বৃথা হয়রানি ১.
আমাদের সমাজ ক্লাস নিতেন জব্বার স্যার। কোন একসময় মিলিটারিতে ছিলেন। ভালোবাসতেন ফুটবল। তাই প্রায়ই প্রতিজ্ঞা করতেন আমাদের কিক মেরে স্কুলের পেছনের ছড়াটা পার করে দেবার। অথচ বেশভূষায় ছিলেন পুরোদস্তুর বুজুর্গ।
মাঝে মাঝে ভাব উঠলে চোখ বন্ধ করে গর্দভকূলজাতদের বিভিন্ন জ্ঞানমূলক বক্তিমা দিতেন। সেই সব ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতির কোলাজ ঘেঁটে দুয়েকটা কথা এখনো যাপিত জীবনকে শীহরিত করে যায়। ভাবি, লোকটা কত প্রজ্ঞাবান ছিলেন!
তিনি প্রায় বলতেন তলোয়াড় হাতে নিলে সে তোমাকে দিয়ে একটা হলেও কোপ দেয়াবে। কলম নিলে একটা না একটা শব্দ বেরুবে। যতদিন তলোয়াড় তোমাকে চালাবে ততদিন তলোয়াড় হারাম।
আর যেদিন থেকে তলোয়াড়কে তুমি চালাবে সেদিন তলোয়াড় তোমার।
কিন্তু তবু তো আমরা রিপুতাড়িত মানুষ; তলোয়াড় চাই। ক্ষমতা চাই। যারা লুফে নেয়ার রেসে পিছু পড়ে যায় তারাই আমার মতো মাস্টারিতে আসে। রং-বেরঙের নীতিকথা বলে।
জব্বার স্যারকে কোট করে।
২.
নববইয়ের মাঝামাঝি সময়ে চট্টগ্রামের একটা কুখ্যাত কলেজে পড়তাম। সকাল সকাল কলেজে এলে দেখতাম এলজি-সেকান্দারের (দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র) ব্যারেল সাফ করে তেল-জল মেখে শুকতে দেয়া হত। এখানে যাদের অস্ত্র ছিল তাদেরই ক্ষমতা। তারাই হিরো।
এই হিরোদের ভিড়ে সত্যিকারের এক হিরোর আবির্ভাব ঘটল কলেজে। সারাদিন নেশায় লাল চোখদুটো নিয়ে দুলেদুলে হাঁটে। কোমরে-পিঠে এসএলআর, নাইন এমএম। হিন্দি ফিল্মের নায়ককে চোখের সামনে দেখে আমরা তো পুলকিত। ভাবী ইশ, এমন যদি হত-।
কিন্তু রোগাপটকা শরীরটা নিয়ে এদের সঙ্গে তাল মেলাতে সাহস হয় না।
এই হিরো একদিন ঠিকঠিক ৩৫ এমএম সিনেমা বানিয়ে ফেলল কলেজে। ছুটির শেষে একটা মেয়েকে জোর করে ধরে চুমু কেটে দিল। মেয়েটা লজ্জায় মাথা ঢেকে বেরিয়ে গেল কলেজ থেকে। তার মুখের অভিব্যক্তি দেখা হলো না।
কিন্তু হিরো সালমান
খানের মতো পা দুটো চেগিয়ে পোচ মেরে দাঁড়িয়ে রইল। মনে মনে ভাবলাম: এই তো পুরুষ-
তারপর ছ'মাস গেল না, সেই পুরুষকে আমারা আবিস্কার করি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়িতে শুয়ে থাকতে। পোস্টমর্টেম করলে
লাশ যে এতো বীভৎস হয়ে তা আগে আমার জানা ছিল না।
৩.
আমার একটা গল্প আছে, ২০০৭-এর মার্চে `প্রথম আলো'য় ছাপা হয়েছিল, তাতে একজন সৎ ও সরল শিক্ষককে দুর্নীতির অপবাদ নিয়ে চাকরি ছাড়ার সকরুণ বর্ণনা আছে। সেই গল্পের পরের গল্পটা আজ আপনাদের শুনাব।
নেপাল বাবুকে সরিয়ে যে ধূর্তলোকটা ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষক হয়েছিলেন তিনিও বেশ কিছুদিন হয় অবসরে গেছেন।
কিছুদিন আগে অডিট করতে এসে তাকে তলব করা হলো। দুপুরবেলা অডিট টিমের জন্য খানাপিনার আয়োজন করা হয়। মোটামুটি স্কুলের সবাই সেখানে উপস্থিত। এর মধ্যে স্কুলের আয়াটি মাছের টুকরো পাতে তুলে দিতে দিতে প্রশ্ন করল: স্যাররা এতো যে বিছরাইলেন (ঘাঁটাঘাঁটি করলেন) কিছু পাইলেন?
সবাই নিরুত্তর।
কেউ হয়ত মুচকি মুচকি হাসছে।
আয়া মাথার কাপড় ঠিক করতে করতে বলতে লাগল: কাগজে কলমে তো কিছু পাইবেন না, ইনারে ধরেন ( সেই ধূর্ত শিক্ষকের দিকে আঙুল তাক করে) সব বাইর হইয়া যাইব। এই আমার মতো গরীব বেটির থেইক্যা দশ হাজার ট্যাহা নিয়া চাকরি দিছে।
৪.
ক্ষমতা মানুষকে নাকি অন্ধ করে দেয়। ক্ষমতার অপব্যবহার যে কখনো কখনো খুব কদাকার, খুব উদগ্র হয়ে যায় মানুষ অনেকসময় তা বুঝে উঠতে পারে না।
আজ থেকে বছর খানেক আগে চট্টগ্রামের জিইসি মোড়ের ঘটনা। ফুটপাথের উপর ফেরিয়ালারা আমের টুকরি নিয়ে বসে আছে। হঠাৎ দেখি লম্বা চওড়া এক লোক, হাতে ওয়াকিটকি, লাথি মেরে মেরে টুকরিগুলো উড়িয়ে দিচ্ছে। আর মুখে যে কী বিশ্রি খিস্তিখেউড়। তার বউটি লজ্জায় লাল হয়ে তাকে সামলাতে ব্যস্ত।
ক্ষমতা লোকটাকে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য করে ফেলেছে। এই যে তার লোক দেখানো বাহাদুরি তাকে সমাজে একটা ছোটলোক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে সেকি তা বুঝতে পারছে?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।