© এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের। তাই লেখকের অনুমতি ব্যতীত অন্য কোন প্রিন্ট বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে ব্যবহার না করার অনুরোধ রইল...
ভার্সিটিতে আমার বন্ধু খুব বেশি হয়নি। পড়াশোনার পাশাপাশি কয়েকটা কোচিং এ ক্লাস নিতাম, আর ছিল শেয়ার ব্যবসা। বন্ধুদের সময় দেয়া হয়নি খুব একটা। ক্লাস-মেটদের চেয়ে সিনিয়র ভাইদের সংগেই সম্পর্ক ছিল বেশি আন্তরিক।
খুব কাছের একজন বড় ভাই ছিলেন সাজ্জাদ ভাই। তাকে আমি মজা করে গুরু ডাকতাম। আমার সুখে-দুখে সব সময়ই তিনি পাশে ছিলেন। প্রেম বিষয়ে সাজ্জাদ ভাইয়ের একটা কনসেপ্ট ছিল-“শ্যাম পিরিতি”। আসুন জানা যাক, শ্যাম পিরিতির ধরণ:
রাত আনুমানিক এগারোটা।
ভার্সিটির প্রথম তিন বছর ছিলাম চট্টগ্রামের রেলওয়ে অফিসার্স কলোনিতে (সি.আর.বি নামে অধিক পরিচিত), একটা রুম ভাড়া নিয়ে। আমি যে এলাকাটিতে থাকতাম, ছিনতাইয়ের জন্য তা আদর্শ বলা চলে। যেদিন পকেটে টাকা-পয়সা বেশি থাকতো, সেদিন রাতে রুমে ফেরার সময় লালখান বাজারে সাজ্জাদ ভাইয়ের বাসায় টাকা পয়সা, মানিব্যাগ, মোবাইল রেখে যেতাম। শুধু সিম কার্ড আর চাবি সাথে নিয়ে বাসায় ফিরতাম।
এমনই এক রাতের কথা।
ওয়াসা মোড়ে আড্ডা দিয়ে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এদিকে আবার শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। ডিসিশান নিলাম, রাতে সাজ্জাদ ভাইয়ের বাসায় থেকে যাবো। যেই কথা সেই কাজ। চলে গেলাম ভাইয়ের বাসায়।
ওনাদের বাসায় দুইটা রুম, বাইরের দিকের রুমে থাকেন সাজ্জাদ আর তারেক ভাই, আর ভেতরের দিকে মুহিব ভাই আর হাসান ভাই। রুমে ঢুকেই বুঝলাম আবহাওয়া গরম। সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছে, তাস খেলছে। অনেক মানুষ দেখে ড্রেস চেন্জ করার জন্য ভেতরের রুমে ঢুকতে চাইতেই গুরু আমাকে ইশারা করলেন, দরজাও দেখি ভেতর থেকে লক করা। বুঝলাম ভেতরে শ্যাম-পিরিতি চলছে।
আমাকে একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে সাজ্জাদ ভাই জানালেন শ্যাম-পিরিতির নায়ক-নায়িকা সম্পর্কে। হিমেল ভাই আর রিমি আপু। মোবাইলে প্রেম ওনাদের। আজকে রাতে এখানেই থাকবেন। এমন ঘটনা নতুন নয়।
মাসে দু-একবার এ ধরণের ঘটনা ঘটেই। ব্যাচেলর বাসার সুযোগ অনেকেই নেয়। যেসব পোলাপাইন জীবনে বন্ধুর পেছনে ৫ টাকার একটা সিগারেট খরচ করেনা, শ্যাম-পিরিতি করতে এসে ওরা হাজী মুহম্মাদ মুহসীনকেও হার মানায়। ২-৪ ঘন্টা সময় কাটানোর বিনিময়ে সবাইকে কাচ্চি-বিরিয়ানি খাওয়ায়।
হিমেল ভাইয়ের সংগে রিমি আপুর এই শ্যাম পিরিতি অনেকদিন স্থায়ী হলো।
এক বছরের উপরে। প্রায়ই তারা বিভিন্ন বাসায় গিয়ে অনুভূতির লেনদেন করতেন। কিন্তু খুব একটা স্বীকার করতেন না। উপরে উপরে সব সময় ভাল-মানুষী একটা ভাব।
গুরুর বাসায় মাঝেমধ্যে লাল পানির আসর হয়।
কেউ রেজাল্ট ভাল করলে, বার্থ ডে, ভাল কোন আইপিও পেলে, নতুন প্রেম হলে কিংবা চাকুরী পেলে সবাই মিলে আয়োজন করা হয়। সর্বকণিষ্ঠ সদস্য হিসেবে সেসব পার্টিতে মাঝে-মধ্যে আমিও নিমন্ত্রণ পেতাম। খুব মজা হতো। প্রচুর খাবারের সাথে থাকতো মদ। আমার অংশগ্রহণ ছিল লিমিটেড।
শাহিন ভাই চমতকার সব গান গাইতেন। এমনই এক পার্টির কথা।
হিমেল ভাই আজ একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছেন মনে হয়। কারণ তার কথাবার্তা জড়িয়ে যাচ্ছে। আমার আর গুরু একটু আড়াল হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলছি।
অন্যরাও একটু ঝিমিয়ে গেছে। হঠাত করেই হিমেল ভাই সাজ্জাদ ভাইয়ের পা জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলেন, আমার এখন কি হবেরে সাজ্জাদ...
আমি কিছুটা থতমত খেয়ে গেলাম। সাজ্জাদ ভাই খুব উদাসী গলায়
বললেন, ক্যান কি হইছে তোর??
আমার তো সব শ্যাষ হইয়া গেলরে দোস্ত!!
কিচ্ছু হয় নাই। ফালতু কথা কবিনা।
কিচ্ছু হয় নাই মানে? রিমি আমারে ছাইড়া গ্যাছে তুই জানস না? খানিক রেগে গিয়ে কথাটা বললেন হিমেল ভাই।
তার কান্না একটু সময়ের জন্য থেমে গিয়ে আবার শুরু হয়েছে...
সিগারেট টানতে টানতে উদাস গলায় সাজ্জাদ ভাই বললেন, রিমি তোরে ছাইড়া গ্যাসে গা?
হ।
আরে ব্যাটা হেয় তোর ছিলই কবে? দুই দিনের মোবাইল প্রেম, ব্যাপার নাহ্।
ব্যাপার নাহ মানে? তুই জানস আমি ওরে কত লাভ করতাম?
ওরে লাভ করতি তুই?
ক্যান তুই জানস না? হিমেল ভাই আবার ক্ষেপে যাচ্ছেন। বোঝা যাচ্ছে তিনি যা করছেন সব নেশার ঘোরে।
এহন জানলাম।
হুন দোস্ত, মাল মনে হয় একটু কম পড়ছে। ধর আরেকটু খা। খায়া একটা ঘুম দে, সকালে উইঠ্যা দেখবি সব ঠিক। এই বলে সাজ্জাদ ভাই হিমেল ভাইয়ের দিকে বোতল এগিয়ে দিলেন।
বোঝা যাচ্ছে হিমেল ভাই আবার রেগে যাচ্ছেন।
তিনি চোখ ছোট ছোট করে তাকাচ্ছেন। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য সাজ্জাদ ভাই রিভার্স খেলতে শুরু করলেন।
শোন দোস্ত, আমি জানি তুই আবার শক্ত হয়া যাবি। ডোন্ট অরি। খালি একটু অপেক্ষা কর।
সব ঠিক হইয়া যাইব। একটা প্রেমে ছ্যাকা খাইয়া তুই যদি ব্যাকা হয়া যাস তাইল হইল?
এইডা প্রথম না, এর আগেও ছ্যাকা খাইছি। কিন্তুক এইডা ছিল রিয়্যাল প্রেম।
ওওওও... এর আগেও খাইছস? তাইলে তো ব্যাপারই নাহ। চিন্তা করিস না।
রিয়্যাল প্রেম আবার হইব। রিমি গেছে, এইবার সিমিরে ধর...
সিমি ক্যাডা?
সিমি কেউ না। এমনেই কইলাম। তুই আরেকটু খা, সিমি না আইলে তিমি আইব, টেনশান লইস না। এখন ঘুমা ভাই।
ওনাদের কথা শুনে আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। হাসতেও পারছিনা। শব্দ করে হেসে উঠলে হিমেল ভাই আরো খেপে যাবেন। এখন আর উনি স্বাভাবিক নাই, যা বলছেন সব নেশার ঘোরে। পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবেনা।
হিমেল ভাই আর কিছু না বলে কটমট করে সাজ্জাদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার কিছুক্ষণ পরেই ঘুমিয়ে পড়লেন। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সকাল বেলা কাউকে কিছু না বলে কোথায় যেন চলে গেলেন তিনি। আমাদের ঘুম ভাংগলো বেলা ১২টার দিকে। দরজা খোলা দেখেই সাজ্জাদ ভাইকে জাগালাম।
তিনি খুব নির্লিপ্ত গলায় বললেন, ব্যাপার নাহ। যেখানে খুশি যাক, আয়া পড়ব। আমারে তুমি চেনাও? শোন ছোটা, এইসব পোলাপাইন আমার চেনা আছে। আমি সাজ্জাদ বছরের পর বছর এক মাইয়ার পেছনে ঘুইরা তার ল্যান্জার নাগালও পাই নাই। অথছ এইসব ফালতু পোলাপাইন আমার চোখের সামনে একের পর এক লুইচ্চামি কইরা গেল।
কত ঘুরলাম, কত চেষ্টা করলাম। মেয়ে কিছুতেই রাজি হইলো না। পরে শুনছি, সেও শ্যাম-পিরিতি করে। হুনো মিয়া, বর্তমান দুনিয়াতে যে যাত বড় লুইচ্চা, সে তত বড় প্রেমিক। তুমি দরজা লাগায়া দিয়া ঘুমাও।
সাজ্জাদ ভাইয়ের বিষয়টা আমি জানি। এক মেয়েকে ভীষণ রকম পছন্দ করতেন। যতদূর বুঝি, ওই মেয়ের জন্য কোনদিক থেকেই সাজ্জাদ ভাই অযোগ্য ছিলেন না। কিন্তু কিছুতেই মেয়েকে রাজি করানো যায় নি। কিন্তু অদ্ভূত ব্যাপার হলো, ক্যাম্পাসের এক ফালতু টাইপ ছেলের সংগে ওই আপুরও শ্যাম-পিরিতির গল্প প্রচলিত আছে।
সাজ্জাদ ভাই এটা নিয়ে অনেক কষ্ট পেয়েছেন, এখন স্বাভাবিক।
এই ঘটনার পর প্রায় এক সপ্তাহ হিমেল ভাইয়ে ফোন বন্ধ। তার কয়েকদিন পর জানা গেল তিনি ঢাকায় আছেন। সবকিছুই স্বাভাবিক।
প্রায় মাস দু’য়েক পরে একদিন বিকেলে কোচিং শেষ করে আমি আর সাজ্জাদ ভাই জিইসি থেকে হেঁটে ওয়াসার দিকে আসছি।
সাজ্জাদ ভাই আমাকে আংগুল দিয়ে ইশারা করলেন, নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারলাম না। হিমেল ভাই আরেক মেয়ের সাথে খুব আন্তরিক ভংগীতে রিকশা করে যাচ্ছেন। হাতের ভেতর হাত ঢুকানো। কিছু না ভেবেই আমি ডাক দিয়ে বসলাম, হিমেল ভাই...
হিমেল ভাই কাছে আসলেন, রিকশা থেকে নেমে আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিলেন, আপুর নাম তুষ্টি!! বাড়তি কোন কথা না বলার জন্য সাজ্জাদ ভাইয়ের ইশারায় আমি চুপসে গেলাম। বাসায় আহিস দোস্ত, এই বলে সাজ্জাদ ভাই বিদায় জানালেন।
কি বুঝলা?
কিছুই বুঝলাম না গুরু, খোলাসা করো।
এহনো বুঝো নাই? এইডা হইল তোমার নতুন আপু, তুষ্টি আপু। বুঝো নাই?
হ বুঝছি।
বুঝলা ছোটা, এইডার নামই শ্যাম পিরিতি।
হ ভাই।
ছোটা...
কি ভাই?
তোমার একটা কবিতা আছেনা? কি যেন, ছিঁড়া জিন্স, ময়লা শার্ট...
হ ভাই, আছে।
কওছে দেহি।
“ছেঁড়া জিন্স পড়া শকুনের দল
হামলে পড়বে তোমার দেহ-মন্দিরে
ক্ষত-বিক্ষত, রক্তাক্ত-অপবিত্র করবে তোমায়
অথছ কী আক্ষেপ!!
আমি সেখানে পুঁজো দিতে পারতাম সারাটা জীবন.....”
ভালই হইছে।
কি?
তোর কবিতা।
থ্যাংস গুরু।
তুই প্রেম করস না?
নাহ। আমার লগে প্রেম করব কেডা?
হ, কবিতা তো বানায়াই ফালাইসস, কী আক্ষেপ!!
হ ভাই, আক্ষেপ!!!
সাজ্জাদ ভাই সিগারেট ধরিয়েছেন। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। তবু বাসায় যাওয়ার তাড়া নেই কারো মাঝেই। আমরা টিপটিপ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি ধীরে ধীরে.... মাথার ভেতর এলোমেলো ভাবে ভেসে উঠছে একজন মায়াবতীর নিষ্পাপ মুখচ্ছবি...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।