তোমাকে দিয়েছি চিরজীবনের বর্ষা ঋতু; এখন আমার বর্ষাতে আর নেই অধিকার । তবুও জলদমন্দ্রে কাঁপে যেহেতু, চোখ ঢেকে তাই মনে করি শুধু ক্ষনিক বিকার। আকাঙ্খা ছিলো তোমাকে সাজাবে বৃষ্টিকণা...
(এক)
উরিব্বাস!কি ঝকমারি!পুরো বাড়িটা কাচের!সব ফকফকা!এত্ত বড় বাড়ি!তার ভিতরে সব কিছুই রাস্তা থেকে দেখা যায়। কি আজিব জিনিস!কত্ত রঙবেরঙের জামাকাপড়। ইয়া বড় একটা টেলিভিশন।
কি সুন্দর একটা মেয়ে সেখানে নাচা-কুদা করছে!
মহানগরীর কোন এক ঝাঁ চকচকে আলিশান শপিং মলের বাইরে রাস্তায় একজোড়া কচি-চোখ অসম্ভব বিস্ময় নিয়ে সদ্য আড়মোড়া ভাঙ্গা সন্ধ্যায় এইসব দৃশ্য দেখছিলো ও মনে মনে অভিভূত হয়ে যাচ্ছিলো। তার কোন নাম নেই। তার কোন নাম থাকে না । তাতে কি?তার অনেক নাম জুটে যায় অহরহ। চায়ের দোকানের মালিক বলে 'অই ন্যাপা গ্লাসগুলো তাড়াতাড়ি ধুয়ে দে'।
কোন দাদাবাবু বলে 'অই ছোঁড়া গাড়িটা ধুয়ে-মুছে দে'তো। কেউ আবার বলে হ্যাবা,কেউ পিচ্চি। স্টেশনের রামকাকা অবশ্য তাকে ডাকে হরির পুলা। সে জেনেছে পুলা মানে ছেলে। তাহলে সে কি হরি নামক কোন লোকের ছেলে?মাঝে মাঝে সে গভীর রাতে ভাবে সেসব কথা।
শেয়ালদা স্টেশনের বাইরে থিকিথিকি শরীরের মাঝখানে গাদাগাদি করে শুয়ে থেকে যতক্ষণ ঘুম না আসে,সেসব কথা ভাবে সে। ওইটুকু সময়ই। তারপর তার চোখে অগাধ ঘুম এসে সব প্রশ্নের উপর দাড়ি টেনে দেয়।
এছাড়া তার যখন কোন কাজই করার থাকে না,সে শুধু ভাবে। ভাবতে তার বড় ভাল লাগে।
কত যে ভাবনার বিষয় এই যায়গায় তার ইয়ত্তা নেই। যায়গাটাতো আর ছোট না। এইতো সেদিন হাটতে হাটতে একটা যায়গায় চলে গেল। কত্ত বড় রাস্তা সেখানে। চার পাঁচ দিক থেকে কয়েকটা রাস্তা এসে ধাক্কা খেয়ে একযায়গায় এসে গোল হয়ে গেছে।
কত্ত লোক সে রাস্তায়। কত্ত গাড়ি। সে যায়গাটা তো সে আগে দেখেনি!ওদিকে রাজাবাজার আর এইদিকে মৌলালি পর্যন্ত সে চিনতো। তবে?এই যায়গার শেষ নাই। শুধু পা বাড়িয়ে যাও।
রাস্তার কোন শেষ নাই। তেমনি ভাবনারও শেষ নাই।
(দুই)
আই-ফোনটার আচমকা রিংটোনে অংশুর ঘোর কেটে গেল। রিভলভিং চেয়ার থেকে টেবিলের উপর ঝুঁকে সে ফোনটা হাতে নিলো ও রিসিভ করল। ও-প্রান্ত থেকে ভারি গলা-'হ্যালো মিস্টার চ্যাটাজ্জী, সত্যম-এর ডেলিগেশন মিটিংটা মিস্টার মৈত্রের বদলে আপনাকে অ্যাটেন করতে হবে'।
অংশুও প্রি-রেকর্ডেড ভয়েসের মত উত্তর দেয়-'ইয়েস স্যার','নো প্রব্লেম স্যার','ওকে স্যার','স্যারটেনলি স্যার'...।
তারপর কিছুক্ষণ মাথার পেছনে হাত দিয়ে ফের রিভলভিং চেয়ারে ঝুঁকে যায়। মাথার ভেতরে ফের শূন্য বলয়। একটা ঘোর। শহরের অভিজাত এলাকায় আকাশচুম্বী কর্পোরেট বিল্ডিংয়ে তার অফিস।
আধুনিকতার পারিপাট্যে ভরা তার নিজস্ব চেম্বার। একদিকটা শুধুই সুইস গ্লাস দিয়ে ঘেরা। সেখান দিয়ে দেখা যায় শহরের আঁকাবাঁকা দিগন্তরেখা। যন্ত্রের মত ছুটে চলেছে পুরো শহরটাই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুতুলের মত মানুষ।
খেলনার মত গাড়ি,বাড়ি। শুধু ছুটে চলা একে অপরকে পাশ কাটিয়ে। কারো জীবনে অন্য কারো ভূমিকা নেই।
কোম্পানীর দেয়া ঝাঁ চকচকে ফ্ল্যাটে সে ও তার মা থাকে। সারাদিন কর্মব্যাস্তময় সময় কাটিয়ে তার সেখানে ফিরে যাওয়া।
বেশিরভাগ দিনই মা খাবার বেড়ে বসে থাকেন। অংশুর ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। সব সম্পর্কগুলোই ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। অনুভূতি নেই,উত্তাপ নেই। শুধুই নিঃস্পৃহতা।
এই পৃথিবীটাও তো তার কাছে ক্ষুদ্র। ক্লায়েন্টদের হ্যান্ডেল করতে তাকে প্রায়ই উড়ে বেড়াতে হয় ব্যাঙ্কক থেকে অ্যামস্টারডাম,সিডনি থেকে স্যান-ফ্রান্সিসকো। প্রোগ্রামড করা রোবটের মতন সে শুধু নির্দিষ্ট কিছু নির্দেশ মেনে চলে। নিজের ইচ্ছা,অনিচ্ছা বলে তার আর কিছু নেই। একসময় সে কবিতা লিখত।
বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিনে সেগুলোর কিছু ছাপাও হয়েছে। সময়ের চোরাস্রোতে কোথায় যে সেসব ভেসে গেছে কে জানে!আজ তার মধ্যে কোন সৃষ্টিশীলতা নেই। শব্দ খুঁজতে হয়না। চেষ্টা করেও একটা লাইন কলমের ডগায় ধরা দেয় না। সব বিলাসিতা,বিত্ত,বৈভব থেকেও তার আজ এত ফাঁকা লাগে কেন?
(তিন)
কি সুন্দর সুন্দর গাড়ি।
এগুলো যখন রাস্তায় চলে কোন আওয়াজ হয় না। আর ঐ ঢাউস ঢাউস দৈত্যের মতন লরি আর বাসগুলো যখন যায় উফ্, সে কি আওয়াজ!বাপরে বাপ!কানে তালা লেগে যায়!অথচ এই ছোট্ট ছিমছাম গাড়িগুলি যেন হাওয়ায় চলে। কোন আওয়াজ নাই। কি আজিব যন্ত্র। তার কৌতূহল মেশানো নিটোল কচি চোখদুটো এইসব দ্যাখে আর বিস্ময়ে ঘোর লেগে যায়।
একটা হোন্ডা সিটি এসে শপিং মলের পার্কিংলঞ্জে থামে। গাড়ির দরজা খুলে বেড়িয়ে আসে একজন স্যুট-টাই পড়া ভদ্রলোক,উগ্র প্রসাধন করা এক মহিলা আর ছোট্ট ফুটফুটে একটি মেয়ে। তারই সমবয়েসী।
কি সুন্দর গোলাপী রঙের একটা ফ্রক পড়েছে। পায়েও কি সুন্দর ছোট ছোট তুলোর মত গোলাপী রঙের জুতো।
গাড়ি থেকে নেমে মেয়েটি আড়মোড়া ভাঙে। মেয়েটির চোখেও কত কৌতূহল। সে দুহাতের আঙুলের খাঁজে আঙুল ঢুকিয়ে চারপাশ দেখছে। একবার মুখ তুলে আকাশের দিকেও চাইল। তার মা আর বাবা গাড়িতে কি যেন খুঁজছে।
মেয়েটি এবার রাস্তার এপারে দাঁড়িয়ে থাকা তার দিকে চাইল। কিছুক্ষণ নিস্পলক। তারপর একটা স্মিত হাসি দিল। সেও মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হাসল। কি সুন্দর চোখ মেয়েটির।
হাসিটাও কি সুন্দর। একবার একটা বড় দোকানের বাইরের দিকে কাচের শোকেসে রাখা এরকম একটা পুতুল দেখেছিলো । ঠিক যেন সেইরকম একটা পুতুল। সেই পুতুলটা শুধু দাঁড়িয়েই ছিল। এই পুতুলটা নড়তে চড়তে পারে।
মেয়েটি তার মায়ের হাত ঝাঁকিয়ে ছেলেটির দিকে আঙুল তুলে দেখাল। তার মা একবার দেখে মেয়েটির হাত ধরে শপিং মলের গেটের দিকে এগিয়ে গেল। মেয়েটির মুখ কাল হয়ে গেল। সে শুধু একবার মুখ ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তার দিকে তাকিয়ে আরও একবার হাসল। কিছু বলতে চাইল কি?
সে তাড়াতাড়ি রাস্তা ক্রস করে শপিং মলের দিকে এগোল।
শত শত মানুষের স্রোত ঢুকছে আর বেরুচ্ছে মলের গেট দিয়ে। মেয়েটিকে দেখার চেষ্টা করতে করতে সে শপিং মলের গেটের মধ্যে ঢুকে গেল। মেয়েটিকে আর দেখা গেল না। সে-ও ওই স্রোতের মধ্যে ঢুকে গেছে।
হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন তার কাঁধের কলার চেপে ধরল।
নীল ইউনিফর্মের মাথায় পুলিশের মত টুপি পড়া লোকটা তার কলার ধরে টানতে টানতে মলের গেটের বাইরে নিয়ে এলো। ভয়ে তার চোখ বিস্ফারিত। উত্তেজনায় তার ছোট বুকটা ধুকপুক ধুকপুক করছে। 'বাবু সাজবার শখ হয়েছে?হারামজাদা!'এই বলে এক ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল সেই লোকটি। ধাক্কা সামলাতে না পেরে সে একটা লোহার পোস্টে গিয়ে হূমরি খেয়ে পড়ল।
মাত্র কয়েক সেকেন্ড। তারপর দুহাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ঠোটের কাছে চিনচিনে ব্যথা। জ্বিভ দিয়ে জায়গাটা চেটে দেখল। নোনা স্বাদ।
তার চোখে তখন আরও কিছু প্রশ্ন। লবণাক্ত পৃথিবীর তখন বড় তাড়া। তার চোখের মণিতে তখন শত শত মানুষের অন্তবিহীন স্রোত।
(চার)
ধীরে ধীরে রাত গাঢ় হচ্ছে। তার জৌলুস তত বাড়ছে।
নিয়ন আলোর স্তর জমে রয়েছে আকাশে। বিলবোর্ড আর হোর্ডিংগুলো ঝকমক করছে সোডিয়াম আলোয়। গাড়ির আলোগুলো ক্রমশ কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে সারিবদ্ধ ভাবে। আবার একই ভাবে কিছু দূর থেকে কাছে আসছে। যেন লাল,হলুদ,সাদা আলোর মিছিল।
অংশু তার বহুতল অফিস চেম্বারের বিশাল গ্লাস ফ্রেমের সামনে দাঁড়িয়ে এইসব দেখছিলো। না, তার মনে আজ কোন নতুন প্রশ্নের উদ্রেক হয় না। ভাবনা আসে না। তার মনটাই যেন নেই। কংক্রীট তার জীবনযাত্রায় মনটাও কবে জমে পাথর হয়ে গেছে।
ব্রিফকেসটা হাতে নিয়ে সে লিফট বেয়ে নেমে এলো রাস্তায়। একটা সিগারেট ধরালো। তারপর একটা ট্যাক্সি দাঁড় করালো। হাইওয়ে ধরে সোঁ সোঁ করে ছুটে চলেছে ট্যাক্সি। আধখোলা জানলা দিয়ে হু হু করে ঢুকছে বাতাস।
তার চুল উড়ছে। চোখে এসে পড়ছে। পাশ দিয়ে ওভারটেক করে যাচ্ছে মাঝে মাঝে কিছু গাড়ি। বিপরীত দিক থেকেও আসছে দস্যুর মত কিছু গাড়ি। এই ওভারটেকের খেলা কি জীবনেও নেই?প্রত্যেকে প্রত্যেককে ওভারটেক করে এগিয়ে যাচ্ছে।
সে নিজেও কি করেনি?ওভারটেক করতে করতে সে নিজেকেও কখন যেন ছাড়িয়ে এসেছে। হারিয়ে ফেলেছে নিজের সত্তা। হারিয়েছে তার ভালবাসা। শ্রেয়সীকে। শুধুই আরো আরো সামনে এগিয়ে যাওয়ার বাসনায়।
সব হারিয়ে আজ সে নিঃস্ব। নিঃশ্বাস বেয়ে বেরিয়ে আসে শূন্যতা। তার অন্তঃসারশূন্য দেহকান্ডটাকে বয়ে বেড়াতে বেড়াতে আজ সে ক্লান্ত।
মাঝ পথেই সে ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়লো। এই শহর তার খুব চেনা।
ছাত্রজীবনের এই শহর। বন্ধুদের সাথে আড্ডায়,ঘুরে ঘুরে কেটেছে এইসব রাজপথে। অথচ আজ কত অচেনা ঠেকছে। সে কোথায় নেমেছে জানেনা। জানতেও চায় না।
সে জানে এই ক্ষুদ্র পৃথিবীর কোথাও তার হারানোর জায়গা নেই। তবুও সে হারাতে চায় রাত্রির মায়াবী অন্ধকারে। সবকিছুর থেকে সে পালাতে চায় অনির্দিষ্ট কোন গন্তব্যে। হয়তোবা নিরুদ্দেশে। একটা রাজপথের ফুটপাথ ধরে সে নির্বিকার ভঙ্গিতে হাটতে থাকে সোজা।
শহুরে রাতও মায়াবী আলো-ছায়ায় তার দিকে নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অংশু হেটে যায় সরলরেখায়। ক্রমশ মিশে যায় রাতের শরীরে। ছায়াময় বিন্দু হয়ে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।