চতুর্মাত্রিক.কম (choturmatrik.com)
বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা রিকশা পেলাম।
"এই খালি! নিকুঞ্জ যাবে?"
ভাড়া ঠিক করে উঠে পড়লাম। কালো পিচকিরির মতো রং রিকশাওয়ালার, মাথার ছোট ছোট করে কাটা চুলগুলো ঘামে জবজবে হয়ে চিকচিক করছে। বেচারা নিশ্চয়ই সকাল থেকে রিকশা টানছে! সারাদিনে কত রোজগার হলো তার? আবার মজুরগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো।
লান্চ ব্রেক!
আমি উঠে বসার পর রিকশাটা আস্তে আস্তে চলতে শুরু করলো।
মাথার উপরে সূর্যটা এখনও ঝাঁ ঝাঁ করছে। আজকে একটু বাতাসও নেই। ভ্যাপসা গরমে সিদ্ধ হতে হতে আমি আবার যে সমস্যাটা সামনে আছে সেটা নিয়ে মনে মনে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। রোজারিও! আনমনেই একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে আমার। এতদিন ধরে চিনি ছেলেটাকে, এত ভালো একটা সম্পর্ক, কোন কারণ ছাড়াই এরকম হয়ে যাবে? বাস্তব আসলে এত কঠিন এটা মনে হয় দু'চোখ খুলে দেখেও রোজারিও মানতে চায়না।
পৃথিবীতে কেউ কেউ জন্ম নেয় আজীবন নিজেকে একটা বুদবুদের মধ্যে পুরে নোংরা দুনিয়াটা ঐ আবরণের ভিতর থেকে দেখার জন্য। আমার ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। আমি জানি আসলে রং বলে কিছু নেই এই জগতে। সব রং মিলে মিশে একাকার হয়ে একটা ঘোলাটে সাদা-খয়েরী রং তৈরি করে। ভাল-মন্দ, ন্যায়- অন্যায় এই সবকিছুই আসলে একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ।
মুদ্রা উল্টে নিলে বিশ্ব চরাচর উল্টে যায় না, ঠিকই নিজ নিয়মে চলতে থাকে। মানুষ মরে, মানুষ মারে। কে কেন কোন কারণে কী করে এত কিছু বোঝার জন্য এত বেশি স্ট্যান্ডার্ড আমাদের চারপাশে, যে নিয়ম নীতির ব্যাপারগুলো আমার কাছে ধোঁয়াশার মতো মনে হয়। ঢাকাতে আসার পর থেকেই এই ডাবল-ট্রিপল-মাল্টিপল স্ট্যান্ডার্ড দেখে দেখে একটা শিক্ষা মনে মনে পড়ে নিয়েছি, কেউ আমাকে কোন কিছু বিনামূল্যে দিবে না, আমাকে সেটা নিজেই অর্জন করে, দরকার পড়লে কেড়ে নিতে হবে।
"আপা, কোনদিক যামু?" আচমকা প্রশ্নে চমক ভাঙে আমার।
"বামে যান.....আবার বামে........সামনে ডাইনে যান...... সামনে রাখেন......রাখেন রাখেন এখানে"- একটা পোড়া ইঁটের পাঁচতলা বাড়ির সামনে থামাই রিকশাটা।
রিকশা ভাড়া দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে মনে পড়ে আজকে মাসের শেষ। কাল-পরশুর মধ্যে ভাড়া দিতে হবে। বাড়িওয়ালা মহিলাটা ভালো। বেশ সদালাপী, মোটাসোটা শ্যামলা চেহারা।
সারাদিন বাসায় বসে বসে দেখি নাতনীর সাথে গল্প করেন। ওনার নাতনীটা বেশ আদুরে ছোট্ট বালিকা একটা। কেন যেন পিচ্চি মেয়েটাকে দেখলেই বালিকা শব্দটা মাথায় আসে। আমাকে দেখলে মেয়েটা কেমন যেন জড়সড় হয়ে যায়। নানী ছাড়া আর কাউকেই তার পছন্দ না।
আমরা চারজন মিলে থাকি তিনতলার একটা ফ্ল্যাটে। ছোট ছিমছাম ফ্ল্যাট, চারটা আলাদা রুম, দরজা খুলে ঢুকেই একটা আয়তাকার জায়গা, ওর ডানদিকটাকে ডাইনিং বানিয়ে নিয়েছি আমরা। বামপাশের দুইটা রুমে মাঝামাঝি একটা টিভি রাখা, ডাইনিং টেবিলে বসে দিব্বি টিভি দেখা যায়। ক্লাস আর স্টাডি শেষে ফিরে সন্ধ্যায় আমার সময়টা এখানেই কাটে। এখন দরজা খুলে ঢুকে দুইটা দরজা বন্ধ দেখলাম।
তার মানে সোমা আর পুষ্পি এখনও ফেরেনি।
আরেকটা দরজা হাট করে খোলা, ওটার দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে জেনির বিয়ে হয়ে গেছে, গত সপ্তাহে ও এসেছিল তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যেতে। আমরা বাকিরা অনেক হাসিমুখে "কনগ্র্যাটস", "কনগ্র্যাচুলেশনস্" জানিয়ে জিনিসপত্র টানাটানিতে হাত লাগিয়েছিলাম। ওর জামাইটাও এসেছিল। ভোলাভালা একটু স্থূল অবয়ব।
একপাশে শার্টের হাতা গুটিয়ে হাঁকডাক করছিলো। একফাঁকে পুষ্পি হুট করে বলে বসলো, "আপনার তো মনে অনেক আনন্দ হচ্ছে, বউ নিয়ে নতুন সংসার শুরু করছেন, তাই না?" কথাটার ভঙ্গিতে কেমন একটা ব্যাপার ছিল, জেনি ঝট্ করে একবার তাকিয়েই আবার বাক্সের মধ্যে বই রাখার কাজে মন দিল। পুষ্পি টা এমন করে মাঝে মাঝে! আশে পাশের সবাইকে এরকম অস্বস্তিতে ফেলে মনে হয় ও কোন একটা বিজাতীয় আনন্দ বোধ করে। এই বিয়েটা জেনি বলতে গেলে নিমরাজি হয়েই করেছে। ওর বাবা-মা, বিশেষ করে ওর মা খুব করে চাচ্ছিলেন এই বিয়েটা হোক।
চাপাচাপি শেষ দিকে এমন প্রকট হলো যে জেনিকে রাজি করাতে ওর মা এসে থাকা শুরু করলেন আমাদের এখানে। পুষ্পি তখন থেকেই হঠাৎ হঠাৎ এরকম খোঁটাচ্ছে। আমরা জানি কারণটা কী। এখানে সব কাজে জেনি ছিল সবচেয়ে গোছানো, ঠাণ্ডা মাথার, খানিকটা চুপচাপ, ধীর-স্থির, শান্ত। আর পুষ্পি তার পুরো উল্টা।
কিন্তু কোন এক অদ্ভুত কারণে ওদের মধ্যে কেমন একটা টান ছিল। জেনি একটু আলাদা নজর রাখতো পুষ্পির ওপর। পুষ্পি প্রায়ই ঠাট্টা করে বলতো, "ওরে তোর মত একটা বউ দরকার আমার, ঘর গুছাবে, থালা-বাসন মাজবে, রান্নাবান্না করে খাওয়াবে। আমি মহাসুখে আমার হাব্বি-র সাথে মৌজ করবো। " সেই কথাটাই মনে হয় টেলিপ্যাথির মত করে জেনির বাবা-মা একদিন বুঝে গেলেন।
ঠিক একটা চাকুরিজীবি, ছা-পোষা বর নিয়ে এসেছেন জেনির জন্য। পুষ্পির মনে হয় ব্যাপারটা লেগেছে, খানিকটা জেনিকে হারানোর দুঃখ, খানিকটা ওভাবে বলার অনুশোচনা, সব মিলিয়ে শেষদিকে পুষ্পি জেনির সাথে কেমন জানি আচরণ করতো! এখন যাওয়ার সময়ও পুষ্পি ছাড়ছেনা দেখে জেনিও মনে হয় অবাক হয়েছিল। পাগল বাচ্চা একটা পুরা!
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।