মনের এলোমেলো ভাবনাগুলোকে শব্দের ফ্রেমে বাঁধার এক অপচেষ্টা। শপিং নামটা শুনলেই আমার মেজাজ বিগড়ে যায়। পুরো পাড়াশুদ্ধ মানুষ যখন রঙ বেরঙের শপিং এ ব্যাস্ত, আমার কাজ হল তখন গালে হাত দিয়ে চ্যানেলগুলোর ঈদ ফ্যাশন দেখতে থাকা। আর তো কিছু করারও নেই! গাউসিয়া, মৌচাক কিংবা চাঁদনী চকের ভীড়ে পিষ্ট হওয়াটা আমার খুব একটা পছন্দের না, আবার বিশাল বিশাল শপিং কমপ্লেক্স এ শপিং করতে গিয়ে জামা কাপড়ের দামের সাথে এসি আর এক্সেলেটরের দামটা দিয়ে আসতেও মনটা ঠিক সায় দেয়না। অতএব শপিং এর দায়িত্ব আব্বু আম্মুর ঘাড়ে ছেড়ে দিয়ে বাসায় ঘুম চর্চা করাটাই আমার প্রিয় কাজ।
কিন্তু এইবার আর শেষরক্ষা হলনা। আমার এক ত্যান্দোরী টাইপের ফ্রেন্ড ধরে বসলো তার সাথে শপিং এ যেতেই হবে। আমি মাথা চুলকে অভিনব কোন বাহানা খুঁজতে লাগলাম, কিন্তু নাগালে কিছু এলোনা। সারা মাস মাথা ব্যাথা, পেট ব্যাথা, ক্লাস, পরীক্ষা, বাসায় কাজের বুয়া নাই আরো নানারকম কারন দেখাতে দেখাতে অন্তিম রোজার মুহুর্তে এখন স্টক পুরাই খাঁ খাঁ। তো এখন কি করি? না, আমাকে কিছুই করতে হলোনা।
যা করার আমার ত্যান্দোরী টাইপের ফ্রেন্ডটাই করলো। আমাকে ঘাড়ে ধরে একটা শপিং মলের ভিতর ঢুকিয়ে দিলো। অতঃপর আমার ভুমিকা হল, শপিং লিস্টি ধরে তার পিছন পিছন ঘোরা।
শপিং এ সবসময় দুইটা পার্ট থাকে, একটা হল মেজর পার্ট আরেকটা মাইনর পার্ট। মেজর পার্টে শপিং এর উপকরণ এবং বাজেট দুটোই থাকে মহা স্বাস্থ্যবান।
মাইনর পার্টে বাজেট স্বাস্থ্যবান থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে তবে শপিং উপকরণ মেজর পার্টের তুলনায় কিছু হালকা হয়। আমরা মুলত এখানে মাইনর শপিং এর উদ্দেশ্যে উপস্থিত হয়েছি। আমার দোস্তের বাজেট কত তা এখনো বুঝতে না পারলেও, শপিং এর লিস্টি আমার বেশ হালকাই মনে হোল। যাক আজ তাহলে অল্পের উপর দিয়েই যাচ্ছে। আজকের শপিং এর এজেন্ডা হোল, আমার বান্ধবীর দুইখান ঈদের ড্রেস, একটা কাঠ কালার, আরেকটা ডিম কালার, এই দুই কালারের সাথে ম্যাচ করে পার্স, জুতা এবং ইয়ারিংস কিনতে হবে আর মোবাইলের ব্যটারী চেঞ্জ করতে হবে।
আমি তো এইটাই বুঝতে পারছিনা ডিম কালার জিনিসটা আসলে কি। হাসের ডিম নাকি মুরগির ডিম, বাদামী ডিম নাকি সাদা ডিম। আমার বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করতেই সে বুঝিয়ে দিলো, ডিম কালার বলতে আসলে ডিমের খোসার কালার না ভেতরের কুসুম কুসুম হলুদ কালার বোঝাচ্ছে। আমিও বুঝে গেলাম। বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়িয়ে বললাম, “ওওও”।
এখন মোবাইলের ব্যাটারী কেনার পালা। ঢুকলাম নোকিয়ার আউটলেটে। ভেতরে ভীড় থাকায় কিছুক্ষন দাড়িয়ে রইলাম। আমার মাথায় তো দুনিয়ার টেনশন। আজ স্টার মুভিজে দারুন একটা মুভি দেখানোর কথা।
শপিং এর চক্করে না মিস হয়ে যায়। এই সব ভাবতে ভাবতেই আমার চোখ ঘুরতে থাকে ভেতরে জমাট বাঁধা লোকগুলোর উপর। দেখলাম এক বিশালদেহী ভদ্রলোক ঢুকলেন, মোবাইলের ফরমায়েশ দিলেন, পকেট থেকে কার্ড বের করে পেমেন্ট করলেন এবং নতুন মোবাইলখানা প্যাকেটে ভরে চলেও গেলেন। উপস্থিত সেলসম্যানরা এই স্বল্প সময়ের মধ্যেও তাকে আহা উহু করে সম্মান জানাতে ভুল করলোনা। বলাই বাহুল্য, সেই বিশালদেহী ক্রেতা মানুষটির মোবাইলটির দামও সেইরকম বিশাল ছিলো।
অন্যদিকে দেখলাম এক মাঝবয়সি ভদ্রলোক মেয়েকে নিয়ে এসেছেন মোবাইল কেনার জন্য। কথা বার্তার ধরন শুনলেই বোঝা যায়, ভদ্রলোকের বাজেট খুব বেশি নয়। অনেক দিনের জমানো টাকা নিয়ে এসেছেন মেয়ের আবদার পূরণ করতে। অনেকক্ষণ ধরে তিনি একটা মোবাইলই পরখ করলেন। তারপর সেলসম্যনকে জিজ্ঞেস করলেন, একই ফিচারে এর চেয়ে কম দামে আর কোন সেট আছে কিনা।
সেই একই সেলসম্যান মুখে যতোটা বিরক্তি সম্ভব তারচেয়ে বেশি বিরক্তি দেখিয়ে উত্তর করলেন, না। এরপর দেখলাম সেই ভদ্রলোক বিমর্ষ মুখে পকেট থেকে টাকা বের করছিলেন। এর পরের দৃশ্য আর দেখা হলোনা। ততক্ষনে আমার বান্ধবীর ব্যাটারি কেনা শেষ। আমরা বের হয়ে বাসার পথ ধরলাম।
আসার পথে একবার মনে হল, ওই বিশালদেহী বিগ বাজেটের লোকটাও মানুষ ছিলো, আর এই মাঝবয়সী বাবাটাও একজন মানুষ ছিলেন, কিন্তু তারপরও কতো পার্থক্য এই দুইজনের মাঝে। না পার্থক্য এই দুইজনের আকার বা আচরণে নয়। পার্থক্য আমাদের দৃষ্টির, আমাদের মুল্যায়নে। হয়তো কয়েকদিন পর আমিও যখন কোন কর্পোরেট হাউজে ঢুকবো আমিও শিখে যাবো কিভাবে পার্থক্য করতে হয়। আমাদের সমাজ ব্যবস্থাই আমাকে শিখিয়ে দেবে।
থাক এতো ভারী ভারী কথা ভেবে কি হবে? আমি বরং আমার দারুন মুভিটার কথা চিন্তা করি। আর এটা তো জানা কথাই আমরা সবাই মানুষ তারপরও আমরা ঠিক এক নই। আমাদের মাঝে অনেক ভিন্নতা। এটা তো নগণ্য একটা উদাহরণ ছিলো মাত্র।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।