আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কয়েকজন..................

অন্ধকার রাজপথ,কয়েকটা রিক্সা রাস্তার পাশে ছড়ানো- ছিটানো। হুডের নিচে রিকশাওয়ালারা জড়সড় হয়ে ঘুমাচ্ছে। রাত পৌনে দুইটা বাজতেই কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে চারদিক। আকাশে দ্বাদশীর সাদা ধবধবে চাঁদ আর হলুদ সোডিয়াম লাইট ছাড়া সবাই গহীন ঘুমে আড়ষ্ট। নির্জন রাস্তার বুকে ঢেউ তুলে হঠাৎ - হঠাৎ একটা করে অ্যাম্বুলেঞ্চ যাচ্ছে।

এর মধ্যে ফুটপাথ ধরে হনহন করে হাঁটছে আবীর। হল থেকে তাড়াহুড়ো করে বের হবার সময় লাইটার নেওয়া হয়নি। এখন শুধু মুখে সিগারেট নিয়ে হাঁটছে । নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে তার। এর মধ্যে কোথা থেকে জুটেছে একটা কুকুর।

সেই হলের গেট থেকে পিছু নিয়েছে। মেজাজটা এমন খারাপ, ইচ্ছা করছে কুকুরটার পচ্ছাৎদেশে কষিয়ে একটা লাথি দেয়। কুকুরটাও আবীরের মনঃভাব বুঝতে পেরে তার সাথে কানামাছি খেলা শুরু করেছে। আবীর যখন হাঁটতে হাঁটতে থেমে যায়, কুকুরটাও অম্নি গোয়েন্দা উপন্যাসের টিকটিকির মত সম্ভ্রমে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে যায়। হাঁটতে শুরু করলে, কুকুরটাও আবার পিছু নেয়।

কি এক যন্ত্রণার মধ্যে পড়া গেল। আথচ কয়েক ঘণ্টা আগেও সে ছিল অন্য রকম। কোন দুশ্চিন্তা ছিল না। সিয়াম আর ফাহিমকে নিয়ে ঠাঠারী বাজার স্টারে গিয়ে কব্জি ডুবিয়ে মুরগী – মসল্লম খেয়েছে। আকাশে দ্বাদশীর চাঁদের দিকে তাকিয়ে জ্যোছনা গিলেছে।

সবকিছুই ছিল বাঁধনছাড়া বকসি বাজার মোড় পার হয়ে বামে যাওয়ার পর কুকুরটা সামনে যেতে আপত্তি প্রকাশ করল,ঘেউ ঘেউ করে। অতঃপর আবার যে পথে এসেছিল সেই পথে ফিরে গেল। ঢাকা মেডিকেলের জরুরী বিভাগের সামনে গিয়ে মনে পড়ল কত নম্বর ওয়ার্ডে দেবু আছে জানা নেই। নাজমুল ভাইকে ফোন দেওয়া দরকার। প্যান্টের পকেটে হাত দিতেই মোবাইলটা ভাইব্রেট করা শুরু করল।

প্রমা ফোন করেছে। কিন্তু আবীর যন্ত্রের কান্না বন্ধ করে মানুষের কান্না দেখতে দেখতে বিষণ্ণ মনে ওয়ার্ডে ঢুকে পড়ল। ভিতরে দেবুকে পেতে কোন সমস্যা হল না। নাজমুল ভাই এক হাজার টাকা দিয়ে একটা বেড দখল নিয়েছেন। দেবু আপাতত বেডের দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে।

এই অবস্থায় দেবুকে দেখে মনটা শুকিয়ে গেল। মনে হল, “সুবিশাল এক হস্তি শাবক সুউচ্চ পর্বত হইতে খাদে পড়িয়া কুঁ কুঁ শব্দ করিতেছে” । - নাজমুল ভাই, দেবুর অবস্থা এখন কেমন? - আরে মিয়াঁ, ডাক্তার তো কইল কিছুই হয় নাই। রাতে কি না কি খাইছে, এখন সামান্য পেটে ব্যাথা। এই লইয়া কি হুলুস্থুল কাণ্ড-কারখানা।

আমার পুরা টাকাই পানিতে গেছে। - দেবুর বাসায় জানান হয়েছে? - হ, ওর বড় ভাই আইছে। দেবুর এক হাজার টাকার বেডের পাশে বসে ঝিমুচ্ছিলেন রিপন ভাই। দেবুর বড় ভাই। তার হাতে একটা খবরের কাগজ।

তাই দিয়ে উনি দেবুকে বাতাস করছেন। এরই মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে একটা হরলিক্স ও একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল হাতে প্রশ্নবাজ ফাহিম উপস্থিত। আবীরের বন্ধুদের মধ্যে ফাহিমের অন্য আর একটা উপাধি আছে। ঘটনাটা এরকম, একদিন ল্যাব রিপোর্টে ফাহিম GRAPH লিখতে GAPH লিখে ফেলে। রিপোর্ট নিয়ে অনেকক্ষণ গবেষণা করেও সে স্যারের সামনে ‘ R ’ খুঁজে পায় না।

তখন সে বন্ধু পরিষদে GRRAPH সামনে নিয়ে শপথ নিয়েছিল, তার বাকি জীবন সে একটা ‘R’ এর জায়গায় সবসময় দুইটা ‘R’ লিখবে। একটা মিস হয়ে গেলেও অন্যটা যেন থাকে। তারপর থেকেই তার নিক হয়ে গেল ‘গাব’। তামাম দুনিয়ায় যা কিছু আছে সবকিছুতেই তার সলজ্জ আগ্রহ। সলজ্জ বলার কারণ হল, যখন সে কিছু জানতে চায়, তখন তার এমন অবস্থা হয় যেন সে এক মহাজাগতিক পাপ করে ফেলেছে।

একমাত্র উত্তরদাতাই তাকে নির্ঘাত নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারবে। এই মুহূর্তে আবীরের উপরি বর্তাল সেই মহাদায়িত্বভার। ফাহিম তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে জিজ্ঞস করল “হাসপাতালে ঢোকার রাস্তার দুপাশটা দেখেছিস”। আবীর মনেমনে অনেক চিন্তা করেও রাস্তার বিশেষত্ব খুঁজে পেল না। আবিরকে ইতঃস্থত দেখে ফাহিম বলল, “তুই দেবদারু গাছগুলো খেয়াল করিস নি।

রাস্তের একদিকের গাছগুলো একদম সোজা হয়ে ডালপালা বাতাসে ভাসিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর অন্যপাশের গাছগুলোতে ডালগুলো কেমন নুয়ে আছে। একটা ডালও দেখলাম না হাওয়ায় ভাসতে”। মুখে গম্ভীর ভাব এনে আবীর বলল “আমার মনে হয় সব কিছু ঠিক আছে। একপাশের গাছগুলোর মন খারাপ তাই তারা হাসছে।

আর অন্যগুলো কাঁদছে। তবে তুই একটা কাজ করতে পারিস। গাছগুলোর একটা নাম দিয়ে দে। তাতে সব গাছগুলো খুশি হবে”। “কি নাম দেওয়া যায় বলত”পুরা চেহারার মধ্যে একটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টি এনে ফাহিম জানতে চাইল।

“একপাশের গাছগুলোর নাম নিরু, অন্যগুলোর নাম আশ্রু ”; আবীরের কথা শুনে ফাহিমের চেহারায় একটা ঝিলিক দেখা গেল। যদিও খুশি হওয়ার তেমন কোন কারণ নেই। নিতান্ত অল্পতেই খুশি হওয়া তার একটা মহামানবীয় গুণ। ফাহিমের সাথে কথা বলতে বলতে প্রমা এসে হাজির। প্রমা আবীরের স্কুলের বন্ধু।

ওরা একই সেকশনে ছিল। এখন মেডিকেলে পড়ে। স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে প্রমা আর প্রিতমের সাথেই আবীরের এখনও যোগাযোগ আছে। আবীরের সেইসব দিনের কথা মনে পড়ে। যখন প্রতি টার্মের শুরুতে ক্লাস টিচার তাদের রুমে ডেকে নিয়ে গিয়ে টেবিলের উপর রেজাল্ট কার্ড ছুড়ে দিয়ে তাঁর অমর বাণী খানা শোনাতেন “পঁচা,গন্ধ, শরম লাগে না”।

ঐ সময় ওদের শরম লাগত না। প্রমা ক্লাসে গিয়েই তাঁর প্রতিভা বিকাশে ব্যাস্ত হয়ে পড়ত। ক্লাস নোটকে ক্যানভাসে রূপ দিয়ে ভিঞ্চি হওয়ার পথে অনেক দূর এগিয়েছিল। যখন সে সব স্যার-ম্যাডামের মোনালিসা টাইপ কার্টুন আঁকা শেষ করে তখন ঘটা তাকে মাদাম ভিঞ্চি উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। এখন প্রমার চেহারায় ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গেল ভাব।

বাইরে ভোরের আলো দেখা যাচ্ছে। কাকগুলো জানান দিচ্ছে একটু পর পর। ফাহিম প্রমার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে। মনে হচ্ছে রূমের ছাদটা অনেক উপরে নীল আকাশের সাথে মিশে গেছে। এভাবে অনন্তকাল অতিবাহিত হয়ে গেল।

নিলাম্বরীও ফাহিম সমীকরণ সমাধানে ব্যাস্ত। মাঝখান থেকে বিরস আবীরের ধাক্কায় ফাহিম সম্বিত ফিরে ফেল। এরপর আবীর আর ফাহিম হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পড়ল। যাওয়ার পথে আবার দেখা হল দেবদারু গাছগুলোর সাথে। ভোরের রুপালী আলোয় দুজন গাছগুলোর সামনে থমকে দাঁড়াল।

ফাহিম বুঝতে পারে আজ রাত অনেক কিছু বদলে দিয়েছে। জীবনের বসন্ত বেলায় সবকিছু অংকের মত ঘটতে থাকে। সহজ অংক নয়, অতি জটিল ডিফারেন্সিয়াল সমীকরণ। কারণ এ সময় সবকিছু স্থির মানের মত। চারদিকের পরিবর্তন জীবনে কোন প্রভাব ফেলে না।

ভাললাগা,মন্দলাগা সবকিছুই একান্ত নিজের। কোনকিছুই নিয়ন্ত্রিত হতে চায় না। তাইতো চারপাশে তাকালে আমরা তারুণ্যের এত রঙ দেখতে পাই। ফাহিমের জীবনেও রঙ লেগেছে, এই রঙ দেখা যায় না, দৃষ্টি সীমার বাইরে। কবির কথাগুলো তাই বারবার ফিরেএসে.......... “প্রজাপতির পাখা রঙ্গিণ স্বপ্ন আঁকা, যায় সে দূরে নিয়ে , আমার মনের খাঁচার পাখি।

” ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.