আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একজন সোহেলের গল্প

কবে যাবো পাহাড়ে... কবে শাল মহুয়া কণকচাঁপার মালা দেব তাহারে.... মোবাইলের ইয়ারফোনের তার ছিঁড়ে গেছে খানিকটা। এফএম রেডিও কাজ করছেনা, গান শুনতে গেলেও ঘ্যাঁস-ঘ্যাঁস আওয়াজ করে। নতুন ইয়ারফোনের দাম বোধ হয় এক-দেড়’শ টাকা হবে। এতগুলো টাকা ঝপ করে গাছ থেকে পড়েনা। মাসের পাঁচ তারিখ হয়ে গেলো।

একটা টিউশনির বেতন পেয়েছে সোহেল, বাকি দু’টোর কোনো খবর নেই। মেসের ঘরভাড়া দিয়েই সে টাকা শেষ। ক্যান্টিনে বাকির খাতার অঙ্কটা প্রতিদিনই বাড়ছে। গত কয়েকদিন পায়ে হেঁটে পড়াতে গিয়েছে আজিমপুর, পায়ে হেঁটে এসেছে। আজকে বেতন না পেলে একবেলা খেয়ে কাটাতে হবে কাল থেকে।

মাস্টার্স ফাইনালের ফিস দিতে হবে এক সপ্তাহের মধ্যে। সেটাই বা কোত্থেকে আসবে- কে জানে! সায়েন্স ওয়ার্কশপ বিল্ডিংয়ের সিঁড়ির নীচে বসে এসব কিছুই ভাবছিলো সে। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চললো, সকাল থেকে পেটে পড়েছে এক পিস ডিম-বন। খিদেয় পেট চোঁচোঁ করছে। ‘কিরে দোস্ত! একা একা বসে কি ভাবছিস?’ তানিম ক্লাসের সবচেয়ে আড্ডাবাজ ছেলে।

বাবার হোটেলে খায়, বিসিএসও দেয়নি। মাস্টার্সের পরে নাকি কানাডায় চাচার কাছে চলে যাবে। এখন ঘুরে বেড়ানো আর টাকা ওড়ানো ছাড়া ওর বিশেষ কাজ নেই। ওর সাথে সোহেলের বন্ধুত্ব ফার্স্ট ইয়ার থেকেই। পরীক্ষায় সোহেলের পেছনেই ওর সীট পড়েছে পুরো অনার্সে।

সোহেলই টেনে হিঁচড়ে ওকে পাস করিয়ে এনেছে। পরীক্ষার হলের প্রফেসরদের চোখ এড়িয়ে দিব্বি ওকে সব প্রশ্নের উত্তর দেখিয়ে এসেছে সে সব পরীক্ষায়। অবশ্য তানিমের ওপরও সোহেলের নির্ভরতা কম নয়। ওরা দু’জন যখন একসাথে ঘোরে, তানিমই বেশিরভাগ সময় খাবারের বিল, রিক্সাভাড়া দিয়ে দেয়। সোহেল মাঝেমধ্যে আপত্তি করলে বলে, ‘আরে বেটা, এইটা তো আমার বাপের টাকা।

বাপের কাছে মেলা আছে। একটু কমলে কিছু হইবো না। নিজের পয়সা হইলে কি আর তরে খাওয়াইতাম?’ এমনকি, গত বছর ক্লাসে সবাই মিলে কক্সবাজার ট্যুরে গিয়েছিলো- সেখানেও ওর টাকাটা তানিম দিয়ে দিয়েছিলো। মুখে বলেছিলো ধার, তবে দু’জনেই জানে, সেটা কখনো সোহেলকে ফেরত দিতে হবেনা। সোহেল অলস দৃষ্টিতে তানিমের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নেয়।

মুখে কিছু বলেনা। তানিম আবার বলে, ‘ওই, আইজকা ওয়ারফেজ আইতাসে। যাবি নাকি?’ নতুন সেশনের ছাত্ররা ইউনিভার্সিটিতে আসলেই কনসার্টের ধুম পড়ে যায়। সব কনসার্টেরই আয়োজক ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল। নিজে ওয়ারফেজের বড় ভক্ত হলেও আজকে মোটেই কনসার্ট শোনার মানসিকতা নেই।

সে শুধু বললো, ‘আইজকা তুই যা। শরীরটা ভালা নাই। ’ ‘ধুর! তর এত নাটক ভাল্লাগেনা। শরীরের গুষ্টি কিলাই। তুই যাবি না, তর বাপ যাইবো।

’ তানিম ছাড়তে নারাজ। কনসার্ট শেষে প্রায় দেড়টার দিকে ওরা হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফেরে। রিক্সা পাওয়া যায়নি, তাই এই হাঁটা। একটা জায়গায় এসে দু’জন যে যার পথে চলে। তানিম হাঁটতে থাকে নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

প্রায়ান্ধকার রাস্তায় মাঝে মধ্যে দু’একটা গাড়ি ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ একটা ট্যাক্সিক্যাব প্রচন্ড গতিতে তার পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায়; পরক্ষণেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়া আঘাত করে রাস্তার পাশের একটা গাছে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল সোহেল কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকে। সম্বিত ফিরে পেতেই ছুটে যায় ট্যাক্সিক্যাবের দিকে। ততক্ষণে একে একে পাঁচজন লোক গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে।

বেরিয়েই ওরা ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়ে পাশের গলিতে। মুহুর্তেই চোখের আড়াল হয়ে যায় তারা। শূন্য রাস্তায় শুধু পড়ে রয় সে আর একটা ভাঙাচোরা ট্যাক্সিক্যাব। কিন্তু বেশিক্ষণ নয়। পুলিশের গাড়ির সাইরেন শোনা যায়।

সেটাও ব্রেক করে এসে থামে তার সামনে। দলে দলে পুলিশ নামে; ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের রাস্তায়। একজন ইন্সপেক্টর এগিয়ে আসে ওর দিকে। ‘শুয়োরের বাচ্চা!’ বলেই সোহেলের তলপেট বরাবর কষে লাথি মারে একটা। একটা অস্ফুট জান্তব আওয়াজ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সোহেল।

টের পায়, ওপর থেকে পুলিশের বুট আর রাইফেলের বাঁটের ক্রমাগত বর্ষণ চলছে তার ওপর। অনেক কষ্টে বলে ওঠে, ‘আমি ইউনিভার্সিটির ছাত্র, ভাই। আমার আইডি আছে। ’ তারপরেই জ্ঞান হারায় সে। জ্ঞান ফেরে পুলিশের গাড়িতে।

মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে, রক্ত শুকিয়ে লেগে আছে চোখের ওপর। একটা চোখ খুলতে পারছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওকে টেনে নামানো হয়। গাড়ি থেকে। উঠে দাঁড়ানোর সময় না দিয়েই একটা পা ধরে মাটির ওপর দিয়ে টেনে ছেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় থানায়।

তারপর আবার বেদম মার চলে। ওরা কি প্রশ্ন করছিলো- কিছুই কানে ঢুকছিলো না সোহেলের। শুধু একটা কথাই বারবার আওড়ে যাচ্ছিলো, ‘আমি ইউনিভার্সিটির ছাত্র, ভাই, আমারে মাইরেননা!’ মারগুলো আর গায়ে আগের মতো লাগছিলো না ওর। সব অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গেছে কেমন যেন। দ্বিতীয়বার জ্ঞান হারাবার আগে ঝাপসা অবয়বগুলোকে দেখে নিচ্ছিলো শেষবারের মত।

এদের মধ্যে একজন যেন হাতে কিছু একটা তুলে নিয়েছে। পরক্ষণেই সব অনুভূতি ছাপিয়ে ভয়াবহ একটা যন্ত্রণা টের পায় সে; মনে হচ্ছে যেন কেউ তার একটা পা কোপ দিয়ে কেটে ফেলার চেষ্টা করছে। দ্বিতীয়বার জ্ঞান হারায় সোহেল। - পকেটে কিছু পাইছস? - মানিব্যাগ আর মোবাইল আছে স্যার। মানিব্যাগে ইউনিভার্সিটির আইডি।

- (মুখ খারাপ করে একটা গালি দেন থানার ওসি সাহেব) ***মারানী ****-র পুলা কুন ***টা ফালাইতে আইছিলো ওইহানে? হুন, গতকাইলকার রেইডে দুইটা পিস্তল পাইছিলাম না? হেই দুইটাতে ওর আঙ্গুলের ছাপ নে। রিপোর্ট লিখ। কবি, হেরে গাড়ির মইধ্যে পাইছস। - স্যার, হাত-পা ভাঙছে কেমনে? - আরে বলদ, গাড়ির একসিডেন্ট হইছে না? - স্যার, এইডা তো মেডিকেলে টিকবো না। হেরা বুঝবো, মাইর খাইছে।

- ও... তাইলে ক’ পাবলিকে পিডাইসে। - আর স্যার, চাপাতির কোপ? - আরে ছাগলের বাচ্চা, পাবলিকে পিডাইতে পারে, কোপ দিতে পারেনা? আদালতে ডান্ডা-বেড়ি পড়িয়ে হাজির করা হলো সোহেলকে। অসংখ্য সাংবাদিক, ক্যামেরার ফ্লাশ, হৈচৈ, পুলিশ- সবার ভিড় ঠেলে পাঁজকোলা করে আদালতে নিয়ে যাওয়া হলো। মামলায় তার পক্ষে একটা মানবাধিকার সংগঠনের তরফ থেকে আইনজীবি নিয়োগ করা হয়েছে। পুলিশ কোর্টে বেশ কিছু সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করলো।

তার আঙ্গুলের ছাপওয়ালা পিস্তল, কিছু প্রত্যক্ষদর্শী- যারা তাকে পুলিশের ওপর গুলি ছুঁড়তে দেখেছে, ইত্যাদি। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। আর বসে থাকতে পারলোনা; একদিকে ঢুলে পড়ে গেলো। আদালত থেকে তাকে হাসপাতালের প্রিজন সেলে নিয়ে যাওয়া হলো। দুই সপ্তাহ পরে আবার শুনানির তারিখ এলো।

ডাকাতি, পুলিশের ওপর গুলি ছোঁড়া, ট্যাক্সিক্যাব ছিনতাই, অবৈধ অস্ত্র বহন করা, ইত্যাদি বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে ওর নামে। একেকটা মামলার জন্য একেক দিন শুনানি হয়। তারপর আরেকটা নতুন তারিখ নিয়ে ফিরে আসে হাসপাতালে। এই করতে করতে কেটে গেলো বেশ কয়েক মাস। একটা মামলারও কোনো সুরাহা হলোনা।

প্রায় বছরখানেক ধরে ওর মামলা চলেছিলো। প্রথমে ওসিকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়ে থাকলেও, পরে নাকি সে আবার তার চাকরি ফিরে পেয়েছিলো। প্রথমে প্রায় মাসখানেক পেপারের শিরোনাম হয়ে ছিলো সে। তারপরে ধীরে ধীরে সবাই তার কথা ভুলে যায়। আদালতে আর ওর কেস এর শুনানীতে সাংবাদিকরা আসে নি শেষের দিকে।

অন্যদিকে, মিডিয়ার আগ্রহ কমে গেলে ওই মানবাধিকার সংগঠনও সুড়সুড় করে সরে পড়ে তাদের আইনজীবি নিয়ে। বেকসুর খালাস পেয়েছিলো সে ঠিকই। তবে মামলা চালাতে তার রিটায়ার্ড সরকারী অফিসার বাবা সব পুঁজি শেষ করে, জমিজমা বেচে একেবারে পথে বসেছিলেন। তার বিসিএসএর ইন্টারভিউ দেওয়া হয়নি। মাস্টার্সের ফিস জোগাড় করার চিন্তা থেকেও রেহাই পেয়েছে সে।

বাঁ পা টা গোড়ালি থেকে কাটা পড়েছে। আজ সে একটা মুদির দোকান চালায়। যা পয়সা আসে, তা দিয়ে মোটামুটি দিন-গুজরান হয়ে যায়। একটা সময় তার স্বপ্ন ছিলো সরকারী অফিসার হওয়ার। মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস পাবার।

সবকিছু ভেস্তে গেছে। আজকাল তার স্বপ্ন দেখতেও ইচ্ছে করেনা। শুধু একটাই দোয়া করে আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে- আর যেন কখনো তাকে গ্রেফতার না হতে হয়। আর যেন কখনো তাকে পুলিশ তুলে নিয়ে না যায়। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.