আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিশ্বব্যাপী আবহাওয়ার হেঁয়ালি আচরণ : ঋতু কি হারিয়ে যাচ্ছে ?

সবাইকে দ্রব্যমূল্যের উষ্ণ শুভেচ্ছা আলাউদ্দিন আরিফ আবহাওয়ার হেঁয়ালি আচরণে বাংলাদেশে দিনে দিনে বদলে যাচ্ছে ঋতুচক্র। পঞ্জিকার পাতায় ৬টি থাকলেও অনেকের মতে এখন ঋতু দৃশ্যমান ৩টিতে। কেউ কেউ বলছেন গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত—এ তিন ঋতুর মধ্যে হারিয়ে যেতে বসেছে বসন্ত, শরৎ ও হেমন্ত। এখন শরতের আবহাওয়া মনে হয় বর্ষার মতো। হেমন্ত ও বসন্ত যেন মিশে যাচ্ছে শীত ও গ্রীষ্মের মধ্যে।

বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিক বৃষ্টি হয় না। সময়মত মৌসুমি বায়ুর দেখা মেলে না। শুধু বাংলাদেশেই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হেঁয়ালি আচরণ চলছে বিশ্ব আবহাওয়াতেও। বিশ্বের এক অঞ্চলে দেখা দিচ্ছে অস্বাভাবিক খরা, অন্য অঞ্চলে অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে ভয়াবহ বন্যা, জলাবদ্ধতা। কোথাও ঘূর্ণিঝড় কোথাও সাইক্লোন।

কোনো এলাকায় প্রচণ্ড শীতের সঙ্গে পড়ছে মাত্রাতিরিক্ত বরফ; কোনো কোনো এলাকা হয়ে যাচ্ছে মরুভূমি। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে মানুষের জীবন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃতির নিয়মেই আবহাওয়ায় ক্রম বিবর্তন আসছে। এর সঙ্গে সব ক্ষতিকর কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে মানুষের সৃষ্ট নানা উপসর্গ। বেশ কয়েক বছর ধরেই আবহাওয়ার হেয়ালি আচরণ চলে আসছে।

চলতি বছরেও বাংলাদেশের আবহাওয়া বেশ ব্যতিক্রম আচরণ করছে। আশ্বিন মাসেও কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে। প্রতিদিন বৃষ্টি হচ্ছে। অনেকের মতে, বইপত্রে বাংলাদেশকে ৬ ঋতুর দেশ বলা হলেও এখন আসলে তা নেমে এসেছে ৩টিতে। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত।

কেউ কেউবলছেন ঋতু এখন ৪টি। তবে আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ এসব কথা মানতে নারাজ। তারা বলছেন, বাংলাদেশে ৬ ঋতু নির্ধারিত হয়েছে আবহাওয়ার নৈসর্গিক দৃশ্যমান আচরণ, ফসল লাগানো ও তোলা—এসবের ওপর ভিত্তি করে। তাদের মতে এখনও প্রকৃতিতে ৬ ঋতুর অবস্থান পরিষ্কার এবং মানুষ সেটা উপলব্ধি করে। পঞ্জিকার পাতা ধরে স্বাভাবিক নিয়মেই ঋতু আসে, ঋতু যায়।

আবহাওয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে দেশে ৬ ঋতুর কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। আবহাওয়ার শ্রেণীবিন্যাসে সারা বছরকে ভাগ করা হয়েছে ৪টি ঋতুতে। আবহাওয়া অধিদফতরের বিশেষজ্ঞ আবহাওয়াবিদ সাদেকুল আলম বলেন, দেশে ফসলি হিসেবে ৬টি ঋতু ঠিকই আছে। কিন্তু জলবায়ুগত দিক থেকে ঋতু ৪টি। এগুলো প্রাক বর্ষা (প্রি-মনসুন), বর্ষা (মনসুন), বর্ষাউত্তর (পোস্ট মনসুন) ও শীত (উইনটার)।

মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসকে ধরা হয় প্রাক বর্ষা হিসেবে। জুন, জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসকে ধরা হয় মৌসুমি বায়ু বা বর্ষা মৌসুম। অক্টোবর-নভেম্বর বর্ষাউত্তর মৌসুম। ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি শীত মৌসুম। সাদেকুল আলম আমার সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, এ চারটি মৌসুম মিটিওরোলজিক্যাল মাপক যন্ত্রের মাধ্যমে শনাক্ত করা যায়।

এ সময়ে বৃষ্টির হিসাব, তাপমাত্রার তারতম্য—এসবের একটি গড় অবস্থান থাকে। এর বাইরের আবহাওয়ার পরিবর্তনকে মাপক যন্ত্রে শনাক্ত করা যায় না। এগুলো শুধু নিসর্গে দেখা যায় এবং মানুষের সূক্ষ্ম অনুভূতিতে ধরা পড়ে। শহুরে জনপদ বাদে গ্রামীণ জনপদে কখনই মানুষকে বলে দিতে হয় না এখন বর্ষাকাল, এখন শরত্কাল বা হেমন্তকাল। প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ তার সূক্ষ্ম অনুভূতি দিয়ে সেটা উপলব্ধি করে নেয়।

এজন্য পঞ্জিকা দেখার প্রয়োজন হয় না। তাই আমাদের দেশ থেকে দুই বা তিনটি ঋতু হারিয়ে গেছে, বিলুপ্ত হয়ে গেছে সেটা বলা সমীচীন হবে না। সার্ক মিটিওরোলজিক্যাল সেন্টারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সিনিয়র আবহাওয়াবিদ ও গবেষক আমার সঙ্গে আলাপকালে বলেন, পৃথিবীর বয়স বাড়ছে। বাড়ছে জনসংখ্যা। সেই সঙ্গে প্রকৃতির নিয়মেই আবহাওয়ার মধ্যেও পরিবর্তন আসছে।

ক্রমবিবর্তনের ধারায় আমাদের দেশে ঋতুচক্রের মধ্যেও কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। যেমন হেমন্ত মূলত ফসলি ঋতু। কিন্তু এখন দেশের ফসল চাষ ব্যবস্থাতেও আমূল পরিবর্তন এসেছে। প্রজাতি অনুযায়ী সারাবছরই কমবেশি ধান উত্পাদন হচ্ছে। শাকসবজির উত্পাদনেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে।

ফলে নতুন প্রজন্ম বর্ষা, শরত্ ও হেমন্ত আলাদা করে অনুভব করতে পারে না। তিনি আরও বলেন, শুধু আমাদের দেশেই নয়, সারাবিশ্বেই আবহাওয়া তার রুটিন মেনে চলছে না। সুমেরু বা কুমেরু অঞ্চল থেকে শুরু করে সমগ্র বিশ্বে এ পরিবর্তন দৃশ্যমান। মেরু অঞ্চলে বরফের স্তর ক্রমেই কমছে। আবহাওয়ার এ পরিবর্তনের জন্য জনসংখ্যার বৃদ্ধি, নগরায়ন, বায়ু দূষণ, কলকারখানার দূষণ, অতিরিক্ত কার্বন নির্গমন, ফ্রিজ এসির সিএফসি গ্যাস, অ্যারোসলের ব্যবহার বাড়াসহ আরও বহুবিধ কারণ রয়েছে।

এতে ওজোনস্তরে ভয়ানক মাত্রায় ফুটোর সৃষ্টি হচ্ছে—যা আমাদের বড় উদ্বেগের কারণ। অপর একজন আবহাওয়াবিদ আমাকে বলেন, ঢাকায় গত ৫০ বছরে গড় তাপমাত্রা প্রায় এক ডিগ্রি বেড়েছে। বহুতল ভবন ও কলকারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি উষ্ণতা বাড়াচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে প্রকৃতিতেও। এতে আবহাওয়া তার রুটিন মানছে না।

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। আবহাওয়া অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে চলতি অক্টোবর মাসে বৃষ্টি হচ্ছে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। সেপ্টেম্বর মাসে গড় হিসাবের চেয়ে ১৬ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু ওই বৃষ্টি সামগ্রিকভাবে হয়নি। এ মাসে শুধু চট্টগ্রাম বিভাগেই স্বাভাবিকের চেয়ে ৭০ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে।

কিন্তু ঢাকা, সিলেট ও রংপুর বিভাগে স্বাভাবিকের চেয়ে বৃষ্টি হয়েছে অনেক কম। মে মাসে সারাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। জুন মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ দশমিক ১ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক আরজুমান্দ হাবীব আমার সঙেগ আলাপকালে বলেন, আবহাওয়ার রেকর্ডগত দিক থেকে গড়বৃষ্টি রেকর্ড স্বাভাবিকের কাছাকাছি দেখালেও সেটা সমন্বিতভাবে হচ্ছে না। ফলে ওই বৃষ্টি কৃষিতে উপকারে আসছে কম।

এতে দেশের গড় বৃষ্টির পরিমাণ ঠিক থাকলেও কৃষি আবহাওয়ার জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠছে। আবহাওয়াবিদরা বলেন, বিশ্বজুড়েই চলছে আবহাওয়ার হেয়ালি আচরণ। ইউরোপ, আমেরিকা, আর্কটিক, অস্ট্রেলিয়া, চীন থেকে শুরু করে ভারত উপমহাদেশ সর্বত্র আবহাওয়ার হেয়ালি আচরণে জনজীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে। প্রকৃতি ঘটাচ্ছে ছন্দপতন। সম্প্রতি নরওয়ের রাজধানী অসলো থেকে প্রকাশিত ‘দ্য আর্কটিক মনিটরিং অ্যান্ড অ্যাসেসমেন্ট প্রোগ্রাম’ (এএমএপি) নামক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, গত ৬ বছরে সুমেরু অঞ্চলে উষ্ণতা যতটা বেড়েছে তাতে আশঙ্কা করা হচ্ছে ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ দশমিক ৬ মিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।

১৮৮০ সাল থেকে শুরু করে যে কোনো পাঁচ বছরে সুমেরু অঞ্চলের গড় তাপমাত্রা যা ছিল তার চেয়ে ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত হিসাবে সুমেরু অঞ্চলের উষ্ণতা অনেকটা বেড়ে গেছে। গবেষকরা বলেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে সুমেরু অঞ্চলের হিমবাহ ও বরফের উপরিভাগ গলে যাবে। সেই সঙ্গে গ্রিনল্যান্ডের বিশাল বিশাল বরফখণ্ডগুলোও এক সময় বিলীন হয়ে যাবে। এতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে। তারা আরও বলেন, সুমেরু অঞ্চলে তাপমাত্রা যতটা বাড়ছে, বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় তাপমাত্রা বাড়ছে তার দ্বিগুণ হারে।

এমনকি চলতি শরত্ ও আগামী শীতকালে সুমেরু অঞ্চলের তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে। তাদের মতে, এভাবে দীর্ঘদিন চলতে থাকলে ২০৮০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা বেড়ে যাবে ৩ ডিগ্রি থেকে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর সুমেরু অঞ্চল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী—এ শতাব্দীতেই হতে পারে অর্থাত্ আগামী ৩০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যেই গ্রীষ্মকালে এলাকাটি প্রায় বরফশূন্য হয়ে যাবে। ইন্টারনেটে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, বিগত ১০০ বছরের মধ্যে চলতি বছরের এপ্রিল-মে মাসে যুক্তরাজ্যে সবচেয়ে বেশি গরম অনুভূত হয়েছে। সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে যে তাপমাত্রা থাকে চলতি বছর তার চেয়ে তাপমাত্রা ছিল ৩ থেকে ৫ ডিগ্রি বেশি।

এছাড়া এ সময় যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়, এবার হয়েছে তার অর্ধেক। মার্চ-এপ্রিল মাসে গোটা যুক্তরাজ্যে যে পরিমাণ স্বাভাবিক গড় বৃষ্টি হয়, এ মৌসুমে হয়েছে তার অর্ধেক। শীতকালের গড় শুষ্কতার চেয়েও এপ্রিল-মে মাসকে বেশি শুষ্ক দেখা গেছে। তবে বৃষ্টির পরিমাণের দিক থেকে বড় ধরনের বৈচিত্র্য দেখা গেছে। স্কটল্যান্ডে এপ্রিলের সাধারণ বৃষ্টির চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি বৃষ্টি রেকর্ড হয়েছে।

অপরদিকে ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে একই সময়ে স্বাভাবিক বৃষ্টির চেয়ে বৃষ্টি ছিল ১০ শতাংশ কম। জার্মানিতেও এবারের এপ্রিলে ছিল বেশ গরম। একদিকে তাপমাত্রা বাড়ছে, অন্যদিকে বাড়ছে শুষ্কতা। স্বাভাবিক বৃষ্টি হচ্ছে না আমেরিকা ও ইউরোপের অন্যান্য দেশেও। বাড়ছে গরম বা শীতের তীব্রতা।

আবহাওয়া অধিদফতরের একজন আবহাওয়াবিদ আমাকে বলেন, এখন আসলে আবহাওয়া বিশেষ কোনো নিয়মকানুন অনুযায়ী চলছে না। যে সময় গ্রীষ্মকাল আশা করা হচ্ছে সেসময় তা শুরু হচ্ছে না। উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বর্ষা রুটিন মতো হচ্ছে না। এতে পরিবেশ ও প্রতিবেশগত জটিলতা তৈরি হচ্ছে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর। আবহাওয়া ও ঋতুপরিক্রমা স্বাভাবিক রাখার উপায় প্রসঙ্গে সার্ক মিটিওরোলজিক্যাল সেন্টারের আবহাওয়া বিজ্ঞানী সুজিত কুমার দেব শর্মা আমর সঙ্হে আলাপচারিতায় বলেন, প্রকৃতির নিয়ম ও মানুষের সৃষ্ট বহুবিধ কারণে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে।

এ পরিবর্তন কেউ পুরোপুরি ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। খেয়াল রাখতে হবে এ পরিবর্তন যাতে খুব দ্রুত না হয়ে যায়। জলবায়ুর ধীর পরিবর্তন হলে প্রকৃতি ও প্রাণীকুল নিজ থেকেই এতে খাপখাইয়ে নেবে। কিন্তু দ্রুত পরিবর্তন হলে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সবুজায়ন তথা বেশি বেশি গাছ লাগানো উচিত।

সর্বোপরি দূষণ ও জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.