একজন তরুন.. বিশ্ব ভয়াবহ খাদ্য সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। জমি থেকে শুরু করে সাগরের সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার, মুনাফার জন্য হিংস্র পরিকল্পনা বিশ্ব এবং মানবতার জন্য এক মারাত্মক হুমকি তৈরি করেছে । কিন্তু মুনাফার জন্য পুঁজিবাদী খাদ্য উৎপাদনে নিয়ন্ত্রণ এবং বিপনন ব্যবস্থা সারা বিশ্বের মানুষের জন্য নতুন ধরনের এবং আরো বড় ধরনের বিপর্যয় তৈরি করছে। এরই ধারাবাহিকতায় আফ্রিকা এবং বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে ভূমি দখল অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।
উপনিবেশিক আমল থেকেই আফ্রিকা হচ্ছে সেই অঞ্চল যেখান থেকে লক্ষ লক্ষ্ লোক কে দাস ব্যবসার জন্য অপহরণ করা হয়েছিল, দমিয়ে রাখা হয়েছিল এবং নিপিড়ন করা হয়েছিল।
আফ্রিকা মহাদেশের সম্পদ শতাব্দির পর শতাব্দি বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্র দ্বারা লুণ্ঠিত হয়েছে এবং সম্পদের নিজেদের দখল টিকিয়ে রাখতে অনেক যুদ্ধের শিকার হতে হয়েছে। সেই আফ্রিকা এখন নতুন ধরনের লুণ্ঠনের শিকার হচ্ছে। কর্পোরেশন, প্রাইভেট ব্যাংক, পেনশন তহবিল এবং অসংখ্য মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী পুরো মহাদেশ জুড়ে উর্বর জমি দখল করছে। দুর্নীতিবাজ এবং দালাল সরকারসমূহের বিদেশী বিনিয়োগের নির্ভরতার অজুহাত তুলে এসব প্রতিষ্ঠান দীর্ঘমেয়াদের জন্য প্রতি হেক্টর জমি বছরে মাত্র অর্ধেক ডলারের বিনিময়ে লিজ নিয়েছে।
জমি দখলের এ ধরনের প্রবণতা নতুন হলেও ২০০৮ সালেই এই প্রবণতার ক্ষেত্রে বিরাট অগ্রগতি দেখা যায়।
সে বছরে এশিয়া, লাতিন আমেরিকা এবং বিশেষ করে আফ্রিকা অঞ্চলে ৫৬ মিলিয়ন হেক্টর জমি ক্রয় অথবা লিজ নেয় বিনিয়োগকারীরা। যা গত ৫০ বছরের মধ্যে বছর প্রতি জমির চেয়ে ১৫ গুণ বেশি। (ফারাহ স্টকম্যান, বোস্টন গ্লোব, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩)
২০১২ সালের ১১ জুলাই Arround Africa অনলাইন ম্যাগাজিনে আনেইডে ওকিউর নিচের উদাহরণগুলো তুলে ধরেছেন:
- ইথিওপিয়া ৩.৬ মিলিয়ন হেক্টর কৃষি জমি লিজ/বিক্রি করেছে ভারত, সৌদি আরব, ইউরোপ এবং ইসরায়েলের বিভিন্ন কোম্পানীর কাছে। প্রতি বছর মাত্র ০.৮০ ডলারের বিনিময়ে এই লিজ দেয়া হয়েছে। এর ফলে ১.৫ মিলিয়ন লোক তাদের কৃষি জমি হারিয়েছে।
- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক এসজি সাস্টেনেবল ওয়েল ৭৩,০৮৬ হেক্টর জমি ৯৯ বছরের জন্য লীজ নিয়েছে বছরে হেক্টর প্রতি ০.৫ থেকে ১ ডলারের বিনিময়ে।
- লাইবেরিয়ার সরকার মালয়শিয়া ভিত্তিক সিম ডার্বি প্ল্যানটেশন কোম্পানীর সাথে ২২,০০০ হেক্টর জমি ৬৩ বছরের লীজ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ।
- লাইবেরিয়ার ৬৭, সিয়েরা লিওনের ১৫, তাঞ্জানিয়ার ৭, ইথিওপিয়ার ১০, কঙ্গোর ৬, গ্যাবনের ৮,গিনির ১১ এবং মোজাম্বিকের ৬ শতাংশ কৃষি জমি নিয়ন্ত্রন করে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। এই বিনিয়োগকারীগণ বছরে মাত্র ০.৫-৭.১০ ডলার পরিশোধ করছে।
যে লক্ষ লক্ষ কৃষক নিজের পরিবারের খাবার যোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে তাদের কাছে এই আর্থিক লেনদেন কিসের ইঙ্গিত প্রদান করে? জমি দখল মানে এইসব কৃষকের জীবিকা ছিনতাই করা, এই কৃষকরা যেখানে জন্ম ও বংশ পরম্পরায় বসবাস এবং কাজ করে আসছিল তা থেকে জোর করে তাদেরকে উচ্ছেদ করা,তাদের এবং তাদের সন্তানদের জীবন ধ্বংস করা।
এর মধ্য দিয়ে তাদেরকে এমন পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দেয়া হচ্ছে যেখানে ভাগ্যবান কেউ নিরুপায় হয়ে কোন চাকুরি/কর্মসংস্থান পেলেও সেখানে কাজ করতে হয় কঠোর এবং কঠিন পরিস্থতির মধ্যে। এবং যে মজুরী তারা পায় তা দিয়ে নিজের এবং পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হয় না। একদিন যে জমি তাদের নিজেদের ছিল সে জমিতে যদি তারা কোন বিদেশী মালিকানায় কৃষি ভিত্তিক কোম্পানীতে কাজের জন্য নিয়োজিত হয় তাহলে সেখানে তারা নিজের দেশের জন্য নয়, বিদেশে রপ্তানীর জন্য খাদ্য দ্রব্য উৎপাদন করে।
এসব উচ্ছেদের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ প্রদানের পরিমান প্রায় শুন্য। লাইবেরিয়াতে সিম ডার্বি প্ল্যানটেশন পাম গাছ লাগাতে চেয়েছিল।
প্রত্যেক উচ্ছেদকৃত পরিবারকে ৬৩ বছরের জন্য বছরে মাত্র ৩ ডলার করে সর্বমোট মাত্র ২০০ ডলার ক্ষতিপূরণ প্রদান করেছে। (দ্য গার্ডিয়ান, ১৭ অক্টোবর, ২০১২)। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি হেক্টর জমির দাম ৩২ ০০০ ডলার হলেও আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলোতে প্রতি হেক্টর জমির দাম দাড়ায় এক কাপ কফির দামের চেয়ে কম।
প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের কৃষি কাজ বাদ দিয়ে একটি ছোট্ট বাড়ি ও নতুন চাকুরি করলে আগের চেয়ে বেশি আয় হবে। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সাধারনত দেখা যায়, বড় আকারের বানিজ্যিক কৃষি হচ্ছে অসম উন্নয়ন এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃষকদের জমি গ্রাস করে উৎখাত করা।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বিদেশী বিনিয়োগ আসে মূলত বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্র হতে যা প্রধানত নির্ভর করে বিশ্ববাজার, পুঁজির একচেটিয়া হয়ে পড়া এবং আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন এনজিও এর ওপর।
আফ্রিকার এক পুরাতন প্রবাদ এখন আর প্রচলন নেই – “আমরা যারা এখন বেঁচে আছি, তারা উত্তরাধিকারসূত্রে জমি পাই নি; আমরা তা আমাদের সন্তানদের কাছ থেকে ধার করে নিয়েছি। ” স্থিতিশীলতা, জলবায়ুর প্রভাব, মানুষের জীবন এবং প্রকৃতি রক্ষা ইত্যাদি গালভরা বুলি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে দালালির জন্য প্রয়োজনীয় হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে কখনোই তা পুজিবাদী বাণিজ্যের নীতি হতে পারে না। যদিও কিছু বিনিয়োগকারী চাপের মুখে পরিবেশগত এবং উন্নয়নের প্রভাব নিয়ে গবেষনা এবং জনসংযুক্ত প্রচারণা চালায়।
বরং পুজির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কম সময়ে সর্বোচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করা, প্রতিযোগিতায় লিপ্ত পুজির লড়াই প্রধান হয়ে পড়ে। এটাই হয়ে দাড়ায় বিনিয়োগের চালিকা শক্তি।
আবার, ঠিক যখনই ‘দৌড়ের প্রতিযোগিতা’ শুরু হবে, তখন যারা আগে জমি দখল করতে পারবে না, তারা ভতিষ্যতে ছিটকে পড়বে – জয়ী হবে তারাই, যারা জমি আগে দখল করতে পারবে।
(চলবে) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।