গত ১৬ জুন বাংলাদেশ সরকার কনোকো ফিলিপসের সাথে বঙ্গোপসাগরে তেল এবং গ্যাস উত্তলোনের চুক্ত করে। এই চুক্তির ফলে কনোকো ফিলিপস বঙ্গপসাগরের ১১ এবং ১২ নম্বর ব্লকে তেল গ্যাস উত্তোলনের ইজারা পেল। বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে দেশের মালিক জনগণ এবং দেশের সমস্ত সম্পদ জনগণের। কিন্তু আমাদের সরকার বাহাদুর সংবিধানের পবিত্রতা রক্ষায় বদ্ধপরিকর হলেও এই চুক্তি এখনো জনগণের সম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। এমনকি সংসদে এই নিয়ে কোন আলোচনা করা হয়নি।
অর্থাৎ যারা এই সম্পদের মালিক তাদেরকে এই চুক্তি সম্পর্কে পুরোপুরি অন্ধকারে রাখা হয়েছে। যদিও সংবিধানের পবিত্রতা রক্ষার্থে এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ( ! ) মাঝে মাঝেই দেশে কুরুক্ষেত্রের রক্ত গঙ্গা বয়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়েও দেশে এই সংবিধান নিয়ে যথেষ্ট টানা হ্যাঁচড়া চলছে। এই সব টানা হ্যাঁচড়া কতটুকু জনস্বার্থে তা এই থেকে বুঝা যায়। শুধু এখন নয় অতীতেও বহুবার দেশবিরোধি অনেক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি।
আমাদের সাধারণ জনগণের জন্য সবসময় মূলা'ই ঝুলিয়ে রাখা হয়।
কনোকো ফিলিপসের সাথে বর্তমান চুক্তির ক্ষেত্রেও একই বাস্তবতা। এই চুক্তটি করা হয়েছে পিএসসি ( প্রডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট ) মডেলের অধীনে। এই মডেলটি স্বাক্ষরিত হয় বিগত সেনা সমর্থিত জরুরি সরকারের আমলে। এই চুক্তি অনুযায়ী কনোকো ফিলিপস উত্তোলিত তেল বা গ্যাসের আশি শতাংশের মালিকানা পাবে।
বাকি বিশ শতাংশ বাংলাদেশ সরকার পাবে। তবে এই কুড়ি শতাংশ সরকারকে নিজ দায়িত্বে নিয়ে আসতে হবে। দুইশো আশি কিলোমিটার দূরে গভীর সমুদ্র হতে এই গ্যাস নিয়ে আশা কতটুকু সম্ভব সেটা একটা বিষয়। আনার জন্য এই বিশাল ব্যয় বহন করার পর তা কতটুকু লাভজনক হবে সেটা কোনমতেই পরিস্কার নয়। কনোকো ফিলিপস যে আশি ভাগ পাবে তা যদি বাংলাদেশের কোন বেসরকারি কোন সংস্থা অথবা পেট্রোবাংলা না কেনে তাহলে তা বিদেশে রপ্তানি করবে কনোকো ফিলিপস।
এই ক্ষেত্রে তারা তাদের ইচ্ছেমত দর হাঁকানোর সুবিধা পাবে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এই চুক্তিতে দেশের স্বার্থ হানী হয় এরকম কোন ধারা নেই। এই চুক্তি কোনভাবেই দেশবিরোধী নয়। যারা এই চুক্তির বিরোধিতা করছে তাদেরকে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের কে বলা হচ্ছে বিদেশের দালাল ও চর। এমনকি সংসদে একজন মন্ত্রি তাদের কে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করেছেন।
ঐ মন্ত্রী সংসদে যে খিস্তি করেছেন তার জুড়ি মেলা ভার। সংসদে ও সংসদের বাইরে সরকারের লোকজন গালাগালি ও খিস্তিখেউড় করলেও চুক্তির বিরুদ্ধে যেসব তথ্য, উপাত্ত ও যুক্তি উত্থাপন করা হচ্ছে তার কোন জবাব কিন্তু সরকার দিচ্ছে না। সরকারের সৎসাহসের এতই অভাব যে সরকার চুক্তিটা পর্যন্ত প্রকাশ করছে না। সুতরাং জনগনের মনে সংশয় উঠা স্বাভাবিক। সত্যি সত্যি যদি জাতীয় স্বার্থের হানি করে কিছু না করা হত তা হলে তো চুক্তি স্বাক্ষরের বহু আগেই তা প্রকাশ করা হত।
এই নিয়ে অনেক আলোচনা হত। অর্থনীতিবিদ বিশষজ্ঞ, পেশাজীবীদের ( প্রফেশনাল) অনেক আলোচনা সমালোচনার সুযোগ ছিল। এ থেকে সরকার সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁচতে পারত। সুতরাং কেউ যদি এখানে মীরজাফরের ছায়া দেখতে পায় তাকে দোষ দেয়া যাবে না।
কি আছে এই চুক্তিতে যে যাতে অর্থনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞরা সবাই এর বিরোধিতা করছেন।
তেল গ্যাস বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি এই নিয়ে হরতাল করেছেন, আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। চুক্তির মূল দিকগুলো দেখলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে:
( ক ) ১৫.৫.৪ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ যদি সমুদ্রের ১৭৫ মাইল দূরের গ্যাস ক্ষেত্র পর্যন্ত প্রয়োজনীয় পরিবহন ব্যবস্থা (পাইপলাইন) স্থাপন করে তাহলেই কেবল বাংলাদেশের পক্ষে পেট্রোবাংলা তার অংশের প্রফিট গ্যাস রাখার অধিকার প্রাপ্ত হবে, তবে তা কোনোমতেই মোট প্রাপ্ত গ্যাসের ২০%-এর বেশি হবে না। উল্লেখ্য, পাইপলাইন তৈরি করতে বাংলাদেশের যে খরচ লাগবে তা কনোকো ফিলিপসের প্রাথমিক বিনিয়োগের তিনগুণ বেশি।
l
( খ ) ১৫.৫.১, ১৫.৫.৪, ১৫.৫.৫, ১৫.৬ ধারায় বর্ণিত শর্তসাপেক্ষে কন্ট্রাক্টর ১৫.৫.২ ধারায় বর্ণিত হিসাব অনুসারে কন্ট্রাক্টর চুক্তিকৃত এলাকায় উৎপাদিত যে কোনো পরিমাণ মার্কেটেবল গ্যাস বাংলাদেশের অংশসহ এলএনজি বা তরলায়িত করে রফতানির অধিকার পাবে।
কনোকো ফিলিপস বাংলাদেশকে গ্যাস কেনার আহবান জানাবে ঠিক, কিন্তু যে দামে গ্যাস রফতানি করতে পারবে তা বাংলাদেশে গ্যাস বিক্রির দামের কমপক্ষে প্রায় তিনগুণ হবে।
এ ক্ষেত্রে গ্যাস রফতানির এ ধরনের লাভজনক প্রস্তাব অনুমোদনে তারা যা দরকার তাই করবে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখাগেছে, জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, মন্ত্রী, উপদেষ্টা তাদের স্বার্থ রক্ষার্থেই নিয়োজিত।
( খ ) ১৬নং ধারায় বলা আছে, পাইপ লাইন নির্মাণ করার ‘অধিকার’ তাদের থাকবে। প্রাকৃতিক গ্যাস কেবল নয়। পেট্রোলিয়ামের বিষয়টিও আছে।
তার মানে তারা ধরে নিচ্ছে একসময় নির্দিষ্ট ব্লকে তেল পাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এটা নেই যে, বাংলাদেশ যে গ্যাস কিনবে সেটা বাংলাদেশকে পৌঁছে দেওয়ার দায়-দায়িত্বটা কোম্পানির থাকবে।
কনোকো ফিলিপস দুর্ঘটনার রাজা হিসেবে এরইমধ্যে কুখ্যাতি অর্জন করেছে। তাদের কর্তৃত্বের মধ্যে বঙ্গোপসাগর এক ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে পড়ল। মাগুড়ছড়া ও টেংরাটিলার অভিজ্ঞতা থেকে এটা নিশ্চিত যে, যেভাবে সরকার চলছে তাতে যতই ধ্বংসযজ্ঞ হোক তার ক্ষতিপূরণের কোনো সম্ভাবনা নেই।
এই চুক্তির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে সীমানা নিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের দাবি একভাবে মেনে নেওয়া হলো। আর বাংলাদেশের অংশ তুলে দেওয়া হলো মার্কিন কোম্পানির হাতে।
বর্তমানে বাংলাদেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের তীব্র সংকট বিদ্যমান। এই সংকটের ফলে উত্পাদনশীল খাতে চরম অস্থিরতা বিরাজমান। শিল্পখাতে সংকট, কৃষিখাতে সংকট।
এর ফলে উত্পাদন খরচ বাড়চে প্রচুর। উত্পাদন বন্ধ করে রাখতে হচ্ছে অনেক সময়ই। ফলাফল দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, দারিদ্র্য বৃদ্ধি। বেকারত্ব বাড়ছে, বাড়ছে গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমান। কিন্তু আমাদের কর্তারা ( তা তারা এ দল ও দল যেই হোন না কেন ) কখনোই দেশের সম্পদের সুরক্ষার ব্যপারে সচেষ্ট ছিলেন না।
সব সময়ই দেখা গেছে বিদেশি প্রভুদের খুশি করার অশুভ প্রবণতা। সরকার পরিবর্তন হয়, কিন্তু জাতীয় স্বার্থবিরোধী নীতি ও চুক্তির ক্ষেত্রে তাদের কোনো পার্থক্য দেখা যায় না। কনোকো ফিলিপসের সঙ্গে চুক্তি এই অপতৎপরতারই অংশ।
গ্যাস রপ্তানী কেন বিপদজনক
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে আমাদের গ্যাস রিজার্ভ আছে ৭.৩ টিসিএফ, সম্প্রতি আরো ৫ টিসিএফ বেশি সন্ধান পাওয়া গেছে। বর্তমানে প্রতিদিন ঘাটতি ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট, গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে ১০% হারে।
জ্বালানি চাহিদা পূরণ হয় ৭০% গ্যাস থেকে, ২৫% আমদানিকৃত তেল থেকে, ৫% কয়লা এবং জলবিদ্যুৎ থেকে।
অর্থনীতির সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি অনুযায়ী আমাদের গ্যাসের চাহিদা পরিমাপ করলে তা নিম্নরূপ চিত্র পাওয়া যায়:
প্রবৃদ্ধির হার গ্যাস প্রয়োজন (টিসিএফ)
যদি ৩% প্রবৃদ্ধি হয় ৪০-৪৪ টিসিএফ
যদি ৪.৫৫% প্রবৃদ্ধি হয় ৬৪-৬৯ টিসিএফ
যদি ৬% প্রবৃদ্ধি হয় ১০১-১১০ টিসিএফ
যদি ৭% প্রবৃদ্ধি হয় ১৪১-১৫২ টিসিএফ
কয়লাকে যদি গ্যাসের পরিমাপে হিসাব করা হয় তাহলে বাংলাদেশের মোট জ্বালানি ৪৫/৫০ টিসিএফ গ্যাসের সমান হয়। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি শতকরা ৭ ভাগ ধরলে ঘাটতি থাকে প্রায় ১০০ টিসিএফ। এই গ্যাসের জন্য, যেটা বর্তমান মজুদের প্রায় ১০ গুণ, আমাদের পুরোপুরি এই বঙ্গোপসাগরের ওপর নির্ভর করতে হবে। সুতরাং, এই গ্যাস যেহেতু আগামী ৫০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য একমাত্র অবলম্বন, সুতরাং যে কোনো ধরনের রফতানিমুখী চুক্তি দেশের জন্য ভয়ঙ্কর রকমের ঝুঁকিপূর্ণ।
কনোকো ফিলিপস সব সময় চাইবে এই গ্যাস রপ্তানি করতে কারণ এতে তাদে লাভ বেশি কিন্তু আমাদের জন্য তা ভয়ংকর।
‘পিএসসি ২০০৮’-এর অধীনে যে চুক্তি করা হয়েছে তা এখনো গোপন। কিন্তু আগেই বলেছি, এই দলিলের ১৫ ধারার একটা উপধারায় পরিষ্কারভাবে বলা আছে, যে গ্যাস আবিষ্কার বা উত্তোলন করা হবে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে পেট্রোবাংলা তার যে ভাগ পাবে তা কোনোভাবেই ২০%-এর বেশি হবে না। দ্বিতীয়ত, যে বাকি ৮০% সেটাও তারা বাংলাদেশকে কিনতে বলবে। কিন্তু বাংলাদেশ যদি কিনতে চায় তাহলে গ্যাস বঙ্গোপসাগরের ভেতর থেকে, গভীর সমুদ্র থেকে কিভাবে আসবে সেটার কোনো ব্যাখ্যা পিএসসি মডেল ২০০৮-এ নেই।
পরিবহনের ব্যবস্থা, অবকাঠামো তৈরি করা সেটার দায়দায়িত্ব তাদের ওপর রাখা নেই। চুক্তির মধ্যেই আন্তর্জাতিক বহুজাতিক কোম্পানির বাধ্যবাধকতা না থাকার কারণে এটা নিশ্চিত হয়ে যাবে যে, ৮০% শেষ পর্যন্ত রফতানিই হবে। বাকি ২০% গ্যাস শেষ পর্যন্ত পেট্রোবাংলার পক্ষে আনা আরো অসম্ভব হয়ে পড়বে। তখন দেখা যাবে কার্যত শতকরা ১০০ ভাগ গ্যাস বিদেশে রফতানি করাটাই হবে মূল সুর।
এখন যারা বলছে, রফতানি আমরা করব না; তারাই তখন বলতে থাকবে, হিসাব দিতে থাকবে পুরোটা রফতানি করলে কিভাবে কিভাবে লাভ হবে।
কিছু কনসালট্যান্ট তৈরি হবে; তখন তারা বলতে থাকবে রফতানি করা অধিক লাভজনক হবে! তখন আমরা সেমিনার দেখব, ওয়ার্কশপ দেখব, বিভিন্ন মিডিয়ার মধ্যে কথাবার্তা শুনব। তারা বলতে থাকবে, হিসাব দিতে থাকবে রফতানি অধিক লাভজনক উল্লেখ করে। বাংলাদেশের এই সম্পদ যা ভবিষ্যতের জন্য অত্যাবশ্যক তা আর আমাদের হাতে থাকবে না।
শুধু গ্যাস রপ্তানী ছাড়াও আরও কিছু ভয়ংকর ব্যপার এর সাথে জড়িত আছে যেমন: দূর্ঘটনা, জাতীয় নিরপত্তা প্রভৃতি। বড় হয়ে যাওয়ার আশংকায় সেসব বিষয় পরে আলোচনা করব এই আশা রাখি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।