আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দ্বিতীয় জন্মের স্বাদ

ভোর ৫ টা , তিতির এর গায়ে হলুদ আজ র সে কিনা মাঝারি সাইজের একটা ব্যাগ নিয়ে চুপিচুপি গেইট খুলে বেরিয়ে এলো । বাইরে ট্যাক্সি নিয়ে দাড়িয়ে প্রিয়ন্ত । ট্যাক্সি গিয়ে থামল বাস স্ট্যান্ড এ প্রিয়ন্ত তিতির এর হাত ধরে একটা বাসে উঠে বসলো , তিতির বলল আমরা কোথায় যাচ্ছি ? বাস ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে প্রিয়ন্ত বলল বাস যেখানে থামে সেখানে । তিতির এর অবাক দৃষ্টি দেখে হেসে বলল মানে আমি জানি না , যে বাস এ সিট খালি পেয়েছি সেখানেই উঠে গেছি , র আমরা তো পালাচ্ছি তাই না ? এতো জেনে শুনে পালানোর দরকার কি? তিতির বিস্ফোরিত চোখে প্রিয়ন্তর দিকে তাকিয়ে আছে ওর দিকে তাকিয়ে প্রিয়ন্ত গেয়ে উঠলো নীলাঞ্জনা ওই নীল নীল চোখে চেয়ে থেকো না , আমি জ্ঞান হারাবো মরেই যাবো বাঁচাতে পারবে না কেউ ............ প্রিয়ন্তের পরিবেশনা আপনার কেমন লাগলো ম্যাম ? তিতির রাগবে কি?? হাসতে শুরু করল ... ১৪দিন আগেই বিয়ে সেরে নিয়েছিল ২জনে ধর্মের দোহাই দিয়ে সমাজ পরিবার তাদের অনেক চেষ্টা করেও আলাদা করতে পারেনি , মূলত তিতির এর পরিবার খুব তাড়াতাড়ি ওর বিয়ে প্রিয়ন্ত কে ওর জীবন থেকে সরাতেই দিতে চাইছিল । দুটি ভিন্ন ধর্মের মানুষ যখন বিয়ে করে তা ইরেগুলার ম্যারেজ যা খুব জটিল প্রক্রিয়া বলে তারা বিয়ে টা আগেই সেরে নিয়েছে , অনেক বুঝিয়ে ও ২ পরিবার কে রাজি করাতে পারেনি তারা তাই পালানো ছাড়া অন্য পথ ছিল না তাদের।

অনেক বিলাসিতার জীবন ছেড়ে প্রিয়ন্তের হাত ধরে অজানা এক জীবনের যাত্রা , তিতির এর ভয় লাগছিল না ববং কেন যেন ভালই লাগছে । বাস গিয়ে থামল মফস্বল এক জায়গায় , বাস থেকে নেমে প্রিয়ন্ত তিতির কে বলল ভালই হল নিজেরাই জানি না আমরা কোথায় আছি সো তোমার বাবা হুলিয়া বের করলেও আমাদের ধরা সহজ হবে না । বলেই ২জনে হাসতে শুরু করলো একসাথে। ২মাস পরের কথা পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র প্রিয়ন্ত একটা বীমা প্রতিষ্ঠানে ছোট্ট একটা চাকরি করে র তিতির ২,৩ টা বাচ্চা পড়ায় । র থাকার জন্য একটা ৩ তলা বাড়ির ছাদ ঘরটা ভাড়া নিয়েছে ।

এক রাতে খুব বৃষ্টি হচ্ছে , তিতির দৌড়ে ছাদে গেল ২হাত ছড়িয়ে দিয়ে গান করছে হাসিতে ফেটে পড়ছে , প্রিয়ন্ত দেখে হাসতে হাসতে বলল তিতির দেখে যাও আমি তোমার চেয়ে আনন্দ বেশি করছি বিছানায় শুয়ে আরাম করে বৃষ্টি তে ভিজতেছি , তিতির এসে দেখে ঘরময় পানি র পানি । এমন ও অনেক দিন গেছে তাদের যখন একজন খেলে একজনের না খেয়ে থাকতে হত কিন্তু সে ভাব ধরতও ক্ষিধায় নেই তার । অনেক কষ্টের দিন তাদের কিন্তু ভালবাসা ছিল অসীম তাই ২জনের মুখে লেগে থাকতো হাসি যা প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে একসাথে বাঁচার আনন্দ ছড়িয়ে রেখেছিল তাদের জীবনে । অনেক কষ্টের দিন গুলো ও অনেক সুখের মনে হতো তাদের যখন তিতির তার মধ্যে নতুন একটা প্রাণের স্পন্দন অনুভব করল । তিতির এর বাড়তি যত্নের কথা ভেবে ও যেন ঠিক মতো খায় এটা নিশ্চিত করতে প্রিয়ন্ত প্রায় ই মিথ্যা বলত না খেয়ে এসে বলত খেয়ে এসেছি তুমি খেয়ে নাও , এক রাতে ক্ষিধায় প্রিয়ন্তের ঘুম আসছিলো না উঠে অনেক পানি খেয়ে ছাদে হাঁটাহাঁটি করছিল তিতির এসে দাঁড়ালো পাশে বলল চলো ভাত খাবে , প্রিয়ন্ত বলল র এ কি বল ?? আমি খেয়ে এসেছি তো , তিতির বলল আমি র একটা ছোট্ট প্রিয়ন্ত কে নিজের মধ্যে ধারণ করে আছি আমি না বুঝলেও সে ঠিক ই বুঝে সব তার বাবা তাকে বাঁচাতেই রোজ মিথ্যা বলে ।

প্রিয়ন্ত জড়িয়ে ধরল তিতির কে কান্না আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো বলল আমি আমাদের বাবু কে খুব সুন্দর একটা জীবন দিতে চাই ওকে অনেক বড় করতে চাই । তিতির বলল আমি ও কিন্তু তার জন্য তুমি না খেয়ে থাকবে এটা মেনে নিতে পারব না চল খাবে । ২ রুমের একটা ঘরে শিফট হয়ে গেল ওরা ভাড়া একটু বেশি সেটা এবং বাবুর জন্য টাকা জমাতে দিনে চাকরির পর একটা ষ্টীল মিলের অতিরিক্ত হিসাব রক্ষকের কাজ নিল প্রিয়ন্ত । দেখতে দেখতে দিপুর জন্মের দিন এসে গেল দিপু কে যখন ওদের কাছে নিয়ে এলো নার্স তিতির র ওর পিচ্চি বাচ্চা টাকে জড়িয়ে ধরে বাঁধ ভাঙ্গা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো ওরা ২জন আনন্দের কান্না , জীবনের কাছে জয়ী হওয়ার উল্লাস যেন,ওদের সাথে সুর মিলাতে দিপু ও ক্ষীণ সুরে পৃথিবীকে জানিয়ে দিল তিতির র প্রিয়ন্ত হারে নি ওদের দুর্বার ভালবাসা দিপুতেই দীপ্তিময় । দিপু কে একটু সুখের জীবন দিতে নিজের সব আরাম বিসর্জন দিয়ে তিতির র প্রিয়ন্ত এর প্রাণান্তকর চেষ্টা ।

ধীরে ধীরে দিপু বড় হতে থাকে র আগামী সুখের স্বপ্নে বুক বাঁধে ওরা ২জন। কিন্তু স্বপ্ন স্বপ্ন ই ১৯ বছরের ছেলে দিপু একদিন তার মা কে বলল ২জন ভিন্ন ধর্মের হয়েও তোমরা বিয়ে করেছ কেন??? আমাকে এখন খোঁচায় সবাই ,তোমরা এমন বোকামি করলে র আমাকে এখন সবার কথা শুনতে হয় । তাও যদি বলতাম আমার জন্য সুখের কোন কমতি রাখনি নুন আনতে পান্তা ফুরায় তাও আবার একটা বাইক কিনে দিতে পারলে না সব চেয়ে দামি কলেজ এ পড়তে পাঠালে কিন্তু দামি দামি পোশাক কিনে দিলে না ছোট করলে আমাকে সবার কাছে ... ধ্যৎ ! থাকব না আমি এখানে বাবা কে বলবে আমি ঢাকা যাবো এবং আমার জন্য রাখা টাকা গুলা যেন আমাকে এনে দেয় । দরজায় দাঁড়িয়ে প্রিয়ন্ত নিজেও সব শুনল মা কে এসব বলে পিছনের দরজা দিয়ে বেড়িয়ে গেল দিপু , ঠায় দাঁড়িয়ে রইল তিতির প্রিয়ন্ত এসে দাঁড়ালো ওর সামনে শুধু বলল আমার দিপু আমাকে তোমাকে ২জন কে একসাথে মেরে ফেলেছে শুনেছ তুমি ?? প্রিয়ন্ত বলল তুমি বলেছিলে ছোট্ট প্রিয়ন্ত সব বোঝে ,ঠিক ই বলেছ ও বুঝে গেছে ওর স্বার্থ । ওরা যেন কাঁদতেও ভুলে গেল অনেক শোকে পাথর হয়ে গেল , জীবনের কাঠিন্য কে হারিয়ে দিয়ে ওরা সুখের সাথে সন্ধি করে নিয়েছিল যার জন্য সে দিপুই আজ সন্ধি বিচ্ছেদ করে দিল ...।

তীব্র আলোর ঝলকানিতে ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে এল তিতির ,ওরা বসে আছে একটা মঞ্চে ওদের আশ্রয় দানের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করবে একটি মোবাইল ফোন কোম্পানির একটি ওল্ড হোম , কয় একটি টিভি চ্যানেল লাইভ টেলিকাস্ট করছে অনুষ্ঠানটি । অনেক আয়োজন, এই মহান! কাজ কে উদ্ভোধন করতে একজন মন্ত্রী আসছেন উনার অপেক্ষা শুধু । অনুষ্ঠান এর এক পর্যায়ে তিতির কে বলতে বলা হল তাদের জীবন নিয়ে । তিতির বলল আমরা ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম অনেক ঝর গেছে কিন্তু রোজ ই একটু একটু করে আমাদের ভালবাসা বেড়েছে আমরা কার ও কাছে হাত পাতিনি কিন্তু আজ নিয়তির কাছে হার মানতে হল তারপর ও আমি খুশি আমাদের একসাথে থাকার একটা নিশ্চিত আবাসন পেলাম তাই । ওকে প্রশ্ন করা হল ওদের কোন সন্তান আছে কিনা? উত্তর দেয়ার আগে আবার ও অতীত এ ডুবে গেল সে ।

মা কে অনেক কথা শুনিয়ে যেদিন বেড়িয়ে গেল দিপু তার পরের দিন প্রিয়ন্ত জীবনের সব সঞ্চয় দিপুর হাতে তুলে দিল ওয়দিন রাতেই দিপু চলে গেল ঢাকা ওর বন্ধু দের সাথে ,মাঝে একবার দুইবার চিঠি দিয়ে ছিল সে খুব ভাল আছে এর পর র কোন খবর নেই দিপু তার বিলাস বহুল জীবন থেকে মুছে দিয়ে ছিল তার দরিদ্র বাবা মা কে । তিতির এর হাত থেকে মাইক্রোফোন টা নিয়ে প্রিয়ন্ত বলল আমাদের কোন ছেলে মেয়ে নেই । ওইদিন রাতে ওল্ড হোম এর নির্জন এক কোনে বসে তিতির বলল , আমাদের কোন ছেলে নেই বলে ভালই করেছ না হয় সবাই বলতো আমরা ছেলে মানুষ করতে পারিনি । আচ্ছা বলতো আমাদের কি দোষ ছিল কেন এমন ব্যর্থ জীবন নিয়ে ই ছেড়ে যেতে হবে সব ?? প্রিয়ন্ত চুপ করে তিতির এর কথা শুনছিল এক সময় বলল আমরা হারিনি আমরা ব্যর্থ ও না ,আমরা একটা জটিল সমীকরণে পরেছি মাত্র , আমরা আজ ও একসাথে বেঁচে ছিলাম , একসাথেই মরেছি । তিতির বলল মানে ? প্রিয়ন্ত বলল আমাদের ৩বার জন্ম হয়েছিল , মৃত্যু ২ বার হয়েছে , প্রথম বার জন্ম হল যে দিন আমাদের মায়েরা আমাদের জন্ম দিয়েছিল ,২য় বার জন্ম হল যেদিন একে অন্যের হাত ধরে বলে ছিলাম ভালবাসি সেদিন , র ৩য় বার জন্ম হয়েছিল আমাদের ছেলের জন্মের দিন ।

মৃত্যু ও হল ২বার একবার যেদিন আমাদের ছেলে বলল সে আমাদের চরম বোকামির ফল র একবার আজ যখন পুরা দেশের মানুষের সামনে সেবার নামে আমদের পণ্য করা হল কোটি কোটি টাকা সাহায্য , মানুষের সহানুভূতি সব কিছুই আজ আমাদের জীবিত লাশ ওদের এনে দিল । মৃত মানুষ কি ব্যর্থ হয় তিতির ??? কিন্তু আমদের ২য় জন্মের এখনো মৃত্যু এখন ও হয়নি হবেও না... আমরা চলে গেলেও আমাদের ২য় জন্মের স্বাদ এই পৃথিবীতেই থেকে যাবে , কারণ ওই জন্ম টায় সার্থক আমরা ভালবাসতে ভুলিনি , ভুলবো ও না । ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.