্তী পর্বে........................
আগের পর্বগুলো--- যারা পড়েননি -- তাদের জন্য
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।