মানবতার গান গেঁয়ে যায়-তারুণ্যের প্রেরণায়
১৭. রুশ গবেষক বনদারেভস্কি তার ‘মুসলিম জনগণের শক্রর স্বরুপ’ বইতে লিখেছেন, এক হাতে বাইবেল আর অন্যহাতে ডলারের হালি নিয়ে মার্কিন উপনিবেশবাদীরা তাদের পশ্চিমা প্রতিযোগিদের মধ্যে এবং মুসলিম শাসকদের মধ্যে বিরোধ বিবাদ জাগিয়ে তোলে, তারা অস্ত্র শস্ত্র বিক্রি করে এবং অস্ত্রের হুমকি প্রদর্শন করে এভাবে তারা অটোমান সাম্রাজ্য, পারস্য উপসাগর, জাঞ্জিরার দ্বীপ ও সুলু দ্বীপ মালায় ঘাঁটি গেড়ে বসার চেষ্টা করে, এটা ছিল মার্কিনীদের প্রথম পর্যায়ের আগ্রাসন মূলক তৎপরতা। যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত চলে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে চাপানের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে মার্কিন আগ্রাসনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে কেন্দ্র করে রুশ, ফরাসী ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট একটি জোট গঠিত হয়, যা মিত্রশক্তি নামে পরিচিত লাভ করে। ১৯৪৫ সালের মাঝামাঝি সময় মিত্রশক্তি যখন ইউরোপের পরাজিত জাতিগুলোর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ নিয়ে ব্যস্ত, তখন মার্কিনীরা এদের অগোচরে জাপানে পারমানবিক বোমা হামলা চালায়।
এই হামলা করা হয় শরীকদের না জানিয়েই। ৬ ও ৯ আগস্টের এই বোমা হামলায় জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসিকা শহর দুটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে লাখ লাখ লোক প্রাণ হারায় ও আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করে। বোমা হামলার ক’দিন পর ১৪ আগস্ট জাপান বিনা শর্তে সে অঞ্চলের মার্কিন সমর অধিনায়ক ডগলাস ম্যাক আর্থারের কাছে আত্মসমর্পন করে। ফলে ম্যাক আর্থার জাপানের ভাগ্য নিয়ন্ত্রা হয়ে যান। অন্য মিত্রদের সেখানে নাক গলানোর কোন সুযোগ ছিল না।
ফলে সেখানে মার্কিন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। একটানা ৬ বছর জাপানকে স্বীয় নিয়ন্ত্রনে রেখে সকল প্রকার শোষন শেষে ১৯৫১ সালে শান্তি চুক্তির নামে জাপানীয়দের মার্কিন অধীনতামূলক এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়। এই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী জাপানের বোনিন ও রিউকু দ্বীপ দু’টিতে মার্কিন নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং জাপানে মার্কিন সেনা ঘাঁটি স্থাপিত হয়। চুক্তির শর্তানুসারে জাপান এখনো শক্তিশালী নিরাপত্তা বাহিনী গঠনের অধিকার থেকে বঞ্চিত।
১৮. ইন্দোচীন ছিল ফ্রান্সের উপনিবেশ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান একে দখল করে নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর একদিকে ইন্দোচীন স্বাধীনতার দাবী তোলে, অন্যদিকে ফ্রান্স সেখানে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ অবস্থায় ইন্দোচীনকে উত্তর ভিয়েতনাম, দক্ষিণ ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওস এই চারটি রাষ্ট্রে ভাগ করা হয়। দক্ষিণ ভিয়েতনামে ফ্রান্সের পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এমতাবস্থায় দক্ষিণ ভিয়েতনামবাসীরা স্বাধীনতার জন্য এবং উত্তর ভিয়েতনামবাসীরা উভয় ভিয়েতনামকে একত্র করার জন্য আন্দোলন শুরু করে।
দক্ষিণ ভিয়েতনামের পুতুল সরকার মার্কিন মদদে সে আন্দোলন দমনের প্রয়াস চালিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর্যায়ে মার্কিনীরা সেখানে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। বিশ্বব্যাপী এর প্রতিবাদ জানান হয়। এমনকি খোদ মার্কিনীরা পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল করে। কিন্তু মার্কিন প্রশাসন সকল প্রকার প্রতিবাদ উপেক্ষা করে সেখানে মার্কিন সৈন্য প্রেরণ করতে থাকে। সর্বমোট পাঁচ লাখ মার্কিন সৈন্য সেখানে জড়ো করা হয়।
তারা ভিয়েতনামের পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করে এবং পাইকারী ভাবে আবাল বৃদ্ধ বনিতা সহ এক কোটিও বেশি মানুষ হত্যা করে। মার্কিনীরা নির্বিচারে বোমা মেরে হাসপাতাল, শিশুদের স্কুল, ধর্মীয় উপাসনালয় ধ্বংস করে। বেসামরিক এলাকায় নাপাম বোমা ফেলে নিরপরাধ নারী-পুরুষকে হত্যা করে। ১৯৬৫ সাল থেকে মোট ৭০ লাখ টনের ও বেশি বোমা ভিয়েতনামে ফেলা হয়; যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত বোমার তিনগুনেরও বেশি । মার্কিন হিসাব মতে, এক লাখ ভিয়েতনামবাসী কেবল এই বোমার আঘাতে আগুনে পুড়ে মারা যায়।
ধ্বংস হয় দু’শ হাসপাতাল ও সাতশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কথিত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঠেকানোর সেই মার্কিনীদের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে মার্কিন হিসাব অনুযায়ী ২৩ লাখ লোক প্রাণ হারায়। অবশ্য আমেরিকাও কম মূল্য দেয়নি। তাদের পাঁচ হাজার বিমান ও প্রায় দু’হাজার হেলিকপ্টার এই যুদ্ধে ধ্বংস হয়। হাজার হাজার মার্কিন সৈন্য প্রাণ হারায়।
এ অবস্থায় বিশ্বব্যাপী ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরুধী প্রতিবাদ তীব্র হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক চাপের কারণে হাজার হাজার মার্কিন সৈন্যের লাশ ভিয়েতনামে রেখে আিেমরকা সে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
১৯. কম্বোডিয়ায় অন্তদ্বন্দের সুযোগে মার্কিন সৈন্য সেখানে প্রবেশ করে এবং মার্কিন বিরুধূদের উপর পাইকারী হত্যাযজ্ঞ চালায়। তারা লাখ লাখ কম্বোডিয়ার জনগণকে হত্যা করে। শেষ পর্যন্ত তারা বিশ্বনিন্দা মাথায় নিয়ে পরাজয়ের গ্লানি মুখে মেখে কম্বোডিয়া ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
২০. কোরিয়াকে বিভক্ত করা এবং উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে যে তিক্ততা, তারও নাটোর গুরু এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাদেরই কলকাঠি নাড়ানোতে কোরিয়ার লাখ লাখ নিরপরাধ মানুষ অকাতরে প্রাণ হারায়। তাদের নিষেধাজ্ঞার কারণে উত্তর কোরিয়ার মানুষকে এখনো সীমাহীন কষ্টের জীবন যাপন করতে হচ্ছে।
২১. ইন্দোনেশিয়ায় কমিউনিষ্ট বিপ্লব ঠেকানোর নামে মার্কিনীরা সেখানে সামরিক অভ্যূথান ঘটিয়ে সুহার্তোকে ক্ষমতায় বসায়। সুহার্তো নিষ্ঠুরতার সাথে মার্কিন বিরুধী হিসাবে পরিচিত লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করে ।
কিন্তু এই মার্কিন পদসেবককে একটি দৃঢ খৃষ্টান রাষ্ট্র হিসাবে পূর্ব তিমুরকে স্বাধীনতা না দেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ অবস্থান নিলে তাকে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসাবে চিহিৃত করে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়ে চলৎশক্তিহীন আব্দুল ওয়াহিদকে ক্ষমতায় বসায়। মার্কিন পদলেহী আব্দুল ওয়াহিদ বিনা বাক্যব্যয়ে পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতা দিয়ে দেন। কিন্তু তারপরও তার শেষ রক্ষা হয়নি। কলার খোসার মত তাকেও ছুঁড়ে ফেলা হয়।
২২. শ্রীলংকায়ও কথিত কমিউনিষ্টদের বিপ্লব ঠেকাতে মার্কিনীরা সেখানে এক সামরিক অভ্যূথান ঘটায়।
এই সামরিক সরকার কমিউনিষ্ট দমনের নামে মূলত নিরপরাদ মার্কিন বিরুধী জনগণকে ব্যাপকভাবে হত্যা করে। এ সময় লাখ লাখ লোক প্রাণ হারায়। এখনও সেখানে তামিল বিদ্রোহ লাগিয়ে রাখা হয়েছে।
২৩. ১৯৫৮ সালে একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে আমেরিকা আইয়ুব খানকে পাকিস্তানের ক্ষমতায় বসায়। কিন্তু আইয়ুব খান স্বাধীন পররাষ্ট নীতি গ্রহণ করলে কৌশলে তাকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য পাক-ভারত যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়া হয়।
আবার পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠির শোষণ থেকে লাভের জন্য আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করার নামে প্রতারকের ভূমিকা পালন করে এবং হানাদার বাহিনীর গণহত্যাকে সমর্থন জানায়।
২৪. সুদান যাতে একটি মুসলিম দেশ হিসাবে টিকে থাকতে না পারে, সেজন্য স্বাধীনতার শুরুতেই সেখানকার খৃস্টানদের বিদ্রোহ করার জন্য উস্কিয়ে দেয়া হয়। নন্দিত সরকার সুদানে ইসলামী আইন চালু করলে মার্কিনীরা বিদ্রোহীদের উস্কে দেয়। কিন্তু তারা মার্কিনীদের আশা পূরণ করতে না পারায় মিথ্যা অজুহাতে সুদানকে একঘরে করে রাখা হচ্ছে। সেখানে এখনো গৃহ যৃদ্ধ চলছে।
এযুদ্ধে প্রায় ১০ লাখ লোক প্রাণ হারায় এবং ৬০ লাখ উদ্বাস্তোতে পরিনত হয়েছে। খৃস্টান বিদ্রোহীদের কাজে লাগিয়ে মুসলিম দেশ সুদান কে দু’ভাগ করে দক্ষিণ সুদান নামে একটি খৃস্টান রাষ্ট্রের জন্ম দেয়া হয়েছে ২০১০ সালে। আর মার্কিন সৃষ্ট গৃহযুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগে হেগের আর্ন্তজাতিক অপরাথ ট্রাইবুনালকে দিয়ে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারির পরওয়ানা জারী করা হয়।
২৫. ইরাক মুসলিম বিশ্বের একটি ক্ষমতাধর রাষ্ট্র। তার আর্থিক ও সামরিক শক্তি মার্কিন-ইসরাঈলের জন্য হুমকি হয়ে দাড়ায়।
মার্কিন মদদে ইসরাঈল একদিন কোন রুপ ঘোষনা ছাড়াই ইরাকের পারমানবিক চুল্লির উপর হামলা চালায় এবং তা ধ্বংস করে দেয়। এরপরও ইরাকের সামরিক শক্তিতে শংকিত মার্কিনীরা ইরাককে ইরানের সাথে যুদ্ধে বাধিঁয়ে দেয়। দীর্ঘ আট বছর এই যুদ্ধ চলার পরও দুটি মুসলিম শক্তি সম্পর্কে শংকামুক্ত হতে না পেরে ইরাককে কুয়েতের প্রতি লেলিয়ে দিয়ে তার সামরিক শক্তি ও স্থাপনা ধ্বংস করার অজুহাত দাড় করায়। কুয়েতমুক্ত করার নামে মার্কিনীরা ইরাকের সকল সামরিক শক্তি ও স্থাপনা ধ্বংস করে। দু’লাখ ইরাকী সৈন্যকে ট্যাংকের নিচে পিষে মারে।
ইরাকের বিরুদ্ধে আর্ন্তজাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরাকের কোটি কোটি শিশু খাদ্য ও ঔষুধের অভাবে মারা যায়। তাছাড়া এ পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার বার বিমান হামলা চালিয়ে ইরাকের হাজার হাজার বেসামরিক লোককে হত্যা করা হয়। আজকে ইরাক আগ্রাসনের কথা সবারই জানা। বিনা যুক্তিতে জাতিসংঘকে পাশ কাটিয়ে বিশ্ব জনমতকে তোয়াক্কা না করে লাখ লাখ মানুষ কে হত্যা করল, ইরাক জীবন্ত কবরস্থানে পরিনত করল, হাজার হাজার বাড়ী ঘর বোমায় উড়িয়ে দিল।
এই সব দস্যুবৃত্তির পক্ষে কি কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে?
চলবে--- ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।