চোখ কেড়েছে চোখ ,উড়িয়ে দিলাম ঝরা পাতার শোক...।
অনেকদিন থেকেই ভাবছিলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভিনদেশী বন্ধুদের অবদান নিয়ে কিছু একটা লিখবো । শুরু করতে পারছিলাম না । আসলে পড়তে খুব ভাললাগে , কিন্তু লেখক হিসেবে আমি বেশ আলসে । প্রমাণ '' আমার ভারত ভ্রমণ '' সিরিজ ।
এখনও শেষ করতে পারিনি ।
যাই হোক ,
আজ ২৬শে মার্চ । আমাদের প্রচণ্ড গৌরব আর অহংকারের দিনগুলোর মাঝে একটি । সকালে ঘুম ভেঙ্গেই মনে হল ,মুক্তিযুদ্ধের কিছু নিয়ে লেখা শুরু করার জন্য স্বাধীনতা দিবসের থেকে ভালো দিন আর হয় না । ব্যাস ... কম্পিউটার অন , হিজিবিজি আঁকা স্টার্ট ।
শুরুটা হোক এক চলচ্চিত্র পরিচালক কে নিয়ে । একে একে আরও অনেকের কথাই লেখার ইচ্ছা আছে । কতটুকু যেতে পারবো জানিনা । পাশে থাকবেন এবং ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করছি
লিয়ার লেভিন
জন্ম ঃ ১০ নভেম্বর ,১৯৪০
লিয়ার লেভিন একজন মাকির্ন চলচ্চিত্র পরিচালক ও আলোকচিত্র শিল্পী এবং টিভি সাংবাদিক।
তিনি প্রথমবার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশে ছুটে এসেছিলেন ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর ।
তখন তিনি ঘূর্ণি-উপদ্রুত মানুষকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন যা দুর্গতদের সাহায্যে তহবিল সংগ্রহে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল।
এরপর ১৯৭১ সালে এদেশের মানুষের ওপর পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর অত্যাচার নির্যাতনের বার্তায় ব্যথিত হয়ে পুনরায় বাংলাদেশে আসেন। মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত এবং ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী লাখ লাখ শরণার্থীর দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে তিনি প্রামাণ্যচিত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেন।
ক্যামেরায় ব্যস্ত লেভিন
বাংলাদেশকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের আগ্রহ সম্পর্কে ''ভয়েস অফ আমেরিকা''-র এক সাক্ষাৎকারে লিয়ার লেভিন বলেন-
''১৯৭০ সালের সাইক্লোনকে কেন্দ্র করে আমি যে তথ্যচিত্রটি তৈরি করি, তার মাধ্যমে ঘুর্ণিঝড়ে দুর্গত লোকজনের সাহায্যের জন্যে চাঁদা তোলা হয় । আমার স্ত্রীও এতে যুক্ত ছিলেন।
''
আমেরিকায় সে একটা সময় যাচ্ছিল যখন মানুষ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষের দুঃখ দুর্দশা মোচনের ব্যাপারে উদগ্রীব ছিল । তাই ১৯৭১ এ ও তিনি আবার ছবি তৈরির পরিকল্পনা করেন, উদ্দেশ্য ছিল যারা তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিদের বর্বরতার শিকার হয়েছে , তাদের সাহায্য করা। বিশেষত শরনার্থিদের সাহায্যে অর্থ সংগ্রহ করা।
তিনি তখন তার কোম্পানি বন্ধ করে কিছু অর্থ নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন । লিয়ার লেভিন প্রায় ছয় সপ্তাহ পশ্চিম বাংলায় থেকে বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ও যুদ্ধফ্রন্টের ছবি তোলেন ।
' বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা ' নামক একটি দল তখন সারাদেশ ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের দেশাত্মবোধক ও সংগ্রামী গান শুনিয়ে উজ্জীবিত করতেন । লেভিন জুড়ে যান এদের সাথে । তাদের সঙ্গে ট্রাকে করে ঘুরে বেড়ান । তখন পরিকল্পনা ছিল , তাদের গানের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গল্প এবং মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার আগে তখনকার পুর্ব পাকিস্তানের অবস্থার কথা শোনানো হবে । এর সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সহিংসতার কথাও বলা হবে ।
এভাবে তিনি প্রায় ২২ ঘণ্টার ফুটেজ সংগ্রহ করেন । পরে সেই ফুটেজ নিয়ে তিনি ‘জয় বাংলা’ নামে ৭২ মিনিটের একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন । কিন্তু আর্থিক সহায়তার অভাবে তা আর মুক্তির আলো দেখেনি ।
দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময়ের পর বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও তাঁর স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ লিয়ার লেভিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর তোলা ফুটেজগুলো সংগ্রহ করেন । যেগুলো পরবর্তীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ছবি নির্মাণে এক নতুন অধ্যায় তৈরি করে ।
তারেক মাসুদ ও ক্যাথেরিন মাসুদের সঙ্গে
তারেক মাসুদের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে লিয়ার লেভিন বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সঙ্গীতদলের একজন সদস্য ছিলেন মাহমুদুর রহমান বেণু । যিনি ঐ সময়ে আমার ধারণ করা চিত্রের মূল ব্যক্তি ছিলেন । তিনি আবার তারেক মাসুদের চাচাতো ভাই । তাঁর এবং অন্যান্যদের মাধ্যমেই তারেক তাকে নিউ ইয়র্কে খুজে বের করেন এবং ঐ ফুটেজগুলো চান ।
লিয়ার লেভিন কিছুটা বিস্মিতই হয়েছিলেন , বুঝতে পারেননি কি বলবেন ।
যদিও ঐ ফুটেজ প্রায় কুড়ি বছর ধরে আপার ম্যানহাটানে তার কাছে পড়েই ছিল ।
তারেকের স্ত্রী ক্যাথেরিন , একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন । তিনি ও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেন ।
আর এরা দু জন রীতিমতো এমনই লেগে রইলেন এ ব্যাপারে যে শেষ পর্যন্ত লিয়ার বললেন - '' ঠিক আছে আপনারা এটি নিন । তবে নিশ্চিত করুন যে, আপনারা একটা খুব ভাল ফিল্ম ল্যাবেরেটরিতে এটা প্রসেস করবেন ।
কারণ আমি জীবনের ঝুকিঁ নিয়ে এই চিত্রায়ন করেছি । ''
১৬ মি মি এ তোলা এই ছবিটি বস্তুত সুপার সিক্সিটিন পর্যায়ের এবং এর প্রাযৌক্তিক মান ছিল ব্যতিক্রম ধর্মী । তাই এর মান রক্ষা করা এবং ছবিটি যে লিয়ার লেভিনই তুলেছেন সেটা নিশ্চিত করতে তারেক মাসুদকে তিনি বিশেষভাবে বলেন । তবে এর বিনিময়ে তিনি কিছুই চাননি ।
ফুটেজ হস্তান্তর করার পরও তিনি তারেক দম্পতির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন ।
তাঁরা লিয়ার লেভিনের ফুটেজকে নবরূপায়ণ উদ্দেশ্যে কাজ শুরু করেন ।
কথা হলো ক্যাথারিন সম্পাদনা করবেন , তারেক ও থাকবেন তাঁর সঙ্গে এবং ঐ ফুটেজকে কেন্দ্র করে তাঁরা একটি কাহিনী নির্মাণ করলেন যেখানে , যুদ্ধ এবং তার আগের ঘটনায় তাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটলো । এরপর তারা চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ শুরু করলেন , লেভিনের আশির্বাদ নিয়েই । মাঝে মাঝেই ঐ নির্মীয়মান ছবির অংশ বিশেষ তারেক লেভিনকে দেখাতেন ।
লেভিনের বানানো ৭২ মিনিটের 'জয় বাংলা' মুক্তির মুখ না দেখলেও তারেক মাসুদের হাতে সম্পাদিত হয়ে তা 'মুক্তির গান' শিরোনামে আত্মপ্রকাশ করে ।
'মুক্তির গান' চলচিত্রের একটি দৃশ্য
লিয়ার লেভিন বলছেন , ঐ ফুটেজ নিয়ে তিনি তো আর কিছু করতে পারেননি , ওগুলোর ওপর কেবল ধূলো জমছিল । তারেক আর ক্যাথারিন যে ঐ ফুটেজ কাজে লাগাতে পেরেছেন , সেটা মস্ত বড় কথা এবং সে জন্যে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ ।
তারেক মাসুদ ' চলচিত্র যাত্রা ' নামক নিবন্ধ সংকলনে 'লিয়ার লেভিন-আমাদের মুক্তির সারথি ' শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ।
সেখানে তিনি উল্লেখ করেন '' শুধু লিয়ার লেভিনের ফুটেজ নয় । 'মুক্তির গান' এর জন্য আমরা যুক্তরাষ্ট্র , কানাডা ,ইংল্যান্ড , ফ্রান্স , ভারত সহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর ফুটেজ সংগ্রহ করেছি ।
তবে সেগুলো দেখে মনে হয়েছে , লিয়ারের কাজের সামনে লাখো ঘণ্টার ফুটেজও কিছুনা । তাঁর ফুটেজ ও সহযোগিতায় ' 'মুক্তির গান' এর অস্থিমজ্জা দাঁড়িয়েছে । ''
তারেক মাসুদ ''মুক্তির গান'' ছবিটির উপর ভিত্তি করে এর একটা সিকুয়েল ছবিও তৈরি করেছিলেন - ''মুক্তির কথা'' ।
ছবিটি লেভিন দেখেননি । কিন্তু পরে মুক্তিযুদ্ধের শিল্পীদের সঙ্গে দেখা করার জন্য তিনি বাংলাদেশে আসলে তারেক, তাকে এবং তার স্ত্রীকে মুড়াপাড়ায় নিয়ে যান ।
মুক্তির গান দেখে সেখানকার মানুষের চোখে মুখে , তাদের কথায় তিনি যে আবেগের সন্ধান পান সেটা তাকেও আবেগ তাড়িত করেছিল ;
লিয়ার লেভিন যে কেবল চলচ্চিত্রের জন্যে ছবি তুলেছেন তাই-ই নয় । বাংলাদেশের প্রকৃতিতে মুগ্ধ এই প্রতিভাবান ব্যক্তি স্থির চিত্রও তুলেছেন প্রচুর । তিনি বলেন যে, তার করার তেমন কিছুই ছিল না । প্রকৃতিতে সব উপস্থিত, তিনি শুধু ক্যামেরাটা অন করেছিলেন --
'' বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দৃশ্য অসাধারণ । কৃষক মাঠে চাষ করছে , তার ঘামে ভেজা শরীরে - বাহুতে সূর্যের আলো ঢলে পড়ছে কিংবা চাষের বলদ লাঙ্গল টানছে ।
এ সব দৃশ্য এক অর্থে রোমান্টিকও বটে । মানুষের সৌন্দর্য , ভুমির ঐশ্বর্য , অপার শান্তি এবং পরিবেশ থেকে নেয়া অন্তর্নিহিত শক্তি ... প্রকৃতির দৃশ্যের মধ্যেই যেন সব কিছু ছিল । ভাবতে অবাক লাগে যে, সে সব দৃশ্যই যুদ্ধে হলো বিক্ষত !''
সম্প্রতি এই ভিনদেশী সফর করলেন বাংলাদেশ । অকৃত্রিম এই বন্ধুকে বিশেষ সম্মাননা জানানোর মাধ্যমে তার অসীম অবদানকে যেন আবার গর্বের সঙ্গে স্মরণ করল বাংলাদেশ । মানুষের ভালোবাসায় নিজের আবেগকেও ধরে রাখতে পারলেন না লিয়ার লেভিন।
এ দেশের মানুষের হৃদয়ের উষ্ণতায় তিনি বারবার আবেগাপ্লুত হন ।
গর্বের সঙ্গেই বললেন- ''আমি গর্ববোধ করছি যে আমি একটি জাতির জন্মক্ষণের সাক্ষী হতে পেরেছি । ''
বিদেশী বন্ধুদের সম্মাননা জানানোর অনুষ্ঠানে লিয়ার লেভিন ( মধ্য সারির ডানদিক থেকে প্রথম )
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর বাঙালির কথা, সংগ্রামের কথা স্মরণ করে তিনি আরো বলেন- '' বাঙালিদের এই লড়াই আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে । ৭১-এর সেই সময়কে চাক্ষুষ দেখতে পাচ্ছি । আমার মনে পড়ছে এই শিল্পীরা সেসময় কিরকম অসম সাহসের সঙ্গে রণাঙ্গন থেকে রণাঙ্গনে ছুটে বেড়িয়েছেন ।
আজও ঘুমের মধ্যে সেই সব বীর যোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলি । তারা আমার ভাষা না জেনেই কিভাবে সাহায্য করেছে এবং একই সঙ্গে যুদ্ধ করেছে । তাদের এ ভালোবাসাই আমাকে সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে কাজ করতে সাহায্য করেছিল । ''
মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য লিয়ার লেভিন এক ইতিহাস । মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের জীবনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েও তিনি ধরে রেখেছেন মুক্তিযুদ্ধের বিরল সব চিত্র ।
তার তোলা ফুটেজ থেকেই নির্মিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রামান্য দলিল হিসাবে বিবেচিত চলচিত্র ‘মুক্তির গান’ । তার ঋণ কেনো দিনই শোধ করতে পারবে না বাংলাদেশ ।
তবে আমি গর্বিত আমরা তাকে সম্মাননা দিতে পেরেছি । আমাদের ভালবাসা জানাতে পেরেছি ।
আজ এটুকুই থাক ।
সবাইকে স্বাধীনতা দিবসের অনেক অনেক শুভেচ্ছা ।
( নতুন নতুন ফটোশপ নিয়ে নাড়াচাড়া করছি । আমার অপটু হাতের কাজ )
তথ্যসূত্র -->
- উইকিপিডিয়া
- ভয়েস অফ আমেরিকা
- বিভিন্ন সংবাদপত্র ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।