আইনের নির্মান ও প্রয়োগ প্রচলিত ক্ষমতাকাঠামোকে টিকিয়ে রাখবার স্বার্থেই, সুতরাং আমরা সভ্য সমাজের আইন বলতে যা দেখি, তা মূলত এই ক্ষমতাকাঠামোর নিজস্ব প্রতিরক্ষা কৌশল। এখানে প্রচলিত ক্ষমতাকাঠামোকে নিরাপত্তাহীন করে তুলতে পারে এমন যেকোনো কর্মকান্ডকে কঠোর ভাবে দমন করা হয়েছে, হয় এবং ভবিষ্যতেও হবে। রাষ্ট্র কাঠামো বদলাতে পারে, এবং বদলায়, রাষ্ট্রের কাঠামো বদলের সাথে সাথে বদলে যায় সংবিধান এবং এই সংবিধান কিংবা অলিখিত গণদাবিই আইনের প্রয়োগকে বদলে দেয়, কারণ তখন ক্ষমতাকাঠামোই আমূল বদলে যায়।
যাদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য আইন নির্মিত হয় তারা সব সময়ই আইনের নিরাপত্তা বলয়ে থেকে যায়, এবং কোনো রাষ্ট্রে যদি এমন বিকল্প কোনো ক্ষমতাকাঠামো তৈরি হয় যা প্রচলিত কাঠামোর তুলনায় অধিক ঘাতসহ, প্রতিঘাতসহ তবে রশি টানাটানি খেলায় নেমে যায় মিডিয়া আর জনগণ, তাদের সমর্থনের পাল্লা যেদিকে ঝুঁকে যায়, সমকক্ষ দুটি কিংবা ততোধিক ক্ষমতাকাঠামোর ভেতরে সে অংশই টিকে থাকে।
এই চিহ্নিতকরণের প্রক্রিয়াটাও ক্ষমতাকাঠামোর নির্মাণ।
আইন বিষয়ে যেকোনো আলোচনা কিংবা দুঃশাসন ও আইনের শাসন বিষয়ে যেকোনো আলোচনায় আগে এটা নির্ধারণ করে রাখা জরুরী, কারা আইন- আদালত এবং বিচার ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রন করছে?
রাষ্ট্র অকার্যকর কিংবা দুর্বল কিংবা সবল এইসব নীতিনির্ধারণী বিষয়াদির ক্ষেত্রে সব সময়ই আইনি কাঠামোকে সামনে নিয়ে আসা হয় সম্ভবত এ কারণেই যে অকার্যকর রাষ্ট্র এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে ক্ষমতা কাঠামো আদালতের উপরে ছড়ি ঘোরাতে ব্যর্থ হয় কিংবা আদালত সংবিধানকে আমলে না নিয়েই নিজস্ব বিধান প্রচলন করে কিংবা রাষ্ট্রের সীমিত অংশে ক্ষমতা কাঠামোর আইন প্রয়োগের কোনো ক্ষমতা নেই। বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্র এমনটা এই মুহুর্তে বলবার সময় আসে নি, কিন্তু অকার্যকর হয়ে যাওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এইসব প্রশ্নের বিশ্লেষণ করলেই এটা পরিস্কার হয়ে যায়।
বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ড, কোনো পক্ষকে এমন ক্ষমতা দেওয়া যে তাদের কর্মকান্ডকে আইনের ধারায় বিচার করা যাবে না, এ সবই আদতে নির্ধারণ করে দেয় ক্ষমতার ভারসাম্য আনবার জন্য একটা আপোষ রফা চলছে, কিংবা ক্ষমতাকাঠামো নিজেই সমর্থন করছে এইসব অনাচার কিংবা রাষ্ট্র নিজের নিরাপত্তাহীনতার প্রকাশ ঘটাচ্ছে এমন আচরণে।
অপারেশন ক্লিন হার্ট, র্যাব কিংবা পুলিশের নির্যাতনে নিহত মানুষদের বিচার না হওয়া এবং রাষ্ট্র তাদের পক্ষে সাফাই গাওয়ার ব্যগ্রতাও মনে করিয়ে দেয় রাষ্ট্র নিজের প্রয়োজনেই এইসব অনাচার করছে কিংবা ক্ষমতা কাঠামোর নেপথ্যে যারা আছে তাদের প্রচ্ছন্ন এবং প্রকাশ্য সমর্থন আছে। এই আইন লঙ্ঘনের বিষয়টাকে তারা আমলে আনছে না মোটেও কারণ তাদের ধারণা এর ফলে রাষ্ট্রের কাঠামো শক্তিশালী হয়ে উঠবে কিংবা ক্ষমতার ভিত্তি সুদৃঢ় হবে।
আসলে কি এমনটা ঘটে? দুধ কলা দিয়ে সাপ পুষলে কি সে সাপ ছোবল দেয় না? ক্ষমতা নিষ্কন্টক করতে ইসলামী মূল্যবোধ ও ধর্মীয় রাজনীতিকে পৃষ্টপোষকতা করা হয়েছিলো, যারা এইসব নিয়ন্ত্রন করে তারা মানুষকে ধর্মের আফিমে মগ্ন রাখতে চেয়েছিলো, সেটা এ শতাব্দীতেই নয় শুধু পূর্ববর্তী শতকগুলোতেও ঘটেছে- ধর্মীয় বিভেদ এবং ধর্মীয় বিভাজন সদা জাগ্রত রাখতে মানুষের মনে রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনেরা ধর্মীয় লেবাস ধরেছে কিংবা ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে, ধর্মকে কলুষিত করেছে, মানুষকে কলুষিত করেছে। এমন নগ্ন ও অনৈতিক ধর্মের ব্যবহারকে সমর্থন করে স্বার্থসিদ্ধির ঘটনাও ঘটেছে-
ক্ষমতাকাঠামোকে না বদলে ক্ষমতার কেন্দ্র বদলাতে সামরিক বাহিনী ব্যবহৃত হয়েছে, সেটা নিজস্ব ক্ষমতার প্রলোভন কিংবা অন্য কোনো প্রলোভনে ঘটেছে হয়তো, বিপ্লব হয়েছে, বিদ্রোহ হয়েছে, কোনো বিদ্রোহ সফল পরিণতি পেয়েছে, কোনোটা ব্যর্থ হয়েছে, এসব অনেক ঘটনাই ঘটেছে ইতিহাসে।
বাংলাদেশ এই ইতিহাসের বাইরের কোনো দেশ নয়, এখানেও ধর্ম, আইন, বিচারালয়, প্রলোভন, প্ররোচনা, ঘুষ এবং প্রণোদনা, সামরিক বাহিনী এবং আমলাতন্ত্র, সব কিছুই ব্যবহৃত হয়েছে ক্ষমতা কাঠামোর সমর্থনে।
সেটা জন্মলগ্ন থেকেই ঘটছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত খন্দকার মোশতাক আহমেদের নিজস্ব উদ্যোগে সমঝোতা এবং ফেডারেশন গঠনের প্রচেষ্টা, সাংসদ ক্রয় বিক্রয়, বিদ্রোহ এবং অসহযোগ যুদ্ধের সময় থেকেই চলছে বাংলাদেশে, এসবের টানাপোড়েন ক্ষমতা কেন্দ্রে সব সময়ই ছিলো।
সাংসদদের নিজস্ব আইন চলেছে তার নিজস্ব সাংসদীয় আসনে, বদি এখন যা করছে, কিংবা লতিফ যা করছে, সেটা অনেক আগে থেকেই চর্চিত একটি বিষয়, সেটা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকারক কিন্তু এরপরও সেটা চলেছে, সময় এসেছে এসব থামানোর।
এই মুহূর্তে বেসামরিক একদল মানুষ, যাদের সম্মিলিত ভাবে সুশীল সমাজ বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে, তারা ক্ষমতাসীনদের অংশই, তবে তাদের উর্দি কিংবা ভোটের সমর্থন নেই। তারা বিভিন্ন মানবিক ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসে নিজেদের গ্রহনযোগ্যতা বাড়িয়ে ক্ষমতার স্থায়িত্ব বাড়াতে সচেষ্ট।
এই সব সামাজিক ইস্যুর জন্যই এখন বাংলাদেশ সরকার পরিবেশ সচেতন, বাংলাদেশ সরকার নদী দুষণ নিয়ে সোচ্চার, আদালত সরকারকে নির্দেশনা দিচ্ছে, সরকারকে চাপে ফেলছে, এবং এই কাজে নিয়োজিত আমলা এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তারা আইনী নিশ্চয়তা চাইছেন, যদি তারা এই কাজ করতে গিয়ে ক্ষমতাসীনদের বিরাগভাজন হয়ে যান তবে যেনো তাদের নিরাপত্তা প্রদান করা হয়, তারা স্পষ্ট ঘোষণা চেয়েছে, যেনো আদালত ঘোষণা করে দেয়, এই সম্পূর্ণ কর্মসূচি চলাকালীন সময়ে তাদের বদলি কিংবা ওএসডি না করা হয়।
আদালত এই যে পরিবেশ বিষয়ক কঠোর অবস্থানে এসেছে সেটাও রাষ্ট্রের দীর্ঘস্থায়ী নিরাপত্তা চিন্তা করেই, তবে সংক্ষিপ্ত সময়ের বিবেচনা হলো লেঠেল কর্মীদেরও ক্ষমতা দিতে হবে যেনো তারা বিরোধীদের দমন করতে পারে, পুলিশ এবং আদালতের দারস্থ হওয়ার আগেই যেনো কিছুটা প্রতিরোধ দমন করা যায়, তাই হাজি সেলিম, জয়নাল হাজারীর জামিন হয়। জয়নাল হাজারী, যার কারণে ৩ বছর নির্ধারিত আদালত ভবনে বিচার কার্য শুরু করা সম্ভব হয় নি, সেই হাজারীকেই জামিন দেওয়া হচ্ছে।
জয়নাল হাজারী নিজের এলাকায় নিজস্ব প্রশাসন তৈরি করেছে, ক্ষমতার বিকল্প একটি কেন্দ্র তৈরি করে সে নিজে রাষ্ট্রবিরোধী আচরণ করলেও সেটা ক্ষমাযোগ্য আচরণ বিবেচিত হওয়া আসলে রাষ্ট্রের দীনতাই প্রকাশ করে।
আমাদের বিচারকগন, সম্মানিত সুশীলগণ এসবের বিরোধিতা না করে নদী, সড়ক নিয়ে এতটাই মগ্ন যে এই মত্ততায় অনেক অপরাধই অপ্রকাশিত থেকে যাচ্ছে , অপরাধ ও অপরাধীসৃজন হচ্ছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।