সামুতে অর্থহীন অশুদ্ধ বাংলা ও বাংলিশ শব্দ পরিহার করি
মাছে-ভাতে বাঙালি— এ কথা এখন শুধু বই-পুস্তকেই শোভা পায়। দাদা-দাদি, নানা-নানির কাছে বর্তমান প্রজন্ম পুকুর, হাওর কিংবা বিল থেকে মাছ ধরার যেসব কাহিনী শোনে তা রূপকথার মতোই কাল্পনিক মনে হয়। দেশি জাতের অনেক মাছই আছে যেগুলোর নাম পর্যন্ত শোনেনি বর্তমান প্রজন্ম। এ পরিস্থিতির জন্য প্রাকৃতিক কারণগুলোর চেয়ে মানবসৃষ্ট কারণই বেশি দায়ী। আমিষের অনেকটাই পূরণ করে মাছ।
আমাদের দেশের স্বাদু পানির ২৬০ প্রজাতির মধ্যে প্রায় ৫৪ প্রজাতির মাছই বিলুপ্তপ্রায়। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— মহাশোল, সরপুঁটি, দেশি পুঁটি, খলিসা, বাটা, রিঠা, বাঘাআইর, বাচা, কাজুলি, তারা বাইম, কুচিয়া, আইর, টেংরা, মেনি, ফলি, গাংমাগুর, তিতপুঁটি, খোকসা, চিতল, পাবদা, মলা, ঢেলা, চিত্রা, শিলং, নন্দিনা, বাতাসি, কালি বাউস, নাপিত, দারকিনা, বাইল্লা, বোয়াল, ভেটকি, চাপিলা, কাকিলা, চেলা, পটকা, পোয়া, কাচকি, শিং ইত্যাদি। এসব জাতের মাছ এখন আগের মতো বেশি দেখা যায় না। দেশি মাছের উত্পাদন অনেক কমে গেছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৯৯-২০০০ সালে নদী থেকে মাছ প্রাপ্তির পরিমাণ ছিল ১৫৪৩৫ মেট্রিক টন যা ২০০৯-১০ সালে নেমে এসে দাঁড়িয়েছে ১৩৬৮১২ মেট্রিক টনে।
চলতি বছরের পরিসংখ্যানটা এখনও করা না হলেও এতটুকু বলা যায়, মাছের বর্তমান উত্পাদন উল্লিখিত পরিমাণের চেয়ে কম হওয়াটাই স্বাভাবিক। দেশি মাছ দিন দিন বিলুপ্ত হওয়ার পেছনে মূলত কাজ করছে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল দিয়ে মাছ ধরা, নিয়ম-কানুন না মেনেই স্বাদু পানির মাছ ধরা, পানিতে বিষাক্ত কীটনাশক, সার ও বর্জ্যের ক্ষতিকর প্রভাবসহ ইত্যাদি।
মানুষ প্রাকৃতিক সম্পদ এমনভাবে ব্যবহার করে যে এক পর্যায় তার অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। সে কারণে এ দেশের অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ হারিয়ে যেতে বসেছে। এ ধরনের প্রাকৃতিক নিরাপত্তা না পেয়ে একটা মহা মূল্যবান সম্পদকে আমরা হারাতে বসেছি।
তা হলো প্রাকৃতিক মত্স্য। বিভিন্ন কারণে আমাদের সম্পদের এ খাতটি অস্তিত্বের সংকটে। তা হলো প্রাকৃতিক উৎসের পোনা। জলাধার সংকুচিত, নদীর নাব্যতা হ্রাস, নির্বিচারে রেণুপোনা মেরে ফেলা, বাঁধ নির্মাণ করে নদ-নদীর গতি পথকে থামিয়ে দেওয়া, নদী-খাল-বিল দখল করে স্থায়ী ও নিত্য ব্যবহৃত অবকাঠামো তৈরি করা, জলাশয় শুকিয়ে নিয়ে মাছ ধরা, মাছের প্রজনন ক্ষেত্রগুলোকে নষ্ট করা, নির্বিচারে প্রজননক্ষম মাছকে প্রজনন কার্যক্রম ঘটানোর আগেই ধরে খেয়ে ফেলা, অসহনীয় মাত্রায় কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার, শিল্পের বর্জ্য দূষণের মাধ্যমে পরিবেশের পানি দূষণ ঘটিয়ে মাছ ও পোনা বিচরণ এবং প্রজনন ক্ষেত্রগুলোকে নষ্ট করা হচ্ছে।
বর্তমান মুনাফামুখী ইজারা প্রথায় জলাশয় বন্দোবস্ত দেওয়ার ফলে উত্পাদনের জৈবিক ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে ইজারাদারের লোভের কারণে এ সম্পদ নষ্ট হচ্ছে।
অনেক কারণে প্রাকৃতিক উেসর পোনার অভাবে ’মাছে-ভাতে’ বাঙালি প্রবাদটি বেমালুম হারিয়ে যাচ্ছে। সরকার যাকে আইন প্রণয়নের মাধ্যমেও টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনাসহ ব্রহ্মপুত্র নদীতে এবং তাদের শাখা-প্রশাখাগুলোতে বিচরণ করত মাছের ডিম-রেণু-পোনা এবং মাছ। বর্ষা শেষে খেপলা জাল, দোয়ার, পলো, হুচা টেঁটা প্রভৃতি নিয়ে মাছ ধরার প্রতিযোগিতা এখন তেমন আর চোখে পড়ে না। আমাদের দেশে মুক্ত জলাশয়ে মাছ উত্পাদনের উত্স ছিল অনেক।
যার আয়তন সে দিনও ছিল ৪০,৪৮,৫৩২ হেক্টর। প্লাবন না হওয়ার কারণে তা এখন আর নেই। অতি বৃষ্টি হচ্ছে না গত তিন বছর। খাল আছে, বিল আছে, জল নেই।
এই জলাশয়ে বিচরণ করত প্রাকৃতিক উৎসের পোনা।
দেশের বিরাট জনগোষ্ঠীর মাছের বা আমিষের জোগান হতো একমাত্র এখান থেকে। দেশের বড় নদীগুলো ও তাদের শাখা-প্রশাখাগুলোতে জন্ম নেওয়া পোনাগুলোর আশ্রয়স্থল ছিল নদী থেকে গ্রামের বিল পর্যন্ত। অর্থাৎ আমাদের ঘরের ডোয়া অব্দি। সে নদী নেই, জল নেই, পোনা নেই, মাছও নেই। সাম্প্রতিক সময়ে নদীর খরস্রোত কমে যাওয়ায় খুব সহজেই জলাশয় থেকে পোনা ধরে নেওয়া হচ্ছে।
সরকার পোনা সংকটের মাধ্যমে মত্স্য সম্পদের সংকটের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে মত্স্য রক্ষা ও সংরক্ষণ বিধি ১৯৫০ বলবত্ করে। আবার ১৯৮৫ সালে নতুন করে এ-সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন এবং কঠোর অবস্থানের মাধ্যমে মত্স্য সম্পদ রক্ষার ব্যবস্থা নেয়।
কৃষি উত্পাদননির্ভর গ্রামীণ জনপদে আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ বাস করে। ছোট্ট পরিসরের এ দেশে ১৬ কোটির মতো বিশাল মানুষের বাঁচা-মরা অথবা টিকে থাকার পরিকল্পনাও আসে কৃষি থেকে। এই কৃষির একটি মোক্ষম খাত হচ্ছে মত্স্য।
২০২১ সাল আমাদের মহান স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তি। বর্তমান সরকার গৌরবময় এই অধ্যায়কে সামনে রেখে আমাদের দেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গঠনের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। সরকারের লক্ষ্য আগামী ২০১৩ সালের মধ্যে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, ২.৮ কোটি বেকারের মধ্যে এই সময়ে ২.৪ কোটি এবং ২০২১ সালের মধ্যে তা ১.৫ কোটিতে নামিয়ে আনা, দারিদ্র্যসীমা এবং অতি দরিদ্রতাকে ২৫ ও ১৫ ভাগে নামিয়ে আনা। আর সরকারের এ কাজে সহায়তা করতে মত্স্য সেক্টরের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের বিবেচনায় এ খাতে অনেক ভাবতে হবে।
কেননা কৃষির মত্স্য খাত মানুষের পুষ্টি চাহিদার ৬৩ শতাংশ পূরণ করছে। আবার মোট রপ্তানি আয়ের শতকরা ৬ ভাগ আসছে মত্স্য ও মত্স্যজাত পণ্য রপ্তানি করে। এতসবের পরেও আমাদের এ খাতে রিসোর্স বেশ কম।
অধিক জনসংখ্যার দেশে বা হরহামেশায় চাহিদা বৃদ্ধির দেশে উপযুক্ত পরিকল্পনা নিয়ে অল্প রিসোর্সে অধিক উত্পাদনশীল চিন্তা নিয়ে এগোতে হবে। ২০১৫ সালে আমাদের দেশে মোট মাছ উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫.৪০ লাখ টন।
সেখানে বর্তমান উত্পাদন মাত্র ২৪ লাখ টনের কাছাকাছি। সুদূরপ্রসারী এ চিন্তার প্রেক্ষাপট কিন্তু তেমন সহজ নয়। প্রতিবছর লোক বাড়ছে প্রায় ২৫ লাখ। মাছ উত্পাদনের ক্ষেত্র সংকুচিত হচ্ছে বিভিন্ন কারণে। তবে এতটুকু বলা যায়, দেশের মত্স্য উত্পাদনের অনেকটা অবদানই বেসরকারি বা ব্যক্তি পর্যায়ের।
আবার প্রাকৃতিক উেসর প্রাপ্যতা যদি অবহেলায় আর অজ্ঞতার কারণে নষ্ট হয়ে যায়, তবে তা এ অভাগা জাতির জন্য দুঃসংবাদ ছাড়া কিইবা বলতে পারি।
দেশের সীমিত সম্পদ রক্ষা করতে না পারলে আমাদের অস্তিত্ব সংকটের আশঙ্কা থেকে যায়। প্রাকৃতিক পোনা, মুক্ত জলাশয়ের মাছকে রক্ষায় কতকগুলো দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তার মধ্যে মত্স্য রক্ষণ ও সংরক্ষণ বিধি ১৯৫০ এবং ১৯৮৫ সালে নতুন করে এ-সংক্রান্ত প্রণীত আইনের বাস্তবায়ন চাই। যেজন্য আইন প্রয়োগের বাধাগুলোকে চিহ্নিত করে যার কাজ তাকে দিয়েই বাস্তবায়ন করাতে হবে।
নদী বা জলাশয়গুলোর জলপ্রবাহ ঠিক রাখতে পরিকল্পনা অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।