চতুর্মাত্রিক.কম (choturmatrik.com)
বিকাল।
বেলা পড়ে আসছে। আলোটা কমে গেছে বেশ। রসুনের কোয়ার মত বিকেলের তীর্যক রোদের ঝাঁজটা এখন আর নেই। তবু একটা গুমোট অবস্থা বাতাসে।
আমি একটা সরু গলি দিয়ে যাচ্ছিলাম। পাশের ড্রেন থেকে বিদঘুঁটে গন্ধ আসছে। পুরো গলিটাই ভেজা, কিসের পানিতে কে জানে? সম্ভবত ড্রেন উপচে একটু আগেই বন্যা হয়েছে। টিংটিং করে দুই একটা সাইকেল পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে কাঁপতে কাঁপতে। আমি নিচের দিকে তাকিয়ে পার হতে হতে ভাবলাম ফিরে যাবো কি না।
যে উদ্দেশ্যে এই পথে এসেছি সেটা সফল হবে কিনা আমি ঠিক জানি না। গলিটা ক্রমশ একবার মোটা, একবার সরু হয়ে আমার মনের দ্বিধা আর জড়তাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিলো। অযথা মনের অবশতাকে কাটিয়ে আমি চোয়াল শক্ত করলাম। একটা মুদি দোকান। ঠিকানাটা শিওর হতে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার মুখের শক্ত ভাব দোকানির চোখ এড়ালো না।
সে একদম স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইল। আমি তোয়াক্কা করলাম না, এর চাইতে বড় বাধা গত একমাস ধরে আমি দুহাতে ঠেলে আজকে এখানে দাঁড়িয়ে আছি। পথের শেষ কোথায়? হঠাৎ করে নিজেকে একদম নিঃসঙ্গ একাকী মনে হচ্ছে, মানুষ এত একা!!! আজকে নিজের সাথে নিজের বিচার করতে করতে সহ্যের শেষ সীমায় চলে গেছি। আমার হাতে একটা কাগজ দোমড়ানো অবস্থায় ধরা। তিনদিন আগে ভেবেছিলাম উপমাকে বলবো, সব, একদম প্রথম থেকে।
ও অনেক শক্ত, মনের জোর ওর অনেক বেশি, একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে ওর মাঝে কেমন অনমনীয় একটা সাহস এসে পড়ে। তখন ওকে সেখান থেকে হেলানো কঠিন। আমি জানি ওকে বলাটাই সবচেয়ে বিবেচক কাজ হত। কে জানে, ওকে বললে হয়ত এই মুহূর্তে আমি ওর কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকতাম, এই শুকনো গলি থেকে অনেক দূরে উপমা আমাকে নিবিড়ভাবে ধরে রাখত। কিন্তু আজ সকালের ঐ আলোটা, ঐ আলোটা সব বিগড়ে দিল।
খেয়ে উঠে বের হবার পর বুঝতে পারলাম আমাকে এখনই ব্যাপারটা নিজে দেখতে হবে। আলোটা তার খোলস বদলে ফেলেছিলো সকালে, কিন্তু ঘর থেকে বেরোতেই আমার মাথায় একটা সপাটে রোদের চাপড় দিয়ে সে তার প্রচণ্ড তেজ বুঝিয়ে দিয়েছে। পরম সত্য অনেক নিষ্টুর, অনেক চড়া। যতই খোলসে আটকে রাখো সে এখদিন বের হবেই। আর তাছাড়া উপমা আজকে খামাখাই আমার জন্য কষ্ট করেনি।
অন্তত ওর জন্যে হলেও আমার হাতে ধরা ঠিকানায় আমাকে যেতে হবে। গলি দিয়ে এগিয়ে আমি একদম গায়ে গায়ে লেগে থাকা শ্যাওলামাখা দেয়ালে অস্পষ্ট একটা লেখা দেখতে পেলাম।
১৬৭/১
আমার মনে হলো কেউ আমার গলা টিপে ধরেছে। বুকের মধ্যে দামামা শুরু হয়ে গেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ, একটু পানি খেতে হবে দ্রুত।
আমি কলিংবেল খুঁজে পেলাম না। আমার মনে হচ্ছে সামনের পুরো জগৎটা একদম ঐতিহাসিক কোন জগদ্দল পাথুরে দরজা দিয়ে বন্ধ, আমার সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। হঠাৎ চোখে পড়ল দেয়ালের মাঝে একটু ঘিয়ে রঙের একটা টিনের দরজা। কী অদ্ভুত কারণে আমি সেটা ধামধাম করে ধাক্কাতে শুরু করলাম। ভিতরে দরজা খোলার শব্দ, কেউ একজন আসছে, কলাপ্সিবল খুললো, তারপর একটা কণ্ঠস্বর, "আস্তে বাবা, আস্তে।
এত তাড়াহুড়া কিসের?"
আমি এই মুহূর্তে একটা ময়লা বেতের সোফায় বসে আছি। পাশে একই রকম আরো দুটা চেয়ার, ঘরের ভেতর একটা ঝিম ধরানো ম্লান হলুদ আলো, বাইরের রোদটার ফটোকপি। চিন্তা করে কেমন জানি হাসি পেয়ে গেল। হয়তো ঠোঁটের কোণায় একটু ঝুলেও পড়েছিল কারণ চোখ সরিয়ে টের পেলাম ভদ্রলোক আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন।
"আপনার নাম টা কী বললেন?"
"জ্বি, রোজারিও।
জোসেফ রোজারিও। " এই লোকটা আমাকে আপনি আপনি করছে কেন?
"আচ্ছা। এখানকার ঠিকানা কে দিলো আপনাকে?"
"সেটা তো আসলে জরুরি না, তাই না? আমি কি ভুল জায়গায় এসেছি?"
লোকটা বেশ শক্ত করে দাঁত চেপে ধরলেন। কপালের দুপাশের রগ দুটো স্পষ্ট হয়ে উঠলো।
"আপনি এখানে এসে ঠিক করেননি।
এখানে - এখানে খামাখাই আপনি ঝামেলা বাধাতে এসেছেন। "
"কিন্তু আমার জন্য বিষয়টা কতটা জরুরি আপনি কি বুঝতে পারছেন?"
এরপরে আমি কী বলব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কথাগুলো আমার পক্ষে বলা কতটা কঠিন সেটাও কি এই লোকটা বুঝতে পারছেন না?? আমার চোখে মনে হয় সেই না বলা কথাটা ভেসে উঠেছিল। দেখলাম লোকটার চেহারা একটু নরম হলো। এখন আর তাকে অতটা ক্ষ্যাপাটে মনে হচ্ছে না।
"আমি কখনো ভাবিনি আপনাকে দেখতে হবে। পুরো ব্যাপারটাই আমাদের সবার জন্য একটা দুঃস্বপ্নের মত। এতদিন হয়ে গেছে কিন্তু---"
হঠাৎই টের পেলাম ভারি পর্দার ওপাশে খস্খস্ শব্দটা। লোকটা আচমকা কথা থামিয়ে দেয়ায় শব্দটা আরো কানে বাজল, সেও নিশ্চয়ই টের পেয়েছে। পর্দা সরিয়ে যে মানুষটা বের হয়ে আসলো, তাকে দেখে আমি নিজের অজান্তেই উঠে দাঁড়ালাম।
এতক্ষণ পর্দার পাশে দাঁড়িয়ে নিশ্চয়ই কথা শুনছিল সে।
"রোজারিও, আসো আমার সাথে, ভিতরে চলো। "
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।