“এই পিচ্চি,তোর নাম কী জানি? খালি ভুলে যাই ”- চায়ের দোকানের বাচ্চা ছেলেটাকে প্রশ্ন করলাম আলাপ জমানোর ভঙ্গিতে ।
“মোঃ আরিফুল ইসলাম আরিফ ”- অতি দ্রুত চায়ের কাপে চামচ চালানোর মতই সপ্রতিভ উত্তর । “ভাই আফনের নাম কী?” আমায় প্রশ্ন করে সে । বুঝাই যাচ্ছে,সে ও আজ আলাপ জমানোর মুডে আছে।
সময়টাই এমন।
রোজার সময়কার রাত ১১টা। ভার্সিটি এলাকায় চায়ের টং দোকান । এমনিতেই এই সময় লোকজন একটু কম আসে । আর একটু রাত হলেই দলে দলে আসা শুরু করে নিশাচর-চা খেকো-আড্ডাবাজ জ্ঞানপাপীদের দল।
“সামি”-উত্তর দেই আমি।
আছছা, আমরা সবসময় ছোট নামটা বলি কেন? আমি নিশ্চিত, আপনাকেও নাম জিজ্ঞাসা করলে আপনি আপনার পুরো নামটা বলবেন নাহ । এটা কেন ? ছোট বেলায় মা যখন বলতো –“বাবা, আংকেল কে বলো তোমার নাম কী” – তখন বলতাম- “সামিউর রহমান সামি”। তারপর ধীরে ধীরে সামিউর রহমান সামি থেকে শুধু সামি এবং অতপর হালের স্যাম । এর কারণ কী? যতই বড় হয়েছি, শিক্ষিত হয়েছি ততোই নামের প্রতি,নিজের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মাচ্ছে। নামের মত নিজ সত্তাকেও গুটিয়ে নিচ্ছি ।
“ এই লন আফনের চা, দুধ-চিনি ডাবল ”। আরিফের কথায় আমার আগা-পাছ-তলা বিহীন ভাবনায় ছেদ পড়লো । হাত বাড়িয়ে নিলাম ধুমায়িত চায়ের কাপ । আরামের চুমুক দিলাম । অতি পরিচিত সেই স্বাদ।
ভালোই লাগছে, রাস্তায় লোকজন আছে বেশ, আবিরাম ছুটে চলা রিক্সা আর তাতে সওয়ার লোকজন আর তাদের গাদা খানেক ঈদের শপিং । হায়রে আদম সন্তান, সংযমের মাসে একমাত্র সংযম করাতেই তার যত সংযম, আর কোনকিছুতেই তার সংযম নাই ।
কানে হেডফোনে বাজছে অঞ্জন দত্তের গান-
“Its been a hard days night and
I have been running like a dog..
Its been a hard days night and
I should be sleeping like a log ”
আসলেই আমার অবস্থা এমন যাচ্ছে। সেই ইফতার গিলে নাকে মুখে দৌড়। তারপর ভর্তি পরীক্ষার চোরাবালিতে হারিয়ে যেতে বসা কতিপয় দুর্ভাগার সামনে বসে কিছু ভাবের কথা আর উপদেশ দেবার ফাকে ফাকে একটা দুটা অংক করানো ।
তারপর, আবার দে ছুট আরেকজনের কাছে। তারপর তার সাম্নেও সেই একই- সব জানার ভাব করা । এক বুয়েট ভর্তি পরীক্ষার সৌভাগ্য ভাঙ্গিয়ে আর কতদিন যে খাবো কে জানে? যার জানার সে জানুক ,আমার কী? আমি তো দিব্যি খেয়ে যাচ্ছি,যাব............।
বহুদিন পর সময় পাওয়া গেল, সময় পাওয়া গেল নিজের জন্য , নিজের দুঃখগুলোকে সময় দেবার জন্য । চার মাস পর সময় পেলাম সময় বের করার ।
সময়ের বড়ই অভাব । আসলে অভাব সময়ের নাহ, অভাব টা আসলে অভাববোধের। সময়ের যে অভাব,এই অভাবটাই এতদিন বোধ করিনি। আজ করছি । বহুদিন ডুব দেয়া হয় না আমার দুঃখ-বিলাসের জগতে,যেখানে শুধু আমি আর আমার কুসুম-কুসুম প্রেম জনিত হৃদয় ব্যাথাই এক্মাত্র সত্য।
আর সবই মূল্যহীন,সবই ফ্যাকাসে ।
ল্যাম্প পোস্টের আলোয় নিজের ছায়া দেখে হঠাৎ চমকে উঠি। ক্ষণিকের অসাবধানতায় চা ছল্কে পড়ে । নিজেকে সাম্লে নিয়ে আবার মন দেই আমার ছায়ায় । অনেকদিন ছায়া দেখিনা , নিজের ছায়া ।
মানুষ দেখতে দেখতে আর ছায়া দেখা হয়ে ওঠে নাহ । সূর্য্যের আলোর চেয়ে চাদের আলোয় ছায়া অনেক বেশী উপভোগ্য ,এক অজানা রহস্যময়তায় নিজেকে মুড়ে রাখে নিজেকে । ল্যাম্পপোস্টের আলোতে ছায়ারা অত রহস্যময় না ,এই ছায়াগুলো ল্যাম্পপোস্টের নিচের মানুষগুলোর মতি জটিল ,দ্বিধাগ্রস্ত আর বহুধা-বিভক্ত।
লেঞ্জের সূত্র মনে পড়ে – “ in a closed circuit, the direction of the current is such that it opposes the flux that created it .”
আচ্ছা,মানুষের ভালোবাসা ও কী লেঞ্জের সূত্র মেনে চলে? ভালোবাসা যত গভীর , প্রত্যাশা ততো বেশী, কষ্ট ও ততো বেশী । এই কষ্ট আবার ভালোবাসার লাগাম টেনে ধরে।
ভালোবাসায় ভাটা ধরলে আবার প্রত্যাশাও কমে যায়,কমে যায় কষ্ট । ফলে, আবার দু-কূল ছাপিয়ে জোয়ার আসে ভালোবাসার গাঙ্গে । নেগেটিভ ফীডব্যাকের অতি উৎকৃষ্ট উদাহরণ । ইস, শুধু যদি টার্ম ফাইনাল পরীক্ষার আগে এই জিনিসগুলা এভাবে বুঝতাম।
এইসব কথা ভাবতে ভাবতে আমি উঠে দাড়াই।
অতি ব্যস্ত ভাবে পা বাড়াই হলের দিকে। ব্যস্ত রাস্তার দুইদিকের ট্রাক, গাড়ি আর রিক্সার অস্তিত্ব কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে রাস্তার ঠিক মাঝখান দিয়ে হেটে চলে নিজেকে হারিয়ে ফেলা এক ক্লান্ত যুবক। আর তার পিছনে ল্যাম্প পোস্টের আলোয় হেটে চলে যুবকের অবহেলিত ছায়া ।
বিঃ দ্রঃ অনেকদিন পর লিখলাম। দুঃখবোধ ই বোধহয় আমার লেখার চালিকা শক্তি ।
তাই, এই দুঃখবোধের জন্য ধন্যবাদ আমার আজীবন দুঃখবোধের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-লী কে। তোকে ঘিরে দুঃখ পেতেই যে আমার সব সুখ, তা কী তুই জানিস না? ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।