'জীবন' হলো এক কাপ গরম চা আর একটা জ্বলন্ত বেনসনের মতো। গরম চা একসময় জুড়িয়ে যাবে, বেনসনের তামাকও পুড়ে শেষ হয়ে যাবে। প্রতিদিন টিভি চ্যানেলগুলো খুললেই সংবাদ এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানগুলোতে দেশ-বিদেশের বিখ্যাত সব ব্যক্তিবর্গের সাক্ষাতকার অনুষ্ঠান প্রচারিত হতে দেখি। সৎ হোক কিংবা অসৎ - সংবাদমাধ্যমগুলো যেন রাজনীতিবিদ বা অন্যান্য সেলিব্রেটিদের সাক্ষাতকার নেবার জন্যে উদগ্রীব হয়ে থাকে। কর্মক্ষেত্রে আমি নিজে কোন সাংবাদিক নই।
তারপরেও কাজের সুবাদে বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরির করে বারো-রকম মানুষের সাথে মেশার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।
আমার খুব প্রিয় অভ্যাসগুলোর একটি হলো মানুষকে 'অবজারভ' করা, যতটুকু সূক্ষ্মভাবে দেখা সম্ভব আমার পক্ষে, ঠিক ততটুকুই সেই মানুষটির কাছাকাছি গিয়ে তাকে অবলোকন করা। না, এই মানুষগুলোর কেউ-ই 'বিখ্যাত' নন। তাদেরকে প্রতিদিন কেন, কোনদিনই জাতীয় প্রচারমাধ্যমগুলোতে দেখায় না, কিংবা দেখানোর সুযোগ নেই।
আজ এরকমই অখ্যাত, সাধারণ একজন খেটেখাওয়া মানুষের সাক্ষাতকার নিলাম, যিনি বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য বাস কোম্পানী 'গ্রীনলাইন পরিবহন'এর 'প্যাসেঞ্জার গাইড' হিসেবে কর্মরত।
নাম তার মাহফুজুল কবির। বছর পঁচিশেক এক তরুণ যুবক, বাড়ি নরসিংদী। পাঠক হয়তোবা অবাক হচ্ছেন এই ভেবে যে, সামান্য একজন 'প্যাসেঞ্জার গাইড' -এর সাক্ষাতকার নেবার আবার কি আছে? হ্যাঁ, অনেকের কাছেই বাংলাদেশের দুর্ণীতিবাজ রাজনীতিবীদদের সাক্ষাতকার নেওয়াটা হয়তো তার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একবারও কি আমরা সমাজের এইসব খেটে খাওয়া মানুষের খুব কাছে গিয়ে তাদের কথা শোনার চেষ্টা করেছি? কখনও কি তাদের বোঝার চেষ্টা করেছি? ট্রাভেল শেষ হবার পর বাস থেকে নেমে যাবার সময় একবারওকি কেউ কখনও এতক্ষণ ধরে চালিয়ে আসা বাসের ড্রাইভার সাহেবকে একটা 'ধন্যবাদ' জানিয়েছি সুন্দরভাবে বাসটি চালিয়ে আসার জন্যে? অথচ রাস্তায় চালানের সময় ভুল হলে ঠিকই কিন্তু ড্রাইভারের কঠোর সমালোচনা করতে আমরা পিছপা হইনা কেউ। ভুল কাজের জন্যে আমরা অপরকে দোষ দেই, কিন্তু ভালো কাজের জন্যে 'অ্যাপ্রিসিয়েশন' এর বড় অভাব আমাদের মাঝে।
আমাদের বাংলাদেশীদের ডিকশনারীতে 'কংগ্র্যাচুলেশন' বা 'অভিনন্দন' শব্দটা মনে হয় নেই।
**********************
মাহফুজের সাক্ষাতকার নেবার সূত্রপাতটা অনেকটা এরকম:
কাজের প্রয়োজনেই 'গ্রীনলাইন পরিবহন'এর বাসে ঢাকা-সিলেট রুটে ট্রাভেল করছিলাম। আশুগঞ্জের 'রাজমণি' রেস্টুরেন্টে বিশ্রামের পর আমাদের এসি বাস আবার চলা শুরু করলে আমার পাশের খালি সিটে এসে বসলেন মাহফুজ। চোখেমুখে তার ক্লান্তির স্পষ্ট ছাপ। বাসে ট্রাভেল করলেও আমি সাধারণত পাশের সিটের যাত্রীর সাথে খুব কম কথা বলি।
কিন্তু আজ এর ব্যতিক্রম ঘটলো। মাহফুজের সাথে কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ ভালো একটা আড্ডা জমে উঠলো। আর এই ফাঁকে তার থেকে জেনে নিলাম 'প্যাসেঞ্জার গাইড'দের জীবন কাহিনী। তাঁর অনুমতিক্রমেই আজকের এই সাক্ষাতকারটি প্রকাশিত হলো।
জনাব মাহফুজ
আমি: কদ্দুর পড়ালেখা করেছেন?
মাহফুজ: ম্যানেজমেন্টে অনার্স পর্যন্ত পড়েছি।
আমি: এই পেশায় কদ্দিন হলো আছেন?
মাহফুজ: গ্রীনলাইনে 'প্যাসেঞ্জার গাইড হিসেবে কাজ করি প্রায় সাড়ে তিন বছর হলো। তবে এর মধ্যে অন্যান্য বাস কোম্পানীগুলোতেও গাইড হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে।
আমি: আপনাদের স্যালারী স্ট্রাকচারটা কি রকম?
মাহফুজ: গ্রীনলাইনের এসি বাসগুলোতে ঢাকা-সিলেট বা ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে 'রাউণ্ড ট্রিপ' এর জন্য ৪০০/= টাকা করে পাই। আবার ঢাকা-কক্সবাজার 'রাউণ্ড ট্রিপ' এর জন্য ৬০০/= টাকা করে পাই। এছাড়া শুধু ট্রিপের সময় যে রেস্টুরেন্টে বাস বিশ্রামের জন্যে থামবে, সেখানে আমার, ড্রাইভার এবং হেলপারের সকালের নাস্তা বা দুপুরের খাওয়া বা রাতের খাওয়াটা ফ্রি।
আমি: অন্য বাস কোম্পানীতে কাজ না করে গ্রীনলাইনে কাজ করার কারণ কি?
মাহফুজ: গ্রীনলাইনে কাজ করছি বেশ অনেকদিন হলো। কিন্তু অন্যান্য কোম্পানীতে আমি কমবেশি পরিচিত বলে তাদের প্রয়োজনেও কাজ করে দিয়েছি। তবে গ্রীনলাইনকে বেছে নেবার কারণ হলো এখানে কাজ করাটা অন্যান্য কোম্পানীর থেকে 'ফ্লেক্সিবল'। অর্থাৎ, যিনি প্যাসেঞ্জার ইনচার্জ, তিনি আমাদের প্যাসেঞ্জার গাইডদের সুযোগসুবিধা দেখেন, আমার সুবিধা অনুযায়ী ডিউটি নিতে পারি, যেটা অন্য কোন কোম্পানীতে হয়না। যদিও কোন কোন কোম্পানীতে বেতন বেশি দেয়, কিন্তু অন্যান্য সুবিধা নেই।
যেমন, সোহাগ পরিবহনেও গ্রীনলাইনের সমান বেতন, কিন্তু অন্য কোন সুবিধা নেই। আবার 'টি.আর ট্র্যাভেলস' কোম্পানীতে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে 'রাউণ্ড ট্রিপ' এর জন্য ৫০০/= টাকা এবং ঢাকা-কক্সবাজার 'রাউণ্ড ট্রিপ' এর জন্য ৮০০/= টাকা করে দেয়। কিন্তু ট্রিপ কম এবং কোম্পানী নির্ধারিত ট্রিপ অনুযায়ী ডিউটি করতে হয়, যেখানে গ্রীনলাইনের বাস সংখ্যা বেশি (প্রায় ১০০ এর উপরে), কাজেই ট্রিপও বেশি।
আমি: একজন প্যাসেঞ্জার গাইড হিসেবে আপনার মূল দায়িত্ব কি কি?
মাহফুজ: নির্ধারিত ট্রিপ শুরুর আগে অফিসে রিপোর্টিং করে 'শিডিউল বোর্ড' থেকে বাস নম্বর, চালকের নাম এবং আমার নির্ধারিত ট্রিপটি সম্পর্কে নিশ্চিত হই। এরপর অ্যাকাউন্টস সেকশনে গিয়ে যাত্রাপথের প্রয়োজনীয় খরচের জন্যে (যেমন টোল প্রদান) 'রুট কস্ট' বাবদ অ্যাডভান্স টাকা নেই।
তারপর মিনারেল ওয়াটার, টিস্যু, পলিথিন ইত্যাদি নিয়ে বাসে উঠে নির্ধারিত সময়ে যাত্রা শুরু করি। যাত্রা শেষে আবার অ্যাকাউন্টস-এ গিয়ে সকল বিল জমা দেই এবং এই ট্রিপের ড্রাইভার, হেলপার এবং আমার প্রাপ্য টাকা ক্যাশ বুঝে নেই। গ্রীনলাইনের একটা রাউণ্ড ট্রিপে ড্রাইভার পায় ১২০০ টাকা আর হেলপার পায় ৩৫০ টাকা।
আমি: গ্রীনলাইনে কাজ করার শুরুটা কেমন ছিল?
মাহফুজ: গাইড হিসেবে কাজ করার আগে আমি বাসে অনেক ভ্রমণ করেছি। আমার সবসময়ই ইচ্ছা ছিল এমন একটি কাজ করবো, যেখানে কাজের প্রয়োজনেই দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াতে পারবো।
অন্য কোন সুযোগ না থাকায় গ্রীনলাইনে আমার জীবন বৃত্তান্ত জমা দেই। তারা আমাকে ডাকে। বিশ দিনের একটা ট্রেনিং শেষে ১০,০০০/= টাকা রিফাণ্ডেবল সিকিউরিটি মানি জমা দিয়ে আমি গাইড হিসেবে ঢুকি।
আমি: গাইড হিসেবে কাজ করা কালীন এ পর্যন্ত স্মরণীয় কোন ঘটনা মনে পড়ে কি?
মাহফুজ: একবার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসার পথে ভোর পাঁচটায় 'অফবিট' রেস্টুরেন্টে বিরতি নেবার পর আমাদের বাস নষ্ট হয়ে গেল। তখন ওই রেস্টুরেন্টে গ্রীনলাইনের আরও ৫ টি বাসের যাত্রীরা ছিলেন।
কিন্তু আমাদের বাসের যাত্রীরা ভালো একটি বাস না আসা পর্যন্ত ওই বাসগুলোকেও ঢাকা আসতে দেবেন না। এই নিয়ে আমাদের বাসের যাত্রীদের সাথে আমার, ড্রাইভারের এবং হেলপারের কথা কাটাকাটি থেকে হাতাহাতি পর্যন্ত হয়। অবশেষে চট্টগ্রাম থেকে ভালো একটি বাস আসার পর আমাদের নষ্ট বাসটির যাত্রীদেরকে ওই বাসটায় তুলে ঢাকা নিয়ে আসা হয়। রাস্তায় বাস নষ্ট হয়ে যাত্রীরা বুঝতে চায়না। ভাবে আমাদের ইচ্ছাকৃত দোষ।
তখন গাইড হিসেবে আমাকেই এই সমস্যগুলো মোকাবেলা করতে হয়।
আমি: গাইড হিসেবে কাজ করতে গিয়ে কি ধরনের চ্যালেঞ্জ-এর মুখোমুখি হতে হয়?
মাহফুজ: নাইট কোচগুলোতে ডাকাতির সম্ভাবনা বেশি থাকে। আর সড়ক দুর্ঘটনার ভয়তো আছেই। কিছুদিন আগেইতো সোহাগের একটা বাস সকাল বেলায় ঢাকা-সিলেট রুটের নরসিংদীতে দুর্ঘটনায় পড়ে ১৩ জন মারা গেল।
আমি: মাহফুজ, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে সময় দেবার জন্যে।
মাহফুজ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
পুনশ্চ: আমার কলিগ জনাব আনসার আহমেদ সিদ্দিকি এই লেখাটি পড়ার পর আমাকে লেখার শিরোনাম নিয়ে তার মতামত ব্যাক্ত করেছেন। তাঁর মতে 'একজন অখ্যাত ব্যক্তির একটি অপ্রয়োজনীয় সাক্ষাতকার' -এই শিরোনামটি ব্যবহার করে আমি জনাব মাহফুজের প্রতি 'জাজমেন্টাল' হয়েছি। আমি মাহফুজকে অখ্যাত ব্যাক্তি বলেছি, যেটা অনুচিত হয়েছে। কাউকে 'অখ্যাত' বলাটা কতটুকু সমীচিন তা নিয়ে আনসার ভাই প্রশ্ন তুলেছেন।
আনসার ভাইয়ের বক্তব্যের সাথে সহমত পোষণ করে যদি শিরোনামটি কাউকে আঘাত করে, তবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।