বুদ্ধিজীবী হতে ডিগ্রী লাগেনা। একটি হাট, নামহীন সেই হাট, যে হাটে মানুষ কেনা-বেচা হয়। টাস্কি খেলেন নাকি। আমাদের এলাকায় আছে সেই হাট। ছোটকাল থেকে আমরা দেখে আসছি মানুষ কিনতে, বেঁচতে।
ভাবছেন চাপা। তাহলে পুরোটা পড়ে ফেলুন।
রমজানের পুরোটা সময় বাড়ী কাটাই। আনলিমিটেড নেট প্যাকেজ নিলাম মন ভরে ব্রাউজ করব বলে কিন্তু নেটের যা স্পিড তাতে মেজাজ অটো গরম হয়ে যায়। আজ সকালে ভালোই স্পিড পাচ্ছিলাম।
এই সুসম্যে মা হাতে বাজারের ব্যাগ ধরিয়ে দিলেন। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু কিছুই করার নাই। মাকে তো আর বলা যায় না বাজার তুমি কর গিয়ে। তাই মেজাজ যে খারাপ হল এটা অন্য কারো উপ্র ঝেড়ে লাভ নেই।
ছোট ভাই এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। আমি বাজারে গেলে এই অবসরে সে খানিকক্ষন ফেসবুক ইউজ করে নেবে।
রমজান মাস বাজারে আগুন। এক সপ্তাহের ঝাল আলু পেঁয়াজ কিন্তেই মূলতঃ সাপ্তাহিক বাজারে যাওয়া। যাকে আমরা এখনো বলি বুধবারের হাট।
মৃদু বৃষ্টি হচ্ছে। আব্বুর প্রিয় ছাতাটা মাথার উপর মেলে ধরে রাস্তা মাপছি একাকি। বাতাসটা বেশ ফ্রেশ। ঢাকা শহরে এই খলা ফ্রেশ বাতাসের জন্য মনটা হাহাকার করে। বুক ভরে স্যরি ফুসফুস ভরে বাতাস নিলাম।
গুটিগুটি পায়ে হেঁটে চলেছি। জ়োরে হাটলে কাদা ছিটকে একটা মানসম্মানের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাই এই অযাচিত সাবধানতা। ক্যানালের পাশ দিয়ে যাচ্ছি। এই ক্যানালের সাথে আমার শৈশব জড়িত।
এই ক্যানালের ওই পারে আমার স্কুল ছিল। একবার তরুন আমাকে এই ক্যানালে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। তরুন ক্যান্সারে মারা গেছে। আজ সব স্মৃতি। বুকের উপর কিছুটা চাপ রেখে যায়, ছাপচিত্র এঁকে যায়।
এখন শ্রাবন মাস। ক্যানালের পাড়ে অনেক ভীড়। লুঙ্গি পড়া মানুষে গিজগিজ করছে। ভীড়ের মাঝ থেকে দামাদামির আওয়াজ ভেসে আসছে। দাম কত পড়ল, কত দাম দিয়ে কিনলেন ভাই।
বিরস মুখে একটু দূরে কিছু লোক দেখতে পেলাম। ঝিরিঝিরি বৃস্টিতে লোক গুলো বসে আছে বিক্রি হবার আশায়। নিজেকে বিক্রি করতে এসেছে তারা। অবাক হচ্ছেন? হতেই পারেন। ব্যাপারটা জানা না থাকলে অবাক হতেই পারেন।
ঘটনা কিন্তু সিরিয়াস কিছু না।
এখন চলছে ধান লাগানোর সিজন। এই বিক্রি হওয়া লোকগলোকে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় কিষেণ। আগে অবশ্য আষাঢ়ের শুরুতেই কিষান কেনা বেচা শুরু হত। এখন প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ হালের বদলে ট্রাক্ট্রর দিয়ে জমি চাষ করে।
তাই শুরুর দিকে কিষানের চাহিদা আর নেই। ফলশ্রুতিতে কিশানের ইঙ্কাম কমে যাওয়ায় তাকে অন্য রাস্তা মাপতে হয়। বীজতলা থেকে ধানের চারা তুলে লাগানোর জন্য কিষানের দরকার। জমির মালিক চলে আসে হাটে। বাজেট অনুযায়ী সে কিষান কিনে নেয়।
বস্তা ভরে সস্তা তরকারী কিনে নেয় হাট থেকে। তারপর সন্ধার আগেই বাড়ীর পথ ধরে। সাথে থাকে কেনা সেই মানুষ গুলো। অচেনা বাড়িতে যেয়ে ওঠে মানুষগুলো। কুমড়ো আর ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে গৃহস্থের দহলিজ ঘরে।
হয়তো বাড়িতে থাকা আদরের মেয়েটার কথা মনে পড়ে। কিন্তু তাই বলে মন খারাপ করে রাতের ঘুম মাটি করলে তো চলবে না। পরদিন ভোরের আলো ফোঁটার সাথে সাথে মাঠে যেতে হবে। বীজতলা থেকে চারা তুলে মাথায় করে রোপ্নের জমিতে নিয়ে যেতে হবে। ততক্ষণে মালিকের বাড়ি থেকে পান্তা চলে আসবে।
পেয়াজ ম্রিচে পান্তা খেতে মন্দ লাগে না। এ তো পয়লা বৈশাখে শখ করে পান্তা খাওয়া না। তারপর সবাই মিলে কাজে লেগে পড়া। সার বেঁধে ধানের চারা পুঁতে যায়। সারাদিন রূকুতে দাঁড়ানোর মত করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
মাঝে মাঝে আকাশের দিকে চোখ তুলে দেখে আন্ধার করে মেঘ আসছে কিনা, দলক নামবে কিনা?
সারাদিন ভিজে পড়ে এরা ফসল ফলায় সারা বাংলার। কি করেছে বাংলা এদের জন্য! কি করেছে জমির মালিক এদের জন্য। সপ্তাহ শেষে সে নাহয় চুক্তিমাফিক টাকা দিয়ে দেবে। তাতেই কি শেষ হয়ে যায় সব ঋণ?
সভ্যতার এই আধুনিক যুগেও আজো মানুষ বিক্রি হয়, শ্রম বিক্রি হয় মধ্যযুগীয় দাসের মত। ভাবতে কি ভালো লাগে এটা।
আমাদের কি কিছু করার আছে তাদের জন্য? মনে হয়না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।