আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মিলন হত্যায় পুলিশের সহায়তা ছিল

আমার সম্পর্কে আমিই জানিনা নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে কিশোর শামছুদ্দিন মিলনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় পুলিশের সহায়তা ছিল। জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে করা প্রাথমিক তদন্তে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে। কমিটি গত রাতে তাদের খসড়া প্রতিবেদন জেলা পুলিশ সুপারের কাছে জমা দিয়েছে। এদিকে কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিক উল্লাহকে গতকাল প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর আগে এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে তিন পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

এদিকে আমলি আদালতে করা মিলনের (১৬) মা কহিনুর বেগমের মামলা গত রাতে থানায় এফআইআর হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি বিশ্বাস আফজাল হোসেন কোম্পানীগঞ্জে আসছেন। গত ২৭ জুলাই সকালে কিশোর মিলনকে কোম্পানীগঞ্জের টেকেরহাট মোড়ে পুলিশের গাড়ি থেকে নামিয়ে জনতার হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। পুলিশের উপস্থিতিতে জনতা কিশোরটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। পরে পুলিশ তার লাশ গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে যায়।

পুলিশ সুপার হারুন-উর-রশীদ হাযারী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে জানান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহবুব রশিদের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটির খসড়া প্রতিবেদনে মিলন হত্যাকাণ্ডে পুলিশের সহায়তার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গতকাল অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহবুব রশীদের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি প্রথম ঘটনাস্থল বেপারী বাড়ির মসজিদ এলাকা, টেকেরহাট বাজার, মিলনের স্কুলপড়ুয়া আত্মীয়ের বাড়ি এবং মিলনের বাড়িতে যায়। মাহবুব রশীদ প্রথম আলোকে জানান, ‘প্রতিটি স্পটে গিয়েছি। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে কথা বলেছি। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গেও কথা হয়েছে।

বিচার-বিশ্লেষণ করছি, কেন ঘটনাটি ঘটল। এ ঘটনায় কারা কীভাবে দোষী। ’ গত রাতে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহবুব রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘চরকাঁকড়া ইউনিয়নের টেকেরহাট বাজারে পুলিশের কাছ থেকে নিয়ে মিলনকে পিটিয়ে হত্যার সময় পুলিশ যথাযথ ভূমিকা নেয়নি। এমনকি দায়িত্ব পালনে চরম গাফিলতির বিষয়টি তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। পুলিশ তখন মিলনকে রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেয়নি বলেই তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে।

’ গতকাল ঘটনাস্থল টেকেরহাট বাজারে গিয়ে ব্যবসায়ীদের কয়েকজনের কাছে ওই দিনের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তাঁরা কেউই নাম প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি হননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ওসি রফিক উল্লাহ ও স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি গত রোববার টেকেরহাট বাজারে গিয়ে ব্যবসায়ীদের পুলিশের গাড়ি থেকে কিশোর মিলনকে নামিয়ে দেওয়ার কথা তদন্ত কমিটির কাছে বলতে নিষেধ করেন। ‘ডাকাত হিসেবেই জনতা তাকে পিটিয়ে মেরেছে’—এমনটি বলতে বলা হয় তাঁদের। অন্যথায় গণপিটুনির মামলায় তাঁদের জড়ানো হবে বলে শাসিয়ে দেওয়া হয়। সেদিন আসলে কী ঘটেছিল—জানতে চাইলে বর্তমানে থানার দায়িত্বে থাকা হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্থানীয় লোকজনের মোবাইল ফোনে খবর পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে আটক মিলনকে থানায় নিয়ে আসতে এসআই আকরাম শেখকে পাঠানো হয়েছিল।

পথে যা ঘটেছে বা হয়েছে, তা তো সবার জানা। ’ কোম্পানীগঞ্জে ওই দিন ডাকাত সন্দেহে পৃথক স্থানে ছয়জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বলে পুলিশ দাবি করেছিল। এর মধ্যে টেকেরহাট মোড়ে মারা হয় তিনজনকে। তাদেরই একজন কিশোর শামছুদ্দিন মিলন। মিলনকে মারা হয় সকাল সাড়ে ১০টার দিকে, আর বাকি দুজনকে মারা হয়েছিল ভোরবেলায়।

মিলনকে হত্যার পুরো ঘটনা উপস্থিত কেউ একজন ভিডিও চিত্রে ধারণ করেন। সেই ভিডিও চিত্র লোকজনের হাতে ছড়িয়ে পড়লে পৈশাচিক ওই ঘটনা ফাঁস হয়ে যায়। এ ঘটনায় থানায় দায়ের হওয়া ডাকাতি ও খুনের মামলায় নিরপরাধ কিশোর মিলনকেও আসামি করা হয়েছে। তবে মামলার বাদী ডাকাতের গুলিতে নিহত রিকশাচালক মোশাররফ হোসেন মাসুদের বাবা রফিক প্রথম আলোকে জানান, তিনি কেবল সেই রাতে যে কয়েকজনকে চিনেছেন, তাদের নাম পুলিশকে বলেছেন। পরে পুলিশ ওই নামের সঙ্গে যারা গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে, তাদেরও আসামি করেছে বলে শুনেছেন।

মিলন নামে কাউকে আসামি করেছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি অশিক্ষিত মানুষ। তারা (পুলিশ) আমাকে কাগজ দিয়েছে, আমি স্বাক্ষর করেছি। ’ মিলনের প্রতিবেশী আবদুল হাই জানান, মিলন বাচ্চা ছেলে। টাকার অভাবে লেখাপড়া করতে পারেনি। চট্টগ্রামে চলে গেছে কাজ শিখতে।

১৪-১৫ দিন আগে বাড়ি এসেছিল। তিনি বলেন, ছেলেটি কখনো এলাকায় কোনো অন্যায় কাজ করেছে বলে কেউ বলতে পারবেন না। গতকাল চরফকিরা ইউনিয়নের চরফকিরা গ্রামে মিলনের বাড়িতে গেলে তার মা কহিনুর বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বারবার প্রথম আলোকে বলতে থাকেন, ‘সেই দিন (২৭ জুলাই) সকালে মিলন আমাকে ফোন করে বলে, “মা, কিছু লোক আমাকে বেপারী বাড়ির স্কুলের ঘাটলায় আটকে রেখেছে, তুমি...” এ কথা বলার পরই লাইন কেটে যায়। আমি বহুবার চেষ্টা করেও ফোনে আর কথা বলতে পারিনি।

তা ৎ ক্ষণিক আমার ভাশুর জসিম উদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে যাই। লোকজন জানায়, আমার নিরপরাধ ছেলেকে মারধর করে সঙ্গে থাকা টাকা ও মোবাইল ফোন নিয়ে জামাল উদ্দিন মেম্বার (স্থানীয় ইউপি সদস্য) ও মিজানুর রহমান ওরফে মানিক পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। ’ কান্না সামলিয়ে কহিনুর বলেন, ‘সেখান থেকে থানার উদ্দেশে যাওয়ার পথে টেকেরহাট বাজারে লোকজনকে বলাবলি করতে শুনি, পুলিশ এক ছেলেকে ডাকাত বলে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। পুলিশই তার লাশ থানায় নিয়ে গেছে। থানায় গিয়ে দেখি পাঁচটি লাশের সঙ্গে মিলনের লাশ পড়ে আছে।

থানার ভেতর ঢোকার চেষ্টা করেও পুলিশের বাধার কারণে পারিনি। ’ চরফকিরা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের চরফকিরা গ্রামের সৌদিপ্রবাসী গিয়াস উদ্দিনের ছেলে মিলন। চার ভাইয়ের মধ্যে মিলন সবার বড়। সে ২০১০ সালে স্থানীয় কবি নজরুল উচ্চবিদ্যালয়ে দশম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়। এরপর আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে পরীক্ষা দেয়নি।

মিলনের ছোট তিন ভাইয়ের একজন বর্তমানে একই স্কুলে দশম শ্রেণীতে পড়ে। বাকি দুজন (যমজ) জহিরুদ্দিন রুবেল ও সাইফুদ্দিন ফয়সাল উত্তর চরফকিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। মিলনের বাবা গিয়াসউদ্দিন প্রায় আড়াই বছর আগে পৈতৃক ভিটা (দুই শতক জায়গা) চাচাতো ভাইয়ের কাছে বিক্রি করে সৌদি আরবে যান। শর্ত ছিল, বিদেশে গিয়ে রোজগার করে টাকা পাঠাবেন এবং ওই টাকায় জমি কিনে বাড়ি করা পর্যন্ত তাঁরা এই ভিটায় থাকবেন। লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর প্রথম কিছুদিন কক্সবাজারে গিয়ে ছোটখাটো কাজ করে মিলন।

পরে বাবা খবর পাঠায় ওয়েল্ডিংয়ের কাজ শেখার জন্য, তাহলে তাঁকে বিদেশে নিয়ে যাবেন। তিন-চার মাস আগে চাচা সাহাবউদ্দিনের সঙ্গে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে গিয়ে ওয়েল্ডিংয়ের কারখানায় কাজ শিখতে শুরু করে মিলন। এর মধ্যে বাড়িতে পল্লি বিদ্যুতের মিটারে সমস্যা হওয়ায় এবং বাবার পাঠানো টাকায় কেনা জমি নিবন্ধনে মাকে সহায়তা করতে ১৪-১৫ দিন আগে বাড়িতে আসে সে। মিলনের মা জানান, কিছুদিন আগে জমি কেনার জন্য এক লাখ ২৫ হাজার টাকা পাঠান মিলনের বাবা। ওই টাকায় ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কামাল মেম্বারের কাছ থেকে এক খণ্ড জমি কিনেছেন তাঁরা।

সেই জমি রেজিস্ট্রি ও দলিল লেখানোর জন্য ২৭ জুলাই বাড়ি থেকে ১৪ হাজার টাকা নিয়ে সকাল সাড়ে আটটার দিকে বের হয়েছিল মিলন। আর ফিরল লাশ হয়ে। কহিনুর বেগম বলেন, ‘শুনেছি, উপজেলা সদরে যাওয়ার পথে চরকাঁকড়ার বেপারী বাড়ির বায়তুল নূর জামে মসজিদের ঘাটলায় বসে মিলন অপেক্ষা করছিল চরকাঁকড়া একাডেমি উচ্চবিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ুয়া তাঁর (মিলনের মায়ের) ফুফাতো বোনের মেয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য। স্কুলে তার পরীক্ষা চলছিল। ’ মিলনের মায়ের করা মামলার আসামি চরকাঁকড়া ইউনিয়নের সংরক্ষিত নারী সাংসদ ফেরদৌস আরা বেগমের স্বামী মিজানুর রহমান মানিক বলেন, ‘অপরিচিত দেখে আমি ছেলেটিকে এখানে বসে থাকার কারণ জিজ্ঞেস করি।

স্কুলে তাঁর আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য বসে আছে বলে জানায় সে। বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে সে জানায়, চরফকিরা। এর মধ্যে আশপাশের কিছু লোক জড়ো হয়। তারা ছেলেটিকে ডাকাত বলে সন্দেহ করে। কারণ, ওই দিন ভোর রাতে আশপাশের এলাকায় ডাকাত ধরে গণপিটুনি দেওয়া হয়েছিল।

’ মানিক জানান, ওই সময় ঘটনাস্থলে স্থানীয় ইউপি সদস্য জামালউদ্দিন আসেন। তিনিও মিলনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এরপর আমরা পার্শ্ববর্তী স্কুল থেকে ওই মেয়েটিকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করি। প্রথমে সে কিছু না বলে চুপ করে থাকে। সম্ভবত অনেক লোক দেখে চুপ করে ছিল।

পরে আমি ধমক দিলে ছেলেটিকে তার আত্মীয় বলে জানায় মেয়েটি। মানিক দাবি করেন, ‘এর পরও উপস্থিত লোকজন মিলনকে ডাকাত সন্দেহে হালকা মারধর করে। আমি এবং জামাল মেম্বার ছেলেটিকে মক্তবের ভেতর আটকে রাখি এবং থানায় খবর দিই। পুলিশ এলে তাদের কাছে সোপর্দ করি। ’ চরকাঁকড়া একাডেমি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম জানান, ওই মেয়ে ছেলেটিকে তাদের আত্মীয় বলে স্বীকার করেছে।

মিলনের ওই খালাতো বোন গতকাল স্কুলে যায়নি। তার গ্রামের বাড়ি চরকাঁকড়া গ্রামে গেলে তার বাবা মিলনকে তাদের আত্মীয় বলে স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটাই করেননি। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে বলে বলছে। আমি এ সম্পর্কে কিছুই জানি না। ’ মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে দিতেও রাজি হননি তিনি।

স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এই পরিবারটিকে এ বিষয়ে মুখ না খুলতে কোম্পানীগঞ্জ থানার পুলিশের পক্ষ থেকে চাপ দেওয়া হয়েছে। পুলিশকে বাঁচাতে স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধিও দৌড়ঝাঁপ করছেন বলে ওই সূত্রগুলো জানায়। সুত্র প্রথম আলো ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।