আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাজনৈতিক বিবর্তন ও শুদ্ধ সংস্কৃতির পুনরুত্থান

রাজনৈতিক বিবর্তন ও শুদ্ধ সংস্কৃতির পুনরুত্থান ফকির ইলিয়াস ============================= আমরা একটি পুনরুত্থান চাই। চাই সামাজিক জাগরণ। যে জাগরণ, আমাদের দীনতাকে বদলে দেবে। আমাদের হীন মানসিকতাকে বদলে দেবে। আমরা মানুষের পাশে দাঁড়াতে শিখবো।

আমরা সমাজের কল্যাণের কথা ভাববো। বাজারের মুনাফাখোরেরা একটা হিসেব করেই রাখেন। পবিত্র রমজান মাস এলেই তাদের মুনাফা দ্বিগুন হবে। এ জন্য হীন কোন কাজ নেই, যা কেউ কেউ করেন না ! অথচ আমরা সিয়াম সাধনার কথা বলি। আমরা পরিশদ্ধতার কথা বলি।

টিভিতে দেখি, ভেজাল খাবারে বাংলাদেশের বাজার সয়লাভ হয়ে গেছে। আবার এই সংবাদ ও দেখি, মাঝে মাঝে মোবাইল কোর্ট অভিযান চালাচ্ছে বিভিন্ন ভেজাল স্থাপনায়। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন দৈনিকগুলোতে নিয়মিত একটি কলাম আছে। সে কলামটি 'ডাইনিং আউট' বা 'বাইরে কোথায় খাবেন' এই সেকশনে ছাপা হয়। কলামটির শিরোনাম হচ্ছে, 'গত সপ্তাহে যেসব রেস্টুরেন্ট স্বাস্খ্য নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে।

' এই সংবাদ কলামে সেসব রেস্টুরেন্টে নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর থাকে যারা যুক্তরাষ্ট্রের 'হেলথ কোড' ভঙ্গ করেছে। সে সঙ্গে বিবরণ থাকে কীভাবে তারা 'হেলথ কোড' ভঙ্গ করেছে। যেমন­ তাদের রান্নাঘরে বাসি খাবার পাওয়া গেছে, রান্নাঘরে ছোট ইঁদুর কিংবা পোকার উপস্খিতি লক্ষ্য করা গেছে, কিংবা রেস্টুরেন্টের টয়লেট-ওয়াশরুম ময়লা ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। বিশেষ করে কিচেনে পুরোনো-বাসি খাবার, পোকার উপস্খিতি প্রভৃতিই বেশি লক্ষ্য করা যায়। সিটি কর্তৃপক্ষের হেলথ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ইন্সপেক্টররা প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট পরিদর্শন করে যে রিপোর্ট দেন, হেলথ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন তা-ই সংবাদপত্রে সরবরাহ করে।

সেসব ডকুমেন্টেশনের ভিত্তিতেই ছাপা হয় পত্রিকায় সংবাদ প্রতিবেদন। পাঠক, অনুমান করুন যদি নিউইয়র্কের একটি সংবাদপত্রে একটি রেস্টুরেন্টে বাসি খাবার বিক্রির রিপোর্ট ছাপা হয়, তবে আর কোনো খদ্দের কি ঐ রেস্টুরেন্টের বারান্দায় গিয়ে পা ফেলবে? না, অবশ্যই ফেলবে না। এমনও দেখা গেছে, হেলথ কোড ভঙ্গের রিপোর্ট ছাপা হওয়ার কারণে অনেক রেস্টুরেন্টে লালবাতি জ্বলে গেছে চিরদিনের জন্য। কারণ মার্কিনিরা খাবারের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন। গাঁটের ডলার খরচ করে তারা ফাঙ্গাসযুক্ত বাসি খাবার কিনে খাবেন কেন? তার ওপর কোনো রেস্টুরেন্টে বাসি খাবার খেয়ে অসুস্খ হয়ে ঐ রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করার সুযোগ তো রয়েছেই।

আমি একজন মার্কিনিকে জানি, যিনি একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্ট থেকে ফ্রাইড চিকেন খেয়েছিলেন। কিন্তু ঐ ফ্রাইড চিকেনের ভেতরের হাড় ভালোভাবে পরিষ্কার এবং ফ্রাইড না হওয়ায় হাড়ে জমাট রক্ত থেকে গিয়েছিল। তিনি ঐ রক্তাক্ত হাড় চিবিয় গিলে ফেলায় তার মারাত্মক অসুস্খতা দেখা দেয়। তার শরীরের একাংশ প্যারালাইজড হয়ে যায়। চিকিৎসায় তার কারণ ধরা পড়ে।

তিনি ঐ রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে মামলা করে তার ক্ষতিপূরণ পান দুমিলিয়ন ডলার। একটি পত্রিকার রেস্টুরেন্ট রিভিউ, একটি রেস্তোরাঁকে যেমন ব্যাপক জনপ্রিয়তা দিতে পারে, তেমনি অস্বাস্খ্যকর খাদ্য পরিবেশের কথা ছাপা হলে ঐ রেস্তোরাঁটির ব্যাপক আর্থিক ক্ষতিও হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে হেলথ ইন্সপেক্টররা যাতে কোনো রেস্টুরেন্ট মালিক কর্তৃক প্রভাবিত হতে না পারেন, তার জন্যও রয়েছে বিশেষ ব্যবস্খা। যারা অনডিউটিতে থাকেন তাদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য থাকে অন্য আরেকটি গোয়েন্দা দল। কারণ তারা কাজ ঠিকমতো করছেন কি না, কিংবা কোনো দুর্নীতির আশ্রয় নিচ্ছেন কি না তা দেখার দায়িত্ব হলো ঐসব গোয়েন্দা কর্মকর্তার।

মোট কথা হচ্ছে কোন ইন্সপেক্টর যাতে দুর্নীতিগ্রস্ত হতে না পারেন, সেজন্যই এ ব্যবস্খা। এই যে সততার অভিযান, তা সংস্কৃতির একটি অংশ। মানুষ টাকা দিয়ে বাজে দ্রব্য কিনবে না। রাষ্ট্র মানুষের অধিকার নিশ্চিত করবে। আমি মনে করি, রাজনৈতিকভাবে বদলাবার আগে সাংস্কৃতিকভাবে বদলানো দরকার।

এই সময়ে, গোটা বিশ্বজুড়ে সংস্কৃতির বিবর্তন সাধিত হচ্ছে। মানুষ ফিরে যাচ্ছে তার মৌলিকতার দিকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপে ফোকলোর সাহিত্য নিয়ে, লোকজ আবহের সংস্কৃতি নিয়ে যে ব্যাপক গবেষণাকর্ম শুরু হয়েছে তা আমাদের অবশ্যই আশার আলো দেখায়। অপসংস্কৃতি কিংবা অপসভ্যতা যেকোনো সমাজে ঢুকে না কিংবা ঢুকতে পারে না­ তা কিন্তু নয়। ঢুকতে অবশ্যই পারে।

কিন্তু বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। অপসংস্কৃতিকে বিদায় নিয়ে চলে যেতে হয়। একইভাবে অপরাজনীতিও কোনো রাষ্ট্রের মূল নিয়ামক হতে পারে না। তাকেও বিদায় নিতে হয়। বর্তমান সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের একজন বিবর্তনবাদী কবি ইউসেফ কমুইয়াকা।

ইউসেফ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, যারা আমার কবিতা পড়বে তাদের আগে আমার সংস্কৃতি জানতে হবে। কারণ আমার কবিতা, আমার পঙক্তিমালার উত্থান হয়েছে আমার মাটি থেকে। যারা আমার মাটিকে চিনবে না­ তারা আমার সংস্কৃতি কী বুঝবে? পাঠক বিবেচনা করুন, তার কথাগুলো কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি, বাঙালী জাতির একটা উজ্জ্বল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে। এটাকে শাণিত করা দরকার।

প্রজন্মকে জাগানো দরকার নীতির পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে। গেল কিছুদিন আগে একটি সঙ্গীত প্রতিযোগিতা দেখছিলাম টিভিতে। সেখানে অন্যতম বিচারক ছিলে কুমার বিশ্বজিত। তিনি আমাদের সাংস্কৃতিক দীনতা বিষয়ে একটা গল্প বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, একজন লোক ধন-সম্পদের দিক দিয়ে সচ্ছল ছিল না।

এর চেয়ে বেশি ছিল সে মানসিকভাবে দীন। সে সবসময় আশা করতো দৈব ধনসম্পদের। একদিন সেই দৈব ধন নিয়ে আলাদিনের চেরাগ এসে হাজির হলো তার সামনে। চেরাগ থেকে দৈত্য বেরিয়ে বললো­ আদেশ করুন- মনিব। আপনি যা চাইবেন­ তাই পাবেন।

তবে শর্ত একটি আপনি যা পাবেন আপনার প্রতিবেশী পাবে তার দ্বিগুণ। ’ লোকটি ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলো। সে ভাবলো­ এটা কেমন করে হয়? আমি যা পাবো আমার প্রতিবেশী পাবে তার দ্বিগুণ! মানসিকভাবে দরিদ্র এবং দীন ঐ লোকটি তাৎক্ষণিকভাবে দৈত্যকে বললো­ ,দৈত্য তুমি আমার একটি চোখ কানা করে দাও। তাহলে আমার ঐ প্রতিবেশী তার দুটি চোখই হারাবে। কুমার বিশ্বজিৎ দু:খ করে বলেন, এই হচ্ছে আমাদের সামাজিক অবস্খা।

আমাদের এই অবস্খা থেকে পরিত্রাণ পেতেই হবে। শিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ যা বলেছেন তা খুবই যৌক্তিক। আমাদের বাঙালি জাতির এই দুর্নাম আছে­ আমরা নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করতে পারি। হ্যাঁ প্রিয় পাঠক, স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আমরা তো সেই জাতি, যারা গণভোট দিয়ে চিহ্নিত আলবদর-রাজাকারদের জাতীয় সংসদে বসিয়েছি। একজন রাজাকার সাংসদ হয়ে যায় আর তার সঙ্গে হেরে যান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

আমাদের গণভোটের শক্তি আছে বৈকি! দুঃখজনক হচ্ছে , আমাদের মানুষেরা জানে না। জানতে চায় না। তারা সামান্য অর্থের কাছে নিজেদেরকে বিক্রী করে দেয়। অথচ আমরা জানি একজন রাজনীতিকের জানা দরকার বিশ্ব রাজনীতির সৃজনশীলতা বিষয়ে। যারা গান গাইবেন তেমন প্রত্যেক শিল্পীরই একাডেমিক জ্ঞান-শিক্ষার ব্যাপৃতি থাকা প্রয়োজন।

কারণ তাকে পড়তে হবে, জানতে হবে সমসাময়িক সঙ্গীত বিশ্বকে, সমসাময়িক রাজনৈতিক বিশ্বকে। বাংলাদেশে রাজনীতির, সংস্কৃতির বিবর্তন আমরা অবশ্যই চাই। তবে তা হতে হবে দীনতাবিহীন। আগে আমাদের সৎ মনোবলে বলীয়ান, দক্ষ সমাজ সংস্কারক এবং বিজ্ঞ বিবেচক হিসেবেই প্রতিষ্ঠা পেতে হবে। মনে রাখতে হবে, যারা রাষ্ট্রের প্রকৃত রাজনৈতিক চেতনাকে, সৃজনশীল শিল্পকে পৃষ্ঠপোষকতা করবেন তারাই কিন্তু এর প্রধান শক্তি।

নিউইয়র্ক --------------------------------------------------------------------------- দৈনিক যুগান্তর / ঢাকা/ ৪ আগষ্ট ২০১১ বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ছবি- গেরী ক্লার্ক ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.