আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রান্না ভয়ংকর বান্না ভয়ংকর

দিতে পারো একশ ফানুস এনে...আজন্ম সালজ্জ সাধ একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই... আমি মনে প্রাণে বাঙালি। হু হু সব খারাপ গুণই আমার মাঝে চমৎকার ভাবে বিদ্যমান। একারনে খাবারের প্রতি আগ্রহ তো অবশ্যই আছে। তবে ক্রিটিক হয়ত বলা যাবে না, কারণ খাবার নিয়ে সেরকম ইতিহাসমূলক অথবা স্বাদমূলক তথ্য আমি দিতে পারবো না। মোগলাই পরোটা বসে বসে চিবুতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু কেউ যদি মোগলদের রান্নাশৈলী নিয়ে প্রশ্ন করে তবেই সেরেছে।

কোকের বোতল খোলার শব্দে আমি বিভোর হয়ে থাকি, কিন্তু কোক কি দিয়ে বানানো হয় তা নিয়ে কোন আইডিয়া নেই। তা যা হোক, এহেন মানুষের রান্নার প্রতি আগ্রহ থাকবে সেটাই স্বাভাবিক, নয় কি? উহু, সম্পূর্ণ ভুল উত্তর। রান্না বান্না নামক অপরিহার্য ব্যাপারটির প্রতি আমার রীতিমত ভীতি আছে। বলা মাত্র সরু মোটা ক্যানক্যানে সব জাতীয় সুর তুলে মানুষ চিৎকার দেয়, “কেন??” ঐ “কেন” এর জন্যই তো এই লেখা। ছোটবেলা থেকেই আগুনের প্রতি আমার কিঞ্চিত ভীতি আছে।

ম্যাচ এবং গ্যাসের চুলাকে আমার অলৌকিক বলে মনে হতো। আম্মু একটা বাক্সের সাথে একটা কাঠি ঘষা দিলেই দপ করে একটা হলদে শিখা জ্বলে ওঠে, যেটা ভুল করে ধরতে গিয়ে আমার আঙ্গুলে অনেক জ্বুলুনি হয়েছিল – স্মৃতিটা ফিকে হতে বেশ সময় নিয়েছে। এর মাঝে আমি আগুনের কাছে গেলেই আব্বু বিশাল হৈ চৈ বাঁধিয়ে দিতো। একারনেই এই দশা। কিন্তু মেডিকেলের একজন ছাত্রী ম্যাচ ধরাতে পারবে না ব্যাপারটা আম জনতার পক্ষে হজম করা একটু কষ্টকর বইকি।

বায়োকেমিস্ট্রি ল্যাব এবং পরীক্ষায় বন্ধুরা আজীবন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, আমি এক হাত দূরে থেকে অতিসাবধানে টেস্টটিউব হিট করেছি। কিন্তু ৪র্থ ইয়ারে একদিন বন্ধু সুস্মিতা ক্ষেপে গেলো। সেই কালদিনে ছিলো আমাদের পরীক্ষা, না খেয়েই পরীক্ষা শেষ করে মরার ঘুম দিয়ে উঠেছি রাত ১১টায়। এখন কি খাই? রুমে নুডুলস ছিলো। কিন্তু আগেরদিনই আমার গ্যাস লাইটারটা গেছে ভেঙ্গে।

আগুন না ধরিয়ে তো আর সিদ্ধ করা যাচ্ছে না। সুস্মিতাকে রিকোয়েস্ট করলাম, আগুন ধরায় দে। সে গেলো ক্ষেপে, “কেন তুই এখনো আগুন ধরাতে পারবি না? আজকে তোকে ধরাতেই হবে। ” আমি বললাম, “আমার ক্ষুধা নাই, যাই গা চকলেট খাই”। সে শুনলো না, জোর করে ম্যাচ ধরিয়ে দিলো হাতে।

কাঁপতে কাঁপতে এবং প্রায় ১০টির মত কাঠি নষ্ট করার পর আমি আগুন ধরাতে সক্ষম হলাম। আনন্দে আমি দুইটা লাফ দিলাম। যদিও আমি দূর থেকে কাঠি চুলার উপর ছুড়ে দেই বলে টার্গেটে না লাগলে আরো দুইটা কাঠি নষ্ট হয়, তাতে কি? আমি তো আগুন ধরিয়েছি! সুস্মিতা মহা রেগে বললো, “এত দিন পর ট্রাই করসোস কেন?” তাতে আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, সেই কাহিনী সে ভুললেও আমি তো ভুলতে পারিনা! ২০০৬ সালের এক কালদিন। আমরা মাত্র থার্ড ইয়ারে উঠেছি। সেদিনও ছিলো পরীক্ষা, এক টার্মের শেষ পরীক্ষা।

স্বভাবতই হলে ঐদিন হয় সবাই ঘুমে, নতুবা বাইরে। তখন ছিলাম আমি আলিম হলের নিচতলার কোণার এক ঘরে, তেলাপোকা আর কাকের সাথে সহবস্থানে। যাই হোক, টানা ১২/১৫ দিন পরীক্ষার পর সেদিন শর্মা হাউজের শর্মা খাবার জন্য আমার প্রাণে আর তর সইছে না। কিন্তু আমার রুম মেট আমাকে বুড়া আঙ্গুল দেখায়ে ঘোষনা দিলো সে যাবে ওয়েস্টার্ন গ্রিল, তার বয় ফ্রেন্ডের সাথে। মেজাজটাই গেলো খিঁচড়ে।

রাগ করে আমিও ঘোষনা দিলাম, “কি আছে জীবনে, আমি নাগেটস ভেজে রুমেই খাবো”। হিটার ব্যবহার হলে এখন নিষেধ হলেও প্রত্যেকের রুমে তখন হিটার ছিলো। আমার রুমমেট আবার সাজগোজে ভীষন এক্সপার্ট। আমি খানিক্ষণ বসে বসে তার জামা কাপড় এবং আইলাইনার আর শ্যাডোর কারুকাজ দেখলাম। এরপর যখন টের পেলাম সে গুন গুন করে প্রেমের গান গাইছে, মেজাজ গেলো আরো বিলা হয়ে।

হিটারে তেল গরম করতে দিয়ে আমি গেলাম বাইরে, খুন্তি ধুতে। গিয়ে এক দোস্তরে পেয়ে স্বভাবসুলভ গল্প জুড়ে দিলাম। এই কথা সেই কথা এবং আরো একশ কথার পর যখন রুমে ঢুকলাম, আমি তো হা। পুরা রুম কালো ধোঁয়ায় ভর্তি, আমি বিছানার মত বড় জিনিসটাও দেখতে পাছি না, এমন ধোঁয়া। কাশতে কাশতে অস্থির হতে আমি চিল্লা চিল্লি শুরু করলাম।

তখন দেখি ধোঁয়ার ভিতর থেকে আমার রুমমেট সাড়া দিলো, “কি রে? চেঁচাস কেন?” তার এক হাতে আইলাইনার, আরেকহাতে চিরুনী। প্রেম এমনই অন্ধ, যে সে রুমের মাঝে থেকে কাশতেছে অথচ ধোঁয়া কিসের, কোথা থেকে আসলো – এ ধরনের চিন্তা মাথায় নাই। আমি রাগে চিৎকার দিলাম, “ঐ বেকুব চশমা পড়। ধোঁয়া দেখিস না?” “ওওওওও, তাই তো বলি যে লাইনার লাগানোর সময় চোখ জ্বলে কেন। আমি তো ভাবলাম লাইনারের সমস্যা”।

এহেন উত্তর শুনে আমি কি বলব কিছুই স্থির করে উঠতে পারলাম না। কিছু বলার দরকারও হলো না, দপ শব্দে ভীষন রকম আগুন জ্বলে উঠলো। মুহূর্তের মাঝে লকলকে শিখা মেঝে থেকে টেবিলের উচ্চতায় উঠে এলো। আগুন দেখে গেলো আমার হাত পা অবস হয়ে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আমি পাশের দরজা এবং জানালার সিনথেটিক পর্দাগুলো টান দিয়ে সরিয়ে দিলাম যাতে আগুন না ছড়ায়।

তারপরে, “বাঁচাও, আগুন!” বলে মিনা কার্টুনের রাজুর মত চিৎকার শুরু করলাম। চিৎকার শুনে সবার আগে দৌড়ে এলো পাশের রুমের শমী আর কুলসুম। শমী ভয়ংকর পড়ুয়া, সোজা কথায় বললে আঁতেল। সে এসে আগুন দেখে বিলাপ করা শুরু করলো, “ওরে ত্রিনিত্রি, আগুন তো ছড়ায় যাচ্ছে রে। ওরে আমি কি করব? পড়ার টেবিলটা কি ঠেলে হল থেকে বের করবো? ওরে দাগানো বই ছাড়া তো আমি পড়তে পারিনা”।

আমার রুমমেট একটা রাম ধমক দিলো শমীকে। “ঐ পুরা হল পুড়ে যাবে, শালা আছোস তুই তোর গাইটন আর রবিন্স নিয়া?” (একটি ফিজিওলজী আর একটি প্যাথোলজীর বই) ধমক খেয়ে শমী থামলো। এর মাঝে আমি দেখলাম আমার গুরুত্ব কমে যাচ্ছে। “আমি শেষ, আর নাই” বলে চিৎকার দিয়ে আমি বোরিং হিন্দি সিনেমার নায়িকাদের মত পড়ে গেলাম। ধারে কাছে নায়ক না থাকায় বিছানার উপরেই পড়লাম।

এসব দেখে শমী গেলো আরো ঘাবড়ে। “পানি পানি” বলে চিৎকার দিতে দিতে সে ছুটে গেলো বাথরুমে। আমি পিছন থেকে আরো জোরে চেঁচাতে লাগলাম, “আরে ইলেক্ট্রিক আগুন, পানি দেয়া যাবে না”। কেউ শুনলো না। শমী বের হয়েই পেলো আমরিনের বালতি।

বালতিতে রাখা শ্যম্পু সাবান ইত্যাদি সে ছুড়ে বাইরে ফেললো। (করিডোরে না ফেলে সে কেন সব ছুড়ে বাইরে ফেললো এ নিয়ে পরে বিস্তর গবেষনার পরো আমরা কারণ উদ্ধারে ব্যর্থ!) বালতি ভর্তি পানি আনতে গিয়ে সে করিডোরে আছাড় খেয়ে পড়ে গেলো। এদিকে আগুন ততক্ষনে বেড়ে গিয়ে উপরের ইলেক্ট্রিক সুইচ প্রায় স্পর্শ করে করে অবস্থা। দরজার সামনেই আগুন, রুমে ঢোকাটাও এখন সমস্যা হয়ে গেছে। কুলসুম করিডোরে এই কুরুক্ষেত্র দেখে কোন এক্সপ্রেশন দেয়ার আগেই শমী তাকে কাতর কন্ঠে বললো, “প্লিজ, আমাকে পড়ে থাকতে দে।

তুই পানি নিয়ে হলটাকে বাঁচা”। করুণ এই ডায়লগ দেয়ার সময় নাকি আশে পাশের গাছ গাছালির প্রায় ১০টা কাক একসাথে কা কা করে ডেকে উঠেছিলো, কিন্তু উপযুক্ত সাক্ষী না থাকায় আমরা পরে তা প্রমাণ করতে পারিনি। কুলসুল “ইয়া আলি” বলে চিৎকার দিয়ে এক লাফে শমীকে পার হয়ে গেলো। কারন করিডোর বেশ চাপা, পাশ দিয়ে যাবার কোন উপায় নাই। এবং পানি ভর্তি বালতিসহ আবার সে প্রায় অসম্ভব একটা লাফ নিয়ে আমার রুমের সামনে পৌঁছালো।

এত হাউকাউএও তেমন কোন মানুষ জড় হলো না, কারন ফ্লোরের বেশীর ভাগ রুম তালাবদ্ধ। পানি আনার পরেও পানি ঢালা হলো না, কারন কুলসুম নিজেই চেঁচাচ্ছে, “আরে ইলেক্ট্রিক আগুনে পানি দেয়া যায় না, আমি আগেই জানতাম”। কিন্তু তারপরেও কেন পানি নিয়ে সবাই দৌড়াদৌড়ি করলো, আল্লাহ মালুম। এসময়ে ত্রাণকর্ত্রী হয়ে এলো সুস্মিতা। সে কুলসুমের রুমমেট।

সে বাইরে থেকে এসে এই হাউকাউ শুনে ছুটে এসে কিভাবে কিভাবে যেন আগুন বাঁচিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। টেবিলের ভাঙ্গা পায়া (যেটা চোখের সামনে পড়ে ছিলো অনেকক্ষণ) সেটা দিয়ে মেইন সুইচ টা অফ করেই আমাদের দুইটা তোয়ালে দিয়ে ধুমাধুম আগুনে বাড়ি দেয়া শুরু করলো। মাত্র ৫ মিনিটের মাথায় আগুন নিভে গেলো। এত সহজে এই আগুনের নিষ্পত্তি ঘটানো সম্ভব – সেটা চোখের সামনে দেখেও আমরা কেউ বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মচকানো পা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে শমী এসে শেষ ডায়লগ দিয়ে নাটকের পর্দা নামালো, “আরে আমি তো আগেই জানতাম।

এই ত্রিনিত্রিটাই বেশী চেঁচামেচি করে ঝামেলাটা বাঁধায়”। কিছুক্ষণ পর অবশ্য কিছু বড়আপু এবং জুনিয়র জুটে গিয়েছিলো, কিন্তু বুদ্ধিমান এক বড় আপু সবাইকে, “কিচ্ছু হয় নি, যাও” বলে ভাগিয়ে দিলেন। কারণ এই কাহিনী যদি ফাঁস হয়, তবে হিটার আমাদেরটা তো যাবেই, পুরো হলের সবার লাইনই কেটে দেবে। এই কাহিনী ঘটার পর থেকে আমি দুইটা ব্যাপার থেকে চরম সাবধান-- ১। হিটার ২।

প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া মানুষ। আপনারা কেউ বিশ্বাস করেন আর না করেন, যারা আগুন নিয়ে খেলে আর যারা অন্ধের মত প্রেম করে – দুই গ্রুপই সমান বিপদজনক। হু হু, খুব খিয়াল কৈরা থাইকেন, ত্রিনিত্রির কথা বাসী হইলে ফলে। ২০০৮ এর সেপ্টেম্বরঃ ছোট কাজিনের ১৪তম জন্মবার্ষিকী। কেকের চারপাশে ছোট ছোট ১৪টা মোম বসানো।

আমি ম্যাচ হাতে নিয়েই বড় কাজিনটা একটু অবাক হয়ে তাকালো। সবাই জানে আমার কান্ড কারখানা। আমি হাসিমুখে একটা মাত্র কাঠি দিয়েই সবগুলি মোম ধরিয়ে ফেললাম। সুস্মিতা থাকলে নিশ্চই সে একটা চোখ টিপ দিতো। হাহাহা।

 ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।