http://rmpalash.blogspot.com/ ১৭ই এপ্রিল,২০০৯।
-------------------
ঘড়ির কাটা তখন সাড়ে-বারোটা পার হয়েছে। বৈশাখ মাসের প্রচন্ড আর ভ্যাপসা গরম। সেই গরমে আমরা দুই বন্ধু আমি আর ইফতি ঢাকা ভার্সিটি এরিয়ায় সকাল থেকে একটানা ঘোড়াঘুড়ি করে ক্লান্ত-শ্রান্ত এবং বিধ্বস্ত হয়ে ডাকসু ক্যাফেটেরিয়া ঢুকেছি। সারা সকাল একটানা ঘোরা-ফেরা করার কারনে উভয়ই অধিক পরিমানে ক্ষুধার্ত।
ক্যান্টিনের ভিতরে খুবই ভীড়। সেই ভীড়ে অনেক কষ্টে একটা টেবিল ফাকা পেয়ে দুজনে বসে পড়লাম। এত পিপাসা পেয়েছিল একগ্লাস পানিতে মিটলোনা। দুই গ্লাস পানি খেয়ে পিপাসা কিছুটা কমলে তারপরে কুপন কিনে খাবার নিলাম।
অধিক ক্ষুধার কারনে খুবই দ্রুত খাবার শেষ হল।
দুনিয়াতে মানুষের বিভিন্ন ধরনের কষ্ট থাকে। কিন্তু একটা মানুষের সব কষ্ট ভুলিয়ে দিতে হলে তাকে শুধু না খাইয়ে রাখলেই চলবে। ক্ষুধার তাড়নায় বাকি কষ্ট সে ভুলে যাবে। তার মাথায় তখন থাকবে শুধু খাবারের চিন্তা,কিভাবে খাবার জোগাড় করা যায়। ক্ষুধার তাড়নায় মানুষ মানুষের মাংসও খেতে বাধ্য হয়,এ এমনি এক অনুভুতি যার তীব্রতার কাছে বাকি সব পরাজিত।
খাবার খেয়েছি। ক্ষুধা মিটেছে। এখন বাকি ইন্দ্রিয় গুলো আবার চালু হয়েছে। পৃথিবীর রুপ রস গন্ধ এখন আবার আমাদের দোলা দিতে শুরু করেছে। ক্যাফেটেরিয়া থেকে বের হতে হঠাৎ এক ঝিরঝিরে হাওয়া আমাদের এলোমেলো করে দিয়ে গেল।
দুপুরের তীব্র গরমে ভরপেট খাওয়ার পরে এইরকম বাতাসের পরশ পাওয়ার সুখ বেহেস্তে মিলবে কিনা সন্দেহ আছে। বাসায় এসি লাগিয়ে তাপমাত্রা শুন্যের কাছাকাছি নিয়ে আসা যাবে। চাই কি একাধিক পাখা লাগিয়ে উড়ে যাওয়া যাবে। এ অনুভুতি আসবেনা। এরকম দমকা হাওয়াতো কতসময়ই বয়।
সেই সব সময়ে কি এই অনুভুতি আসে?না। এ শুধু এই সময়ের জন্যেই। এইরকম উদাস দুপুরে ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত শরীরে ভরপেট খেয়ে বেরোনোর সাথে সাথেই এই রকম এক ঝিরঝিরে অনুভুতি আর নেই। পেতে হলে এই সময়ে এইখানে এই অবস্থায়তেই বর্তমান হতে হবে। অন্যখানে অন্যকোন সময়ে অন্যকারো দ্বারা এই জিনিস অনুভব করা সম্ভব না।
হাটতে হাটতে ভার্সিটির সেন্ট্রাল মসজিদের দিকে চলে আসলাম। বিশাল বিশাল সব আম গাছের সুখকর ছায়া। এই রকম এক ছায়ার নিচে থামলাম। কোথায় যেন কোকিলের ডাকের শব্দ পেলাম। ফাল্গুন শেষ হয়ে গেছে।
এই সময়ে কোকিলের ডাক কেমন যেন অদ্ভুত সুন্দর এক ভাললাগায় আমাকে গ্রাস করলো। কিছু কিছু সময় থাকে যখন সব কিছু ভাল লাগে। তখন মানুষ যা দেখে তাতেই উৎফুল্ল হয়। অনেক ছোটখাট ব্যাপারও তখন তাকে ছুয়ে যায়। আমার এখন সেই অনুভুতি।
আমার মনে হয় আমার সবচেয়ে শত্রু যদি এই অবস্থায় সামনে এসে দাঁড়ায় তাকে দেখে আমার রাগ হবে না। হয়তো মিষ্টি হাসি দিয়ে তাকে চা খাইয়ে দেব। এখন আমার ভাল লাগার সময়। আম গাছের কচি পাতায় লাল রঙের পোকা দেখে তাকে নিয়ে কাব্য লেখার এখনই সময়।
ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে ভাল লাগছিল।
দাড়িয়ে দাডিয়ে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম। সেই আলোচনা কোথায় শুরু কোথায় শেষ তার কোন আগামাথা নেই। আলোচনা জমে উঠছে। সবে মাত্র বাংলা সাহিত্যে মার্ক্সীয় দর্শনের বিষয়ে ঢুকেছি। আমি ইঞ্জিনিয়ারিং স্টুডেন্ট।
সাহিত্যের কাঠখোট্টা এইসব ব্যাপারে আমি বড়ই আনাড়ি। আমার আগ্রহ নেই। কিন্তু আমার ভার্সিটি পড়ুয়া ফ্রেন্ডের এই ব্যাপারে অসীম জ্ঞান,তার মতে। এবং সে সেই জ্ঞানের কিয়দাংশ আমাকে দেবার উদ্দেশ্যে কেবল শুরু করেছে। এইসময় একটা ছেলে আমাদের সামনে এসে দাড়ালো।
চেক শার্ট। ঢাকা কলেজের উলটা দিকের ফুটপাতে এইসব শার্ট পাওয়া যায়। কালো একটা প্যান্ট। পায়ে বাটার স্যান্ডেল। আমরা বলি জামাই স্যান্ডেল।
সবকিছু মিলে এক নিদারুন দৈন্যতা।
আমি কখনো মানুষের পোশাক আষাকের দিকে খেয়াল করিনা। সারাদিন কারো সাথে ঘোরাঘুরি করার পরে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে আমার সংগী কি রঙের পোষাক পরে ছিল,আমি উত্তর দিতে পারবোনা।
কিন্তু এই ছেলেটার সবকিছু আমার মনে আছে। মনে আছে তখন একটি পিপড়ে আমার ডান পায়ে কামড় দিচ্ছিল আর আমি বাম পায়ে সেটাকে পিশে মারার চেষ্টায় লিপ্ত ছিলাম।
আমাদের পাশে একটা রিকশা থেমেছিল। সেই রিকশার একটি হুড ভেঙ্গে বের হয়েছিল আর রিকশাচালক সেটাকে টেনে ভিতরে ঢুকানোর চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। সব কিছু ছাপিয়ে আমার চোখে ভাসে তার চোখজোড়া। মলিন মুখের শুকনো কোটরে জ্বলজ্বল করে জ্বলন্ত এক জোড়া চোখ।
-ভাইয়া একটা কথা বলবো?
কথার মাঝখানে হঠাৎ করে বাধা পড়ায় দুইজনেই তার দিকে তাকালাম।
সে তখন মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। আমার বন্ধুটি খুবই বিরক্ত। সেটা খুবই সাময়িক এবং মেকী। সবসময় সবকিছুতে সাময়িক বিরক্তিকে সে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। সুতরাং তার বিরক্তি আমি আমলে নিলাম না।
কিন্ত তাকে বিরক্ত দেখে ছেলেটা আরো কুকড়ে গেলো।
-হ্যা বলো।
ছেলেটা চুপ করে রইলো। হয়তো মনের গভীরে হাতড়ে খুজছে লাগসই কোন শব্দ।
-কথা বলছোনা কেন?কি সমস্যা?
ইফতির মুখে স্পষ্ট বিরক্তি।
আমি নিজে এইসময় ইফতির উপর বিরক্ত হলাম। এমনিতেই ছেলেটা কুকড়ে আছে। তার সাথে তার এই ধরনের আচরনে ছেলেটার মাটিতে মিশে যাবার জোগাড়।
-ভাইয়া আমি ভার্সিটিতে পড়ি। ইতিহাস।
ফার্ষ্ট ইয়ার।
-কোন হলে থাকো?
-বংগবন্ধু হলে।
-গনরুম?
-জ্বী ভাইয়া।
-আচ্ছা ঠিক আছে। এইবার বলো তোমার কি সমস্যা?আমরা কি তোমাকে কোন হেল্প করতে পারি?
-ভাইয়া আমাকে কি ত্রিশটা টাকা দিতে পারবেন?আমি দুইদিন যাবত একদম না খেয়ে আছি।
আমার কাছে কোন টাকা নেই। আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে। কষ্ট হচ্ছে অনেক। প্লীজ ভাইয়া। আমি সত্যি বলছি।
এই যে দেখেন আমার আইডি কার্ড। আমি ভিক্ষুক নই। আমার আইডি কার্ডটা আসল। আমি সত্যিই এখানকার ছাত্র। ভাইয়া প্লীজ আমাকে টাকাটা দিন।
আমার অনেক খারাপ লাগছে ভাইয়া।
ছেলেটা আসলে এগুলোই বলতে চেয়েছিল কিন্তু তার মুখ দিয়ে এত সাজানো গোছানো কথা বের হয় নি। যা বের হয়েছিল তা হলো এলোমেলো কিছু আকুতিময় করুন বাক্যসমষ্টি,আমরা সেই এলোমেলো বাক্যগুলো থেকে আসল জিনিস বের করে বুঝে নিতে পেরেছিলাম। তাকে আর জেরা করার দরকার হয়নি। তার আইডি চেক করার ও দরকার হয়নি।
তাকে কেন্টিনে নিয়ে ভাত খাওয়ালাম। গোগ্রাসে খাওয়া। ক্ষুধার্ত মানুষের খাওয়া একই সাথে সুন্দর আর অসুন্দর। খুবই দ্রুত খাওয়া দেখতে বিরক্ত লাগলেও খাবারের প্রতি ভালবাসাময় একনিষ্ঠ মনোযোগ মন কেড়ে নেয়। ছেলেটার কষ্ট কতটা হয়েছে তার সামান্যই বুঝতে পারছিলাম।
কিছুক্ষন আগে সামান্য কয়েকঘন্টা হেটেই আমাদের ক্ষুধার জ্বালায় যে অবস্থা হয়েছিল আর এই ছেলেতো দুইদিন ধরে না খাওয়া!
একসময় ছেলেটার খাওয়া শেষ হলো। তাকে নিয়ে টিএসসিতে বসলাম। চা খেতে খেতে গল্প করলাম।
“আদমপুর গ্রামের দরিদ্র ভ্যানচালক বকরমিয়ার তিনছেলেমেয়ে। প্রত্যন্তগ্রাম আদমপুরের অন্য সবার মত বকর মিয়া এবং তার স্ত্রীও নিরক্ষর।
তার মেয়ে গুলোও তাই। কিন্তু সকল নিয়মকে বেয়াদপের মত ভেংগে তার ছেলে সোলেমান অক্ষরজ্ঞান শিখে ফেললো এলাকায় নতুন প্রতিষ্ঠিত এনজিও স্কুলে। শুধু তাই নয় সে সাহেবদের ভাষা ইংরেজিও পড়তে পারে। বকরমিয়ার খুশি আর ধরেনা। ছেলে শিক্ষিত হয়ে গিয়েছে!
কিন্তু ছেলে এবং তার এনজিও স্কুলের আপারা এই অল্প শিক্ষায় খুশি নয়।
তারা চায় তার ছেলে আরো শিক্ষিত হয়ে এলে-বিএ পাস করে জজ-ব্যারিষ্টার হোক। তাদের জোড় প্রচেষ্টায় সোলেমান তিনমাইল দুরের সোনাগঞ্জের রেজিঃ প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হল। একসময় সে প্রাইমারি শেষ করে হাইস্কুলে উঠে গেল। প্রাইমারিতে পেল বৃত্তি। ক্লাস এইটে ও বৃত্তি নিয়ে সে একসময় এসএসসি পরীক্ষা দিল।
জিপিএ ৪ নিয়ে পাস করে সে ভর্তি হয় কলেজে এবং সে এইচএসসি পাস করে জিপিএ ৫ নিয়ে।
তার ইচ্ছা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। বকর মিয়া তাকে এতদুরে যেতে দেবেননা। তাছাড়া টাকাই কে দেবে?বকর মিয়ার স্ত্রী সালেহা বেগম মায়ের কাছ থেকে পাওয়া একমাত্র স্বর্নের চেইন বিক্রি করে টাকা তুলে দিলেন ছেলের হাতে। ছেলে সেই টাকা নিয়ে ঢাকা গেল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হল।
এর কিছুদিন পরে বকরমিয়া মারা গেলেন ভ্যান এক্সিডেন্ট করে। দুই দুইটা মেয়ে নিয়ে সালেহা বেগম চোখে আধার দেখলেন। ছেলে সোলেমান ঢাকায়।
সোলেমান আশা করেছিল ঢাকা শহরে আসলে কোননা কোন ভাবে একটা কিছু ম্যানেজ হয়ে যাবে। যা দিয়ে সে নিজে চলতে পারবে।
কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সে এ কয় মাসে বলার মত কোন ব্যবস্থাই করতে পারেনি। একটা টিউশনি পেয়েছিল। গত মাসে সেটা চলে যায়। এই কয়দিন সে কোন রকম ধার দেনা করে চলছিল। তিন চারদিন ধরে তার হাতে কোন টাকাই নেই।
তার হাতে একটা অপশন আছে। হলের ক্ষমতাশীন ছাত্রসংগঠনের সাথে হাতমেলালে তাকে গনরুমে থাকতে আর ক্যান্টিনে ফ্রী খেতে দেয়া হবে। মাঝে মাঝে সে এই কাজ করেছেও। কিন্তু প্রতিদিন মিছিল-মিটিং করে সে পড়ালেখা করতে পারছেনা। আর তার এগুলো ভাল লাগেনা।
সে পড়ালেখা করতে চায়। রাজনীতি করতে চায় না। এই জন্যে সে গত কয়েকদিন মিছিলে যায় নাই। গেষ্টরুমেও না। যার কারনে তার খাওয়া বন্ধ ছিল।
তাকে হয়তো গনরুম থেকেও বের করে দিতে পারে। “
“বাড়িতে মা আর দুই ছোটবোন আছে। বাবা থাকতে তাও যেভাবে সংসার চলতো। এখন তারা কেমন আছে,কি খাচ্ছে কিছুই জানিনা। অনেকদিন বাড়ি যাই না।
বাড়ির কথা ভাবলে নিজেকে অসহায় মনে হয়। তারা হয়তো আমার আশায় বসে আছে। কিন্তু আমি কি করতে পারি?আমি নিজেই দুইদিন ধরে না খাওয়া।
কয়েকজন আমাকে রাতে তাদের সাথে বাইরে যেতে বলেছে। বলেছে টাকার অভাব থাকবেনা।
আমি তাদের সাথে যেতে চাই না। আমি ভার্সিটির ছাত্র,ছিনতাই করবো কেন?
এখন আমার আসলে কিছুই করার নেই। ভাবছি বাড়ি চলে যাব। লেখাপড়া এখন আমার কাছে বিশাল এক বিলাসিতা। তিনজন মানুষ সাথে আমার নিজের জীবন যখন অস্তিত্বসংকটে তখন এই বিলাসিতা আমাকে মানায় না।
দেখি ইন্টারমিডিয়েট সার্টিফিকেট দিয়ে কোন এনজিওতে কাজ পাই কিনা। না পেলে বাবার ভ্যান নিয়েই নামতে হবে। “
আমাদের দুইজনে পকেটে বেশি টাকা ছিলনা। আমরা নিজেরাও ছাত্র। আসল কথা আমরা তারচেয়ে একবছরের সিনিয়র।
কত টাকাই আর থাকবে। যা ছিল তা থেকে কিছু টাকা তাকে দিলাম। কিন্তু কোন আশার কথা শুনাতে পারলাম না। তাকে টিএসসিতে বসিয়ে রেখে আমরা উঠে চলে আসলাম।
ডিসেম্বর ২০০৭।
----------------------------------------
কয়েকদিন আগে বুয়েট ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। স্বপ্নের সাবজেক্ট ইলেক্ট্রিকালে চান্স পেয়েছি। পিকনিক মুডে বাকি যেসব জায়গায় পরীক্ষা দিয়েছিলাম সেখানেও প্রথম দিকে আছি। মনে অনেক আনন্দ। বুয়েটে ভর্তি হবার পর ক্লাস চালু হবার মাঝে কিছুদিন বন্ধ।
খুলনা মামার বাড়ি গেলাম। প্রভুত আনন্দ-ফুর্তি করলাম। মামা নতুন বাড়ি বানাচ্ছে। হৈ-চৈ করে কেটে গেল কয়েক দিন। বুয়েটে ভর্তি হয়েছি কম্পিউটার থাকবেনা?আর সবার কম্পিউটার থাকলে আমার লাগবে ল্যাপটপ।
মামাকে বললাম মামা ল্যাপটপ কিনে দেন।
সাধারনত মামার কাছে কিছু চাইলে পাওয়া যায়। কিন্তু তখন বাড়ি বানাতে মামার অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। আর ঐ সময়ে একটা ভাল ল্যাপটপের দাম লাখের কাছাকাছি ছিল। মামার পক্ষে এত টাকা দিয়ে আমাকে তখন ল্যাপটপ কিনে দেয়া দুরুহ ছিল।
তারপরেও তিনি আমাকে না করলেন না। বললেন যে মাসদুয়েক অপেক্ষাক করতে। তখন কিনে দেবেন।
আমি মনে করলাম মামা ঘু্রিয়ে না করে দিয়েছেন। ব্যাপারটা আমার আতে লাগলো।
আমি একটা ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট। একটা জিনিস চাইলাম। উনি না করে দিলেন!এত অপমান। আমার রাগ এখনো কমেনি। ঐ ঘটনার পরে আমি মামার বাড়িতে আর যাই নি।
আমি যখন ছোট ছিলাম
--------------------------------------
মা বার বার করে বলে দিত কারো কাছে কিছু চাইবিনা। কেউ কিছু দিলে খাবিনা। তাও মার নির্দেশ ব্রেক করে কারো কাছ থেকে কিছু একটা নিয়ে মায়ের হাতে অনেক মার খেয়েছিলাম। সেই মার খাওয়ার পরে কারো কাছে কিছু চাইবার আগে দুইবার ভাবি। আর অনভ্যাসবশত মানুষের কাছে কিছু চাইতে ভাল লাগেনা।
----------------------------------------------------------------------------
ঢাকা ইউনিভার্সিটির একটা ছাত্র। আমার থেকে একবছরের ছোট। সোলেমান নাম। মামার কাছে ল্যাপটপ চেয়ে না পেয়ে আমি তার বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করেছি। আর এই ছেলে শিক্ষা এবং বয়সের দিক থেকে যে আমার সমান সম্মানের দাবীদার আমার কাছে মাত্র ত্রিশ টাকার জন্যে হাত পাতছে।
আমার কাছে টাকা চাইবার আগে হয়তো আরো কারো কাছে সে টাকা চেয়েছিল,প্রত্যাখাত হয়েছে। তার কাছে কি খারাপ লাগেনি?মানুষের সামনে হাতপাতা আর মাথা নত করার মত এত কষ্ট আমার শত্রু পাক আমি তাও চাই না। আমি নিজেকে যখনই তার অবস্থানে কল্পনা করি আমি ভাবতে পারিনা। দুই দিন ধরে না খেয়ে আছি,পেট চো চো করছে। পা চলছে না।
হাতপা অসাড় হয়ে আসছে। মসজিদের সামনে আম গাছের নীচে দুইজন দাঁড়িয়ে গল্প করছে। আমি তাদের মাঝে গিয়ে দাড়িয়েছি। বলছি
“-ভাইয়া একটা কথা বলবো?”
মানবতার এত নিষ্ঠুর অপমান আমি কি করে সইবো!
সে সময় ছেলেটার জন্যে আমরা কিছু করতে পারিনি। এ জন্যে অপরাধবোধ আমাদের তাড়া করে।
ঢাকা ইউনিভার্সিটির দিকে গেলে আনমনে খুজি সোলেমান নামের সেই ছেলেটাকে। না সে কোথাও নাই। কার্জন হল,টি এস সি,চারুকলা,ডাকসু। কোথাও তাকে পাই না। তার সাথে আমার আর দেখা হয় না।
আনমনে ভেসে ওঠে সেই আদমপুর নামে কোন এক গ্রামের ছবি। মাটির রাস্তা। মাথার উপরে সুর্য্য। হঠাৎ দেখি টুংটাং করে বেল বাজিয়ে এগিয়ে আসছে একটা ভ্যান। ভ্যান চালকটিকে আমার খুব চেনা।
সে একজন ভার্সিটি ছাত্র। তার এই ভ্যান চালানোর কথা ছিলোনা। তার কথা ছিল লাইব্রেরীতে বসে জ্ঞানের রাজ্যে বিচরন করা। শুধু নিজেদের চারজনের ভাবনা সে কেন ভাববে?দেশের সেরা বিদ্যাপীঠের ছাত্র হিসেবে তার এখন দেশ,সমাজ,সভ্যতা নিয়ে চিন্তা করার কথা। তার হাত ভ্যানের বেলে কেন থাকবে?তার হাত থাকবে মাইক্রোফোনে।
যেখানে সে তা্র অনলবর্ষী বক্তৃতায় আমাদের পথ দেখাবে। আমি তাকে ডাক দিতে চাই কিন্তু আমার গলা দিয়ে শব্দ বের হয় না,আমি তাকে থামাতে চাই কিন্তু আমার হাত তুলতে পারিনা,আমি তার ভ্যান কেড়ে নিতে চাই কিন্তু আমার পা চলেনা।
আমরা তাকে ধ্বংস করেছি। একজন ভার্সিটির ছাত্রের হাতে তুলে দিয়েছি ভ্যান। একটা উদীয়মান দীপশিখাকে আমরা কালো চাদরে ঢেকে দিয়ছি।
তার জীবন নদীর বুকে বাধ দিয়ে তার স্রোত থামিয়ে দিয়েছি। আমরা দায়ী। এই দেশ,এই কাল,এই সভ্যতা। এই সমাজ,এই রাজনীতি। কেউ ক্ষমা পাবার নয়।
আমি জানিনা সে এখন কোথায় আছে। তবে আমি তাকে এখনো খুজি।
মিজানুর রহমান পলাশ
১৭.৮.২০১১
সকাল ৪.২৫
বুয়েট,ঢাকা। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।