চতুর্মাত্রিক.কম (choturmatrik.com)
[ এই খণ্ডটা লিখতে খুব কষ্ট হয়েছে, একবার পুরো লিখে ফেলেছিলাম, প্রকাশের আগেই বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের কারণে পুরোটাই হারিয়ে গেছে। পুনরায় লেখাটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার, এজন্যই অনাকাংক্ষিত বিলম্ব। সবাইকে পূর্বের খণ্ডগুলো পড়ে এটি পড়ার অনুরোধ করছি। এটি শেষ পর্ব। সবাইকে ধন্যবাদ আর শুভেচ্ছা।
]
রোজারিও ঝট করে উঠে দাঁড়ায়, সামনে তাকিয়ে সে যাকে দেখল, খয়েরী পর্দা সরিয়ে যে মানুষটা তার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে সে একদমই আশা করেনি। দুপুরে ঠিক যেমন কল্পনা করেছিল সে, তেমনি টান টান করে বাঁধা চুল, একপাশে পর্দা ধরে রাখা হাতটা ছেড়ে দিয়ে উপমা রোজারিওর দিকে এগিয়ে আসে। ওর হাত ধরে বলে, "রোজারিও, আসো আমার সাথে, ভিতরে চলো। "
"কি-ক্-কিন্ত, কিন্তু তুমি কোত্থেকে এলে? এখানকার ঠিকানা কীভাবে পেলে?"
একটু ইতস্তত করে উপমা বলে, "তুমি দেখা করতে এলে না, আমি পরে তোমার বাসায় ফোন করেছিলাম, তোমার মা ধরেছিল। উনি জানালেন....." ওর চোখে ইতস্তত ভাবটা বাড়ে, "উনিই আমাকে ঠিকানা দিলেন।
"
রোজারিও ওকে দেখে কী করবে বুঝে পায় না, ওর কি খুশি হওয়া উচিত, না রেগে যাওয়া উচিত? হঠাৎ করে উপমাকে দেখে যে চিন্তাটা মাথা থেকে সরে গিয়েছিল সেটাই আবার ফিরে এল। উপমা রোজারিওর হাত ধরে এগিয়ে গেল। একটা সরু প্যাসেজ দিয়ে এগিয়ে ওরা দুইজন আরেকটা ঘরে এল। শোবার ঘর। একটা বিছানা, কালচে ড্রেসিং টেবিল, ছোট একটা টুল তার সামনে, ঘরে ঢুকে বামপাশে একটা চেয়ার রাখা, কিন্তু সব এড়িয়ে রোজারিও উপমার কাঁধের ওপর দিয়ে একজন মহিলাকে বিছানায় বসে থাকতে দেখল।
নীল পাড়ের সাদা শাড়ি পরনে মহিলার, বুড়োটে মুখের গড়ন, মাথার পাতলা চুলে একটু একটু পাক ধরেছে। একদম পাথরের মত স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন তিনি, মনে হচ্ছে একটু আগেই তাঁর উপর দিয়ে খুব বড় একটা ঝড় বয়ে গেছে। রোজারিও মহিলার চোখের দিকে তাকিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল, কেউ যেন মোটা মোটা পেরেক দিয়ে ওর পা দুটো মেঝের সাথে পুঁতে দিয়েছে! উপমা ওকে ছেড়ে ঘরের মাঝে রাখা বিছানার কোনায় বসল। রোজারিওর হাতে তখনও কাগজটা ধরা, একটু একটু করে এগিয়ে ও পাশে রাখা চেয়ারটাতে বসল। উপমা ওর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল ওর স্তব্ধ শরীরের ভিতরে কী ঝড় বইছে! সে অপেক্ষা করছিল, মনে মনে ভাবছিল ওর কিছু বলা উচিত কিনা।
দুপাশে বসে থাকা দুজন মানুষ কী ভাবছে তা সে কল্পনাও করতে পারছে না! নীরবতাটা যখন ক্রমশঃ অসহনীয় হয়ে উঠছিল তখন হঠাৎই রোজারিও কথা বলে উঠে, "আমি গত একমাস ধরে ভাবছিলাম, ভাবছিলাম আজকের কথা। আজকে সকালে উঠে আমি আসতে চাইনি। আরো একটা দিন হয়ত পার হতো যদি না আসতাম-" এটুকু বলে মুখ তোলে সে, "কিন্তু কিছু ব্যাপার আমি আজও বুঝে উঠতে পারি নাই, হয়তো কোনদিন বুঝতেও পারবো না, কিন্তু সেটা বোঝা আমার জন্য খুব জরুরি," একটু দম নেয় সে, সোজা হয়ে বসে সরাসরি মহিলার দিকে তাকিয়ে তীব্র স্বরে বলে ওঠে, "আপনি কি করে আমার সাথে এরকম করেছিলেন? আমি কী অপরাধ করেছিলাম?"
ওর প্রশ্নগুলো যেন ঘরের মধ্যে গুমোট বাতাসে কিছুক্ষণ ভেসে রইল।
উপমা ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, তিনি কাঁপছেন, একটা বুনো কান্না তাঁর শরীরের ভেতর থেকে বের হয়ে আসার জন্য পথ খুঁজছে, রোজারিওর দিকে তাকিয়ে তিনি যেন বহু কষ্টে বললেন, "আমাকে.......আমাকে পারলে ক্ষমা করে দাও বাবা, আমি কতবড় পাপ করেছি এ জীবনে তা খালি আমিই জানি, সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমি সারাজীবন ধরে করে যাচ্ছি। যতদিন বেঁচে থাকবো হয়ত ততদিন এই অভিশাপ নিয়েই দিন কাটাতে হবে! আমি জানি আমার কিছু করার ছিল না।
আজ তোমাকে আমার সামনে দেখে আমার কী কষ্ট হচ্ছে-"
এবার আর তিনি কান্না আটকে রাখতে পারলেন না। উপমার খুব খারাপ লাগছিল, রোজারিওর জন্যে, ওনার জন্যে। যতক্ষণ তিনি কথা বলছিলেন রোজারিও তাঁর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, ওর চোখে রাগ, বেদনা, কষ্ট আর ক্ষোভ মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।
একটু সামলে তিনি আবার বলতে শুরু করেন, কান্নাভেজা স্বরে, থেমে থেমে বলতে থাকেন তিনি, "আমার তখন অনেক কম বয়স ছিল। এই দুনিয়ার অনেক কিছুই বুঝতাম না।
খালি প্রবল বিশ্বাস ছিল আমার, আমার প্রভু আমাকে দেখবেন। আমাকে কখনোই ছেড়ে যাবেন না। তার ওপর আমার কী অটল বিশ্বাস ছিল! ঐ বয়সে আমি নান হবো বলে ঠিক করেছিলাম, আমাকে যে জীবন বেছে নিতে হয়েছিল তা যে আমার জন্য কত আনন্দের ছিল তা খালি আমিই জানি। শুধু একটাই ভুল হয়েছিলো আমার, যে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত আজও করে যাচ্ছি। আমি একজনকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম।
আমি আর আমার ঈশ্বর জানেন তা কত পবিত্র ছিল। কিন্তু-" তিনি যেন কথা হারিয়ে ফেললেন, শূন্যচোখে রোজারিওকে দেখে বললেন, "তোমার জন্মের পর থেকে আমি নিজেকে এই বাসার মধ্যে বন্দী করে রেখেছি, এতগুলো বছর ধরে এমন একটা দিন নাই যেদিন তোমার কথা আমার মনে পড়ে নাই। রোজ প্রভুর কাছে হাতজোড় করে প্রার্থনা করি যেন তিনি তোমাকে ভালো রাখেন, যেখানেই থাকো, কোনদিন যেন কোন অশুভ ছায়া তোমার উপর না পড়ে, আমার ছায়া। "
রোজারিও প্রবলভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে উঠে দাঁড়ায়, "আমি এই কাগজটা পেয়েছি একমাস আগে, একটা পুরোনো আলমারিতে আরো অনেক অপ্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সাথে। এটা আমার কাগজ, আমার জন্মের কাগজ! লুকিয়ে জন্ম দিয়েছিলেন আমাকে আপনি, তাই না? ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে গিয়েছিলেন।
এই জন্ম পরিচয় আমার পালক বাবা-মা ও লুকিয়ে রেখেছিলেন আমার কাছে, গত সাতাশ বছর! আমার পরিচয় সবার কাছেই লজ্জার, লুকিয়ে রাখার জিনিশ। এভাবে অন্যের পাপের শাস্তি কেন আমাকে পেতে হবে?" কাগজটা ছুড়ে দেয় সে, "গত একমাস ধরে আমি কী প্রচণ্ড কষ্টের মধ্যে কাটিয়েছি, তা কি আপনি জানেন? আমার চারপাশের সবকিছু মিথ্যা হয়ে গেছে, যাদেরকে বাবা-মা বলে জানতাম, তারা আসলে আমার কেউ না, যাদেরকে বিশ্বাস করতাম তারা এতদিন আমার সাথে প্রতারণা করেছে, শুধু-" এপর্যন্ত বলে উপমার দিকে ফেরে সে, "শুধু তুমি আমাকে কোন মিথ্যা বলনি, আমার সাথে কোন প্রতারণা করো নাই। এজন্য আজ ভেবেছিলাম তোমাকে সব বলবো। "
উপমা বুঝতে পারেনা রোজারিও কী বলতে গিয়েও থেমে গেল। আজকে দুপুর থেকে ওর মনে একটা অশুভ ডাক দিচ্ছে।
রোজারিও কী ভাবছে??
উপমাকে কাছে টানে রোজারিও, আস্তে আস্তে বলতে থাকে, "আমি অনেক ভেবেছি, নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করেছি। শেষ পর্যন্ত সবকিছুর শেষ উত্তরটা আমার জানা দরকার ছিল। তোমার সাথে আজ দেখা করলে আমার হয়তো এখানে আসা হত না। " রোজারিওকে দেখে মনে হয় মনস্থির করে ফেলেছে, "আমার জন্ম, এই জীবন, সব একগাদা মিথ্যার উপর দাঁড়িয়ে, যে আমাকে জন্ম দিয়েছে, তার কাছে আমি পাপ। যারা আমাকে বড় করেছে, তাদের কাছে আমার পরিচয় গোপন এক লজ্জা।
এই কঠোর সত্যটা আমার জানার দরকার ছিল। আমি চাই নাই তুমি সেসময় এখানে থাকো। যে লড়াই আমার মধ্যে চলছিল, তা আজ শেষ হলো। "
রোজারিও হাত দিয়ে উপমাকে ঠেলে দুরে সরিয়ে দেয়, উপমা কিছু বুঝে ওঠার আগেই রোজারিও পিঠের দিকে হাত দিয়ে পিস্তলটা বের করে আনে। উপমা ওটা দেখেই চিৎকার করে ওঠে, "না-আ, রোজারিও না-আ-আ........."
রোজারিও দুই পা পিছিয়ে পিস্তলটা আলগোছে হাতে ধরে রাখে।
এক মুহূর্ত, কিংবা আট জন্মও হতে পারে, কী যেন ভেবে নেয় ও, চোখের কোণে অশ্রুকণাটা চিকচিক করে ওঠে, নলটা মুখের ভিতর পুরে সবশক্তি দিয়ে ট্রিগার টেনে ধরে রোজারিও।
বোমা ফাটার মত আওয়াজ হয় ঘরের মধ্যে। সেই আওয়াজে উপমা আর রোজারিওর জন্মদাত্রীর চিল-চিৎকার ক্ষণিকের জন্য ডুবে গিয়েছিল, কিন্তু পরক্ষণেই তা পাতলা কাগজের মত ছিঁড়ে ফেলে চারপাশের বাতাস। ঘরের মধ্যে হুটোপুটি, নোংরা ঘোলাটে আলোয় বেখাপ্পাভাবে পড়ে আছে রোজারিওর নিথর দেহ। গাঢ় রক্তের ঢেউয়ে ঘর ভেসে যায়, দেয়াল, চেয়ার, বিছানা, বিশ্ব-চরাচর ভেসে যায়।
সেই প্লাবনে উথাল পাথাল ভাসে টুকরো টুকরো রোজারিও। যেন আজ এই ঘরে নিজের অজানা অপাংক্তেয় জন্মদাত্রীর কাছে এসে সে তার সর্বস্ব দিয়ে গেল।
(সমাপ্ত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।