হ্যা আমি সেই সত্যবাদীকে সত্যবাদী মনে করি
আমেরিকায় মুসলমানদের অর্থবহ অবস্থান
মুফতি মুহাম্মাদ রফী উছমানী
(দেখুন, আমেরিকায় এখন যত মসজিদ তার অনেকগুলোই আগে গীর্জা ছিল। মুসলমানরা তা কিনে মসজিদ বানিয়েছেন। প্রশ্ন এই যে, গীর্জাগুলো কারা বিক্রি করেছে? তারাই যাদের পূর্বপুরুষ অর্থ ও শ্রম ব্যয় করে এগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিল। )
কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে-‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদেরকে ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে ওই আগুন থেকে রক্ষা কর, যার ইন্ধন মানুষ ও পাথর, যাতে নিয়োজিত রয়েছে নির্মমহৃদয়, কঠোরস্বভাব ফেরেশতাগণ, যারা কখনও আল্লাহর আদেশের অবাধ্য হয় না এবং যে আদেশ তাদেরকে করা হয় তা-ই তারা পালন করে। ’ (সূরা তাহরীম : ৬) এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর মুমিন বান্দাদেরকে সম্বোধন করেছেন এবং জাহান্নামের ভয়াবহ আযাব সম্পর্কে সাবধান করে আদেশ দিয়েছেন যে, তারা যেন নিজেরাও ওই আযাব থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করে এবং পরিবার-পরিজনকেও রক্ষা করার চেষ্টা করে।
আল্লাহ তাআলা এই আদেশ করেছেন তার বিশ্বাসী বান্দাদেরকে, বিশ্বাসী বলে সম্বোধন করে। তাই একদিকে যেমন জানা যাচ্ছে যে, এটি একটি ফরয বিধান যা পালন করা প্রত্যেক ঈমানদার নর-নারীর জন্য অপরিহার্য, অন্যদিকে তার তাৎপর্যও বোঝা যাচ্ছে। ঈমানদার বান্দাদের প্রতি আল্লাহ তাআলার করুণা ও মেহেরবানীতে এই সম্বোধনটি সিক্ত। এই আয়াত থেকে প্রমাণ হয় যে, যে পরিমাণ দ্বীনদারী ছাড়া আখিরাতের আযাব থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না ওই পরিমাণ দ্বীনদারী অর্জন করা এবং রক্ষা করা অপরিহার্য। তদ্রূপ যে পরিবেশে তা রক্ষা করা সম্ভব নয় সেই পরিবেশ পরিত্যাগ করাও অপরিহার্য।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের দৃষ্টান- আমাদের সামনে রয়েছে।
আমেরিকার মতো দেশে আমাদের যে মুসলিম ভাইরা বসবাস করেন তাদের জন্য এই প্রসঙ্গটা অত্যন- গুরুত্বপূর্ণ। অন্য সকল বিষয়ের আগে আমাদেরকে নিজেদের ও স্ত্রী-পুত্র-পরিজনের ঈমান-আমলের হেফাযতের বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে। আমরা যদি এ বিষয়ে সচেতন ও সচেষ্ট না হই, কিংবা যে পরিমাণ চেষ্টা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব তা না করি তাহলে কিয়ামতের দিন আমরা আল্লাহ পাকের জবাবদিহির মুখোমুখি হয়ে যাব। এটা ঠিক যে, অবস'ার অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
প্রথমদিকে এ অঞ্চলে মুসলিমরা ছিলেন নবাগত। বিভিন্ন সঙ্কটের মোকাবেলা তাদেরকে করতে হয়েছে। ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করার উপায় ছিল না, কিন' এখন তাঁরা তাদের ধর্মীয় পরিচয়ের স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছেন। নতুন নতুন মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। মুসলিম বসতি গড়ে উঠেছে।
এগুলো ইতিবাচক দিক। কিন' এখনও আমরা পুরোপুরি আশঙ্কামুক্ত নই। অন্যান্য প্রসঙ্গ তো রয়েছে, আদর্শিক প্রসঙ্গটাই গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার। আমরা যদি আমাদের সন-ানদের ঈমান-আমল নিশ্চিত না করি তাহলে-আল্লাহ না করুন-আমাদের দ্বীনী কর্মকাণ্ডের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। আমাদের কষ্টোপার্জিত অর্থে প্রতিষ্ঠিত মসজিদ-মাদরাসা ও ইসলামিক সেন্টারগুলোর দায়িত্ব কি আমাদেরই আগামী প্রজন্মের হাতে ন্যস- হবে না?
দেখুন, আমেরিকায় এখন যত মসজিদ তার অনেকগুলোই আগে গীর্জা ছিল।
মুসলমানরা তা কিনে মসজিদ বানিয়েছেন। প্রশ্ন এই যে, গীর্জাগুলো কারা বিক্রি করেছে? তারাই যাদের পূর্বপুরুষ অর্থ ও শ্রম ব্যয় করে এগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিল। উত্তরপ্রজন্ম শুধু অর্থের জন্য তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রি করে দিয়েছে! এটা ভেবে দেখার মতো একটি দৃষ্টান-। অতএব আগামী প্রজন্মের দ্বীন ও ঈমান রক্ষায় অবশ্যই আমাদেরকে সচেতন হতে হবে। এ প্রসঙ্গে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা আমাদের জন্য সহায়ক হবে ইনশাআল্লাহ।
১. নতুন প্রজন্মের জন্য নিরাপদ শিক্ষার ব্যবস'া এতে কোনোই সন্দেহ নেই যে, আমরা আমাদের সন-ানদেরকে ঘরে বসিয়ে রাখতে পারব না। এখানে টিকে থাকার জন্যই তাদেরকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। কিন' আমরা যদি তাদেরকে প্রচলিত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠাই তাহলে তাদের ঈমান-আমল, আখলাক-চরিত্র সম্পর্কে শঙ্কাহীন হতে পারি না। অনেক দুঃখজনক দৃষ্টান- আমাদের সামনে রয়েছে। এজন্য আলাদা মুসলিম স্কুল প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই।
যেখানে ইসলামী আদর্শ ও মূল্যবোধ রক্ষার পাশাপাশি পড়াশোনা, শৃঙ্খলা ও ব্যবস'াপনা সবকিছুই সর্বোত্তম মানের হবে। কিছু কিছু স্কুল ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে এ বিষয়ে আরো মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। দেখুন, ইহুদীদের নিজস্ব স্কুল আছে। তারা আমেরিকার মূল স্রোতের মধ্যে থেকেও নিজস্ব বিশ্বাস ও সংস্কৃতি রক্ষায় অত্যন- সচেতন।
তাহলে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত হিসেবে আমাদের কি সচেতন হওয়া প্রয়োজন নয়? এ প্রসঙ্গে ফান্ডের সমস্যার কথা বলা হয়ে থাকে। এটা খুব বড় সমস্যা নয়। আমরা যদি সংকল্প করি যে, কাজটা আমরা করবই তাহলে ফান্ড জোগার করা অসম্ভব নয়। হযরত মাওলানা মুফতী শফী রাহ. একটি দৃষ্টান- দিতেন। তিনি বলতেন যে, আপনি যদি এমন কোনো রাস-ায় চলতে থাকেন যার দুপাশে বৃক্ষের সারি, তাহলে সামনের দিকে তাকিয়ে আপনার মনে হবে, কিছু দূর গিয়ে রাস-া বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
এখন কেউ যদি সাহস হারিয়ে পথ চলা বন্ধ করে দেয় তাহলে সে গন-ব্যে পৌঁছতে পারবে না। কিন' যদি সামনে অগ্রসর হয় তাহলে দেখা যাবে, যতই সে অগ্রসর হচ্ছে ততই যেন রাস-া খুলে যাচ্ছে। এই অভিজ্ঞতাটা আমাদের অনেকেরই আছে। এজন্য হিম্মত ও সংকল্প করা গেলে এই সমস্যার সমাধান ইনশাআল্লাহ হয়ে যাবে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) ‘যারা আমার সন'ষ্টির জন্য সামর্থ্য ব্যয় করে অবশ্যই আমি তাদেরকে আমার পথসমূহ দেখিয়ে দিব এবং আল্লাহ অবশ্যই সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গে থাকেন।
(সূরা আনকাবূত : ৬৯) দারুল উলূম প্রতিষ্ঠা দ্বীনী মাদরাসা প্রতিষ্ঠারও প্রয়োজন রয়েছে। এমন একটি পূর্ণাঙ্গ দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন, যেখানে তাফসীর, হাদীস, ফিকহ, উসূলে হাদীস, উসূলে ফিকহ, আরবী সাহিত্য ইত্যাদি সকল বিষয় পড়ানো হবে, যদি মানসম্মত একটি দারুল উলূম প্রতিষ্ঠা করা যায় তাহলে এর মাধ্যমে গোটা আমেরিকার সাময়িক প্রয়োজন পূরণ হতে পারে। এখানকার মুসলিম অধিবাসীরা যদি সংকল্প করেন যে, মুসলিম দেশগুলো থেকে নির্বাচিত আলিমদেরকে নিয়ে একটি মানসম্মত দারুল উলূম প্রতিষ্ঠা করবেন তবে তা কঠিন নয়। এমন একটি প্রতিষ্ঠানের দ্বারাই গোটা আমেরিকার সাময়িক প্রয়োজন পূরণ হতে পারে। তবে মুসলিম স্কুল প্রতিষ্ঠা করা প্রত্যেক মহল্লার প্রয়োজন।
এ বিষয়ে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
২. মুসলিম বসতি প্রতিষ্ঠা এটা প্রথম বিষয়েরই কাছাকাছি। এরও গুরুত্ব অপরিসীম। এখানের মুসলিম অধিবাসীরা যদি দূরে দূরে বিচ্ছিন্ন না থেকে কাছাকাছি থাকেন তাহলে অনেক দিক দিয়ে এটা উপকারী। ইংল্যান্ডে এ বিষয়টা বেশ অগ্রসর।
সেখানে অনেক মুসলিম মহল্লা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এতে পরস্পরে দেখা-সাক্ষাত হয়, খোঁজ-খবর নেওয়া যায়, সুখে-দুঃখে শরীক থাকা যায়। মোটকথা, পারস্পরিক সম্পর্ক অনেক সহজ হয়ে যায়। মুসলিম স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্যও এটা সহায়ক হবে। দূরে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলে শিশুদেরকে এক স্কুলে একত্র করা কঠিন, কিন' কিছু মুসলিম পরিবার কাছাকাছি থাকলে নিজস্ব স্কুল প্রতিষ্ঠা সহজ হবে।
মুসলিম বসতি গড়ে তোলার সহজ পদ্ধতি হল যথাসম্ভব মসজিদের কাছাকাছি ঘরবাড়ি কেনার চেষ্টা করা। সবাই চেষ্টা করতে থাকলে মসজিদ ভিত্তিক মুসলিম বসতি গড়ে ওঠা সম্ভব।
৩. আল্লাহওয়ালাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখুন দ্বীন ও ঈমানের সঙ্গে বেঁচে থাকার জন্য এটা অনেক বড় উপায়। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যনিষ্ঠদের সঙ্গে থাক। ’ এখানে দুটো আদেশ করা হয়েছে : ১. আল্লাহকে ভয় করা।
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার সকল আদেশ-নিষেধ মেনে চলা। ২. সত্যনিষ্ঠদের দলভুক্ত হয়ে তাদের সাহচর্য অবলম্বন করা। অর্থাৎ যারা কথা, কাজ ও বিশ্বাসে সত্যের অনুসারী তাদের সঙ্গে থাকা এবং তাদের মতো হওয়া। কুরআন মজীদের অত্যন- প্রজ্ঞাপূর্ণ ভঙ্গি এই যে, কুরআন যখন কোনো কঠিন বিধান দান করে তখন এমন একটি পন'াও নির্দেশ করে, যার মাধ্যমে তা পালন করা সহজ হয়ে যায়। বলাবাহুল্য যে, জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাকওয়ার উপর থাকা সহজ নয়, কিন' মানুষ যদি তাকওয়ার পরিবেশে চলে যায় এবং মুত্তাকীদের সাহচর্য অবলম্বন করে তাহলে এটা আর কঠিন থাকে না, সহজ হয়ে যায়।
এজন্য আল্লাহওয়ালাদের সাহচর্য অবলম্বন করা চাই। বছরে মাস-দুই মাস, সপ্তাহ-দুই সপ্তাহ তাদের সাহচর্যে কাটানোর নিয়ম করা চাই। নিজ দেশে এমন কোনো ব্যবস'া না হলে পৃথিবীর যেখানেই হোক, কোনো আল্লাহ ওয়ালার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা চাই। এখন যোগাযোগ ব্যবস'া অত্যন- উন্নত। মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবীর একপ্রান- থেকে অন্য প্রানে- যোগাযোগ করা যায়।
প্রযুক্তির এই সুবিধাগুলোকে দ্বীনের কাজে ব্যবহার করা উচিত। তাবলীগ জামাতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখুন উপরের কাজের জন্য এটা অত্যন- সহায়ক। আলহামদুলিল্লাহ, তাবলীগ জামাতের কাজ অত্যন- ব্যাপকভাবে হচ্ছে। অসংখ্য মানুষ এর দ্বারা উপকৃত হচ্ছে। দ্বীনী সচেতনতা সৃষ্টিতে এই জামাত অত্যন- সফল।
আমাদের তাবলীগ জামাত যে খিদমত আঞ্জাম দিচ্ছে তার কোনো নজির কোনো মিশনারী দলের মধ্যে পাওয়া যাবে না। খৃষ্টানরা তাদের ধর্ম-প্রচারের জন্য অঢেল সম্পদ ব্যয় করছে, গোটা পৃথিবীতে অসংখ্য সংগঠন মিশনারী কর্মকাণ্ডে তৎপর রয়েছে। কিন' আমাদের তাবলীগ জামাত যে কাজ করছে তার সঙ্গে কোনো তুলনাই হতে পারে না ওইসব মিশনারী সংগঠনগুলোর। তাবলীগ জামাতের কোনো দফতর নেই, ব্যাংক ব্যালেন্স নেই, প্রচার-প্রচারণার আধুনিক কোনো ব্যবস'া নেই। কিন' আজ এখানে যে সিদ্ধান- গৃহীত হচ্ছে তিন দিন পরেই আপনি তা শুনতে পাবেন হংকংয়ে, চায়নায়, আফ্রিকায় এবং গোটা পৃথিবীতে।
শুধু আল্লাহর সন'ষ্টির জন্য কত মানুষ নিজের সামান নিজে বহন করছেন, নিজের খরচে দেশ-বিদেশে সফর করছেন এবং ঈমান-আমলের দাওয়াত পৌঁছে দিচ্ছেন! এটা আমাদের বুযুর্গদের কাজ। হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-এর মাধ্যমে এই কাজের সূচনা হয়েছে। আমাদের পাশ্চাত্যের ভাইদেরও কর্তব্য এই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া। ঈমানী ও আমলী যিন্দেগীতে ইনশাআল্লাহ এর গভীর প্রভাব হবে। তাবলীগ জামাতের উপর আপত্তি তাবলীগ জামাতের উপর বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন উত্থাপিত হতে দেখা যায়।
কেউ বলেন, ‘এঁরা শুধু আমর বিল মা’রূফ করেন নাহী আনিল মুনকার করেন না!’ ঠিক আছে, আমর বিল মা’রূফ ও নাহী আনিল মুনকার দু’টোই তো শরীয়তের বিধান। তাঁরা যদি একটা করে থাকেন তো অপরটা আপনি করুন! কেউ বলেন, ‘তাবলীগ জামাতের লোকেরা অনেক বাড়াবাড়ি করে থাকে!’ আচ্ছা ভাই, আপনি ভালো কাজটুকু করুন, বাড়াবাড়িটা বাদ দিন। কিন' তা-ও করতে রাজি নয়। আসলে যে বাড়াবাড়িগুলো কখনও কখনও চোখে পড়ে, খোঁজ নিলে দেখা যায় যে, তাবলীগের আলিম-ওলামা ও বুযুর্গরা এমন করতে বলেননি। কিছু অতি উৎসাহী নতুন তাবলীগী এ ধরনের কাজ করে থাকেন।
স্ত্রী-সন-ানের হক্ব নষ্ট করেন আর গর্বের সঙ্গে বলেন, দ্বীনের জন্য স্ত্রীকে কুরবান করে দিয়েছি! স্ত্রী হসপিটালে আর আমি ‘আল্লাহর রাস-ায়’ বের হয়ে পড়েছি! খুব ভালোভাবে জেনে নিন, এগুলো দ্বীনের কাজ নয়। এগুলো অবশ্যই বাড়াবাড়ি, শরীয়তে এমন কাজের অনুমতি নেই। তবে আগেই বলেছি, এগুলো কিছু অতি উৎসাহী মানুষের কাজ, তাবলীগের মুরব্বীদের মূল নিয়ম এটা নয়। দেখুন, একটা কথা আছে যে, দুই ব্যক্তির রাতে ঘুম হয় না : এক. যে নতুন বিয়ে করেছে দুই. যে নতুন মুরীদ হয়েছে! যাই হোক, তাবলীগের কাজের সঙ্গে অবশ্যই সম্পৃক্ত থাকুন তবে ওই বাড়াবাড়িগুলো বাদ দিন। সকল ক্ষেত্রে আলিম-ওলামা ও বুযুর্গানে দ্বীনের পরামর্শ মতো চললে কাজকর্মে ভারসাম্য থাকে।
৪. দ্বীনী কিতাবপত্র অধ্যয়ন অবশ্যই দ্বীনী কিতাবপত্র সংগ্রহ করুন এবং সময় বের করে তা অধ্যয়ন করুন। এখন আলহামদুলিল্লাহ ইংরেজিতেও বেশ কিছু কিতাবপত্র তৈরি হয়েছে। এছাড়া উর্দূ ও বাংলাতেও দ্বীনী কিতাবপত্র আছে। আরবী ভাষা জানা থাকলে তো কথাই নেই। ব্যস-তা বেশি হলেও দ্বীনী কিতাবপত্র সংগ্রহরে ব্যাপারে অনাগ্রহী হওয়া ঠিক নয়।
আপনি যদি পড়ার সুযোগ না পান আপনার স্ত্রী সুযোগ পাবেন, সন-ানরা সুযোগ পাবে। আর হাতের কাছে বইপত্র থাকলে একসময় না একসময় পড়া হয়েই যায়।
৫. হারাম উপার্জন থেকে বেঁচে থাকুন এটা অত্যন- গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হারাম উপার্জন থেকে বেঁচে থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করা প্রয়োজন। কিছু গুনাহ এমন রয়েছে, যা আরো অনেক গুনাহর পথ খুলে দেয়।
হারাম উপার্জন এমনই একটি গুনাহ। আখিরাতের শাসি- তো রয়েছেই দুনিয়াতেও এর অসংখ্য কুফল প্রকাশ পায়। দ্বীনী কাজ-কর্মে অনীহা সৃষ্টি হয়, গুনাহের কাজে আগ্রহ বাড়ে। সন-ান-সন-তি অবাধ্য হয়ে যায়। এভাবে অসংখ্য পেরেশানী ও জটিলতা সৃষ্টি হয়।
এজন্য হারাম উপার্জন পরিহার করা কর্তব্য। পাশ্চাত্যের দেশগুলো হচ্ছে সুদী কারবারের কেন্দ্র। এজন্য লেনদেনে সতর্ক হওয়া চাই। তদ্রূপ মদ্যপান থেকে বিরত থাকা চাই। এটা এমন অশুভ প্রবণতা যে এর দ্বারা মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনা একদম বিনষ্ট হয়ে যায়।
মোটকথা, হারাম খাবার ও হারাম পানীয় থেকে বেঁচে থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করুন। ৬. ঘরে মাতৃভাষাকে জীবন- রাখুন বাইরের কাজকর্মে ইংরেজি ভাষা ছাড়া উপায় নেই কিন' ঘরে মাতৃভাষায় কথা বলুন। যেন আমাদের আগামী প্রজন্ম মাতৃভাষা ভুলে না যায়। নিজের দেশের আলিম-ওলামা, দ্বীনদার শ্রেণী এবং দ্বীনী রচনাবলির সঙ্গে সম্পর্ক রাখার একটি সূত্র হল মাতৃভাষা। এজন্য কোনো সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, খালেছ দ্বীনী উদ্দেশ্যে মাতৃভাষার ব্যবহার অব্যাহত রাখা কর্তব্য।
(বাংলাভাষায় রচিত দ্বীনী কিতাবপত্র এবং এদেশের দ্বীনদার আলেম-ওলামার সঙ্গে সেতুবন্ধন রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম বাংলা ভাষা। এটা আমাদের মাতৃভাষা হওয়ার কারণে খুব সহজেই আমরা এই সূত্রটা রক্ষা করতে পারি। অতএব তা রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। )-অনুবাদক
৭. সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করুন হুকুকুল ইবাদ বা বান্দার হক ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অন্যের হক নষ্ট করা বা অন্যকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেওয়া অনেক বড় গুনাহ।
অথচ এ বিষয়ে অবহেলা করতে দেখা যায়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, এসব দেশে আমাদেরকেই মুসলিম জাতির প্রতিনিধি মনে করা হয়। আমাদের কাজ-কর্ম, আচার-ব্যবহারের দ্বারা অমুসলিমরা ইসলাম সম্পর্কে অনুমান করার চেষ্টা করে। এজন্য আমাদের অত্যন- সতর্ক ও সংযমী হওয়া চাই। পাড়া-প্রতিবেশী, সহকর্মী এবং সাধারণ অমুসলিমদের সঙ্গেও ভদ্র ও শালীন ব্যবহার করা কর্তব্য।
আমরা নিশ্চয়ই জানি যে, যেকোনো ধরনের জুলুম, অত্যাচার, ওয়াদাখেলাপী, আমানতে খেয়ানত যেমন একজন মুসলিমের সঙ্গে করা নাজায়েয তেমনি একজন অমুসলিমের সঙ্গেও। মানুষ তো মানুষ, কোনো পশু-পাখির প্রতিও অবিচার করা ইসলামে নিষেধ। এখানে কিছু করণীয় বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, যেগুলোতে সাধারণত অবহেলা হয়ে থাকে : ১. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা। ২. হৈচৈ, হট্টগোল থেকে বিরত থাকা। ৩. ট্রাফিকের নিয়ম-কানূন বিশেষত গাড়ি পার্কিংয়ের নিয়ম-কানূন মেনে চলা।
৪. প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা। ৫. প্রতিবেশীদের সুবিধা-অসুবিধা সর্ম্পকে সচেতন থাকা। ৬. চুক্তি ও অঙ্গীকার পালন করা। ইত্যাদি। প্রতিবেশীর হক প্রতিবেশীর প্রসঙ্গ ইসলামে অত্যন- গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিবেশী মুসলিম হোক বা অমুসলিম, তাকে কোনোভাবেই কষ্ট দেওয়া জায়েয নয়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, হযরত জিব্রীল আ. প্রতিবেশী সম্পর্কে এত বেশি তাকীদ করেছেন যে, আমার মনে হচ্ছিল তাকে মিরাছেরও অংশীদার বানিয়ে দেওয়া হবে। অন্য হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘ওই ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না, যার অনিষ্ট থেকে প্রতিবেশী নিরাপদ থাকে না। ’ এখানে একটি ঘটনা মনে পড়ছে। তাবলীগ জামাতের আমীর হযরত মাওলানা এনামুল হাসান ছাহেব রাহ.-এর কাছে বৃটেনের কিছু মুসলমান উপসি'ত ছিলেন।
তারা কথা প্রসঙ্গে গর্বের সঙ্গে বলছিলেন যে, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের মহল্লায় কোনো অমুসলিম নেই! যারা ছিল একে একে সবাই মহল্লা ত্যাগ করে চলে গেছে। ’ তাদের কেউ কেউ আরো বললেন, ‘তারা বসবাসের জন্য সাধারণ শান- ও হট্টগোলমুক্ত এলাকা পছন্দ করে এবং বাড়িঘরের পাশে ময়লা-আবর্জনা ও অপরিচ্ছন্নতা তাদের পক্ষে মোটেই সহনীয় নয়। ’ হযরতজী মাওলানা এনামুল হাসান ছাহেব রাহ. তখন অত্যন- দুঃখ করে বললেন, ‘ভাই, তোমরা যদি এমন পরিবেশ তৈরি করতে যা তাদেরকে আকৃষ্ট করে! তারা কি বিরক্ত হয়েই ওই মহল্লা ত্যাগ করল? তোমরা যদি ইসলামের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং ভদ্রতা ও শালীনতার আদর্শ পুরোপুরি অনুসরণ করতে তাহলে হয়তো তারা তোমাদের সঙ্গে মিশে যেত। হয়তোবা তাদের কারো ঈমানও নসীব হত!’ ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও অবস'ান করা এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও গোপনে থেকে যাওয়া কোনোভাবেই ঠিক নয়।
এটা অঙ্গিকার ভঙ্গ করার শামিল। কোনো অমুসলিমের সঙ্গেও কৃত অঙ্গিকার ভঙ্গ করার অনুমতি ইসলাম দেয় না। তদ্রূপ এখানে অবস'ান করে এখানকার নিয়ম-কানূন অমান্য করাও অঙ্গিকার ভঙ্গ করার মধ্যে পড়ে। যদি তাদের নিয়ম-কানূন পছন্দ না হয়, কিংবা আপনার পক্ষে তা পালন করা সম্ভব না হয় অথবা ইসলামের দৃষ্টিতে তা মানা আপনার জন্য বৈধ না হয় সেক্ষেত্রে আপনার কর্তব্য স'ান পরিবর্তন করা। যেখানে আপনাকে ওইসব নিয়ম-কানূন মানতে হবে না সেখানেই বসবাস করা উচিত।
কিন' একটি দেশে অবস'ান করে সে দেশের নিয়ম-কানূন অমান্য করার দ্বারা একদিকে যেমন অঙ্গিকার ভঙ্গের গুনাহ হয় অন্যদিকে ইসলাম ও মুসলমানের বদনাম করারও গুনাহ হয়। আপনারাই হতে পারেন ইসলামী জাগরণের অগ্রপথিক উপরোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি যদি আমাদের প্রবাসী ভাইরা মনোযোগ দেন এবং এগুলোর বাস-বায়ন শুরু হয়ে যায় তাহলে আল্লাহ তাআলার মেহেরবানীতে আশা করা যায় যে, আমাদের আগামী প্রজন্ম এই ভূখণ্ডে ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারবে। এটা ঠিক যে, গোটা বিশ্বে বিশেষত পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে মুসলমানরা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন কিন' একই সঙ্গে ইসলামের পুনর্জাগরনের সকল আলামতও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আল্লাহ করুন, পাশ্চাত্যের প্রবাসী মুসলিম ভাইরা যেন এই ভূখণ্ডের জন্য হেদায়েতের ওসীলা হয়ে যান। আমীন।
(গবেষণামূলক উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মারকাযুদ্ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-এর মুখপত্র মাসিক আলকাউসার আগষ্ট-সেপ্টেম্বর ২০০৯, শাবান-রমজান ১৪৩০ সংখ্যা থেকে। ) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।