যুদ্ধের দামামা বাজাতে অনেক দেশই হাঁকডাক দিয়ে এমন সব অদ্ভুতুড়ে-ভয়ানক যুদ্ধবিমান তৈরির ঘোষণা দিয়েছিলো যা সত্যিই কৌতুহল এবং ভয়ের শিহরণ জাগায়। তবে, এদের কোনোটি আকাশে উড়েছে আবার কোনোটি আলোর মুখও দেখেনি। পরীক্ষায় সবচেয়ে ভালো ছাত্রটি ফেল করলে যে দশা হয় এই যুদ্ধবিমানগুলোরও যেন ঠিক সেই দশা। ডাকসাইটে যেসব যুদ্ধবিমান পরীক্ষাপর্ব পেরোতেই পারেনি তাদের নিয়েই এবারের মেইনবোর্ড।
সামরিক সরঞ্জামাদি একটি জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর সঙ্গে দেশটির প্রতিরক্ষার বিষয় জড়িত।
তাই এক্ষেত্রে বাজেট ধরা হয় বেশি। তেমনি এই উচ্চাভিলাষী যুদ্ধবিমানগুলোর ক্ষেত্রেও ঢালা হয়েছিলো কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ। আর এগুলো তৈরির পেছনে স্বপ্ন-স্পর্দ্ধা ছিলো বেশি। কিন্তু সব আশার বেলুন ফুটে গিয়ে শেষতক শ্বেতহস্তিই হয়ে গেছে এই যুদ্ধবিমানগুলো। বানানোর পর আর কখনই আলোর মুখ দেখতে পায়নি উচ্চাকাংখী এমন ১০টি এয়ারক্রাফটের কথাই থাকছে এবারের মেইনবোর্ডে।
এইচকে-ওয়ান হারকিউলিস (দ্য স্পার্স গুজ)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হেনরি জে কাইজার নামের এক জাহাজ নির্মাতার পরামর্শে যুক্তরাষ্ট্র সরকার এইচকে-ওয়ান হারকিউলিস তৈরির প্রকল্প হাতে নেয়। পরে ১৯৪৭ সালে আমেরিকান সেনাবাহিনীর হাওয়ার্ডস হাগজ স্পার্স গুজ নামের প্লেনটি তৈরিতে আরও অনেকের সঙ্গে কাজ করেন। চার লাখ পাউন্ড ওজনের কাঠের তৈরি এই বিমানের ডানার দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৩২০ ফুট যা প্রায় একটা ফুটবল মাঠের সমান। যুদ্ধের সময় কমদামী উপাদান ব্যবহার করে অধিক সংখ্যায় সৈন্য আর মালামাল পরিবহনের উপযোগী বিমান তৈরির জন্য এই এয়ারক্রাফট তৈরির প্রস্তাব করা হয়েছিল। আট ইঞ্জিনের এই যুদ্ধবিমানটি তৈরি করতে সেসময় মার্কিন সরকারের দুইশো বিশ লাখ এবং হাগজের এক কোটি আট লাখ ডলার খরচ হয়।
এই বিমানে করে সম্পূর্ণ যুদ্ধ সাজে সজ্জিত ৭৫০ জন সৈন্য এবং একটি এম ফোর সারম্যান ট্যাঙ্ক পরিবহন করাই ছিল হাগস-এর মূল পরিকল্পনা। আর এই বিচারে এ ধরনের কাজে ব্যবহারের জন্য সেই সময় এইচকে-ওয়ানই ছিল সবচেয়ে বড় যুদ্ধ বিমান। কিন্তু এতো টাকা-কড়ি, বুদ্ধি আর সময় ব্যয় করে বানানো এই বিমানটির কেবল একবারই প্রায় ৩৩ ফুটের মতন উচ্চতায় মাইলখানেক দূরত্ব পাড়ি দেবার সৌভাগ্য হয়ে ছিল।
এইচ জেড-ওয়ান এ্যারোসাইকেল
পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে এই বিমানটি আমেরিকার সেনাবাহিনীতে বাতাসের মোটর সাইকেল নামে পরিচিত ছিল। একজন পাইলট বহনে সক্ষম এই বিমানের ইঞ্জিন একটি গোলাকার প্ল্যাটফর্মের ওপরে বসানো।
আর এর ওপর পনেরো ফুট দৈর্ঘ্যের ঘূর্ণায়মান দু’টি প্রপেলারই ছিল এর বিশেষত্ব। এটি চালানোর জন্য প্ল্যাটফর্মের ওপরে স্টিয়ারিং কলামের পেছনে সামান্য একটু জায়গা রয়েছে। এটি দাঁড়িয়ে চালাতে হয়। কেবল পর্যবেক্ষণ মিশনে ব্যবহারের জন্য এই ব্যবস্থা করা। বানানোর সময় এমন ধারণা করা হয়েছিল যে, এই বিমান চালানোর জন্য খুব কম অভিজ্ঞতার দরকার হবে।
কিন্তু পরীক্ষার সময় পর পর দু’জন পাইলটের পতনের কারণে এটা প্রমাণ হয় যে, ব্যাপক অভিজ্ঞতা ছাড়া এ্যারোসাইকেল পরিচালনা খুবই কঠিন।
এক্স-থার্টি ভার্টিজেট
এই বিমান তৈরি করাটা ছিল অনেকটা বাজি ধরার মতোই একটা কাজ। যুক্তরাষ্ট্রের রায়ান কোম্পানি দেখতে চাইছিলো রকেটের মতো নিক্ষেপ করা যায় এমন একটি বিমান তারা বানাতে পারে কিনা। আর মার্কিন নেভি এর সঙ্গে জুড়ে দেয় সাবমেরিন থেকে এটিকে ছোঁড়ার ধারণা। বিমানটির নাকের নিচের দিকে একটা হুক ছিল।
এর সাহায্যে ভার্টিজেটকে খাড়া একটি জায়গায় ল্যান্ডিং প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হতো। এই অবস্থা থেকেই এটি আকাশে স্বাভাবিকভাবে উড়ে আবার খাড়া অবস্থায় নেমে আসতে পারতো। ১৯৫৭ সালে বিমানটিকে চূড়ান্তভাবে পরীক্ষা করে দেখা হয়। কিন্তু প্রয়োজন না পড়ায় এ ধরনের কোনো বিমান পরবর্তীতে আর তৈরি করা হয়নি। সোজা কথায় বলতে গেলে যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর এ ধরনের বিমানের আর দরকারই হয়নি।
এক্স-১২০ প্যাকপ্লেন
সহজে মালামাল নামানোর জন্য ফেয়ারচাইল্ড নামের একটি প্রতিষ্ঠান কার্গো পড ওয়ালা পরিবহন বিমান বানায়। বিমানের কাঠামোর নিচে এই পড লাগানো ছিল, আর এতে করে খুব দ্রুত মালামাল ওঠানো নামানো সম্ভব হয়। পুরাতন পড সরিয়ে নতুন অন্য আরেকটি পড নিয়ে বিমানটি খুব কম সময়ের ব্যবধানে আবারো আকাশে পাড়ি দিতে পারে। প্যাকপ্লেনের ওপরের অংশে সমতল মেঝে থাকায় এটি কার্গো হোল্ড ছাড়াই আকাশে উড়তে সক্ষম ছিল। প্রতিষ্ঠানটি কেবল একটি বিমানই তৈরি করেছিল।
গতানুগতিক কার্গো পরিবহনের অংশ না থাকায় এই ধরনের বিমান ব্যবহারের জন্য কাউকে রাজিও করানো যায়নি।
এক্সএফ-৮৫ গবলিন
ভিডিও গেমে সচরাচর যে ধরনের বিমান দেখা যায় তার সঙ্গে এই গবলিনের যথেষ্ট মিল রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় বিমানের ভেতরে বিমান জুড়ে দিয়ে এই ধরনের বিমান বানাবার কথা চিন্তা করা হয়েছিল। সেই সময় এই গবলিনের ছদ্ম নাম দেওয়া হয় ‘ফ্লাইং এগ’। যার মানে দাঁড়ায় এই বিমান পরজীবী যোদ্ধা হিসেবে প্রতিরোধে অংশ নিবে।
শত্রুর যুদ্ধবিমানগুলোর মোকাবেলা করতে এগুলো মাদার শিপ এর বোমা রাখার অংশ থেকে আকাশে বেরিয়ে আসবে। আর মাদারশিপ হিসেবে ব্যবহৃত হবে পিসমেকার বি-৩৬। বি-৩৬ এর বে এর সঙ্গে সেঁটে থাকতে হবে বলে এর আকার আকৃতি নিয়ে প্রথম থেকেই অনেক সমস্যা ছিল। এই কারণে এর দৈর্ঘ্য ১৬ এবং প্রস্থ ৫ ফুটে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। আর ডানাগুলোকে দু’দিক থেকেই ভাঁজ করার উপযোগী করে বানানো হয়।
গবলিন পরবর্তীতে না বানানোর পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। ছোট এই বিমানগুলোর সঙ্গে গতানুগতিক যুদ্ধবিমানের তেমন কোনো মিল ছিল না। ধীর গতির এই বিমান ছিলো হালকা অস্ত্রে সজ্জিত। আর আকাশপথে জ্বালানি সরবরাহের জেটবিমানগুলোর উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বোমারু বিমানগুলোও পূর্ণাঙ্গ মিশনে যেতে সক্ষম হয়। সেইসঙ্গে ফুরিয়ে যায় এর প্রয়োজনীয়তাও।
কনভেয়ার এক্সএফওয়াই পোগো
কনভেয়ার এক্সএফওয়াই পোগো দেখতে অনেকটা এক্স-১৩ ভার্টিজেট ও এক্সএফ-৮৫ গবলিনের মতো। পোগো’র রয়েছে ত্রিভুজের মতো করে সাজানো ৩টি পাখা। সেইসঙ্গে রয়েছে ঘূর্ণায়মান ৩টি ব্লেডের মতো প্রপেলার। খাড়াভাবে আকাশে ওড়া এবং মাটিতে অবতরণ পরীক্ষার জন্য এই ধরনের এয়ারক্রাফট বানানো হয়। লেজের ওপর ভর দিয়ে উড্ডয়ন এবং অবতরণের কারণে এর নাম দেওয়া হয় টেইলসিটার।
এর নির্মাতারা বিশ্বাস করতেন কেবল এই সুবিধার কারণে ক্ষুদ্র যুদ্ধযান থেকে এদের নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। শেষপর্যন্ত পোগোর নক্সাই আসলে তাকে পরীক্ষাক্ষেত্র পার হতে দেয়নি। কম ওজন এবং স্পয়লার না থাকায়, দ্রুত গতিতে চলার সময় এটি থামতে অক্ষম ছিল। এর অবতরণেও ছিল মারাত্মক সমস্যা। এ সময় যানটিকে সঠিক জায়গায় নামাতে পাইলটকে পেছনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো।
তাই এরোসাইকেলের মত পোগো চালনা করতেও সবচেয়ে অভিজ্ঞ পাইলটদের দরকার ছিল।
এ-১২ এ্যাভেঞ্জার টু
এই তালিকার অন্যসব এয়ারক্রাফটের মাঝে কেবল এ্যাভেঞ্জার টু’কেই ভবিষ্যতের চোখ দিয়ে দেখে তারপর বানানো হয়েছিল। এমন কী আজকের দিনেও এটিকে দেখতে অনেক আধুনিক বলে মনে হয়, যদিও এই ডিজাইন ২০ বছর আগের। আর সবরকমের আবহাওয়ায় উড়তে সক্ষম এই এয়ারক্রাফটটি একাধারে ছিল এয়ার ক্যারিয়ার এবং বোমারু বিমান । সমবাহু ত্রিভুজাকৃতির এই বিমানের ককপিট মাঝামাঝি জায়গাতে অবস্থিত।
ভেতরের অস্ত্র বহনের অংশে বিমানটি স্মার্ট বোমাসহ আকাশ থেকে মাটিতে আঘাত হানার উপযোগী অস্ত্র বহনে সক্ষম। কিন্তু ফ্লাইং ডরিটো ডাক নামের এই এয়ারক্রাফটটি সবশেষে ব্যয়বহুল হিসেবেই প্রমাণিত হয়। সেসময়কার এক হিসেবে দেখা গিয়েছিল, এ-১২ এর পেছনে ৩ বছরে আমেরিকার নৌ-এয়ারক্রাফট বাজেটের ৭০ ভাগই খরচ হয়ে যাবে।
এফটুওয়াই সি ডার্ট
মাঝ আকাশে গিয়ে পাগলামো করলে যে কোন বিমানকেই সেরদে বিক্রি লোহা-লক্কড়ের ভাগ্যকেই বরণ করে নিতে হয়। সি ডার্টের ভাগ্যেও কিন্তু ঠিক তেমনটিই ঘটেছিল।
১৯৪৮ সালে আমেরিকার নৌবাহিনীর সুপারসনিক ইন্টারসেপ্টর এয়ারক্রাফট প্রতিযোগিতায় বিজয়ী এই এফটুওয়াই। সে সময় যুদ্ধজাহাজ থেকে সুপারসনিক এয়ারক্রাফট পরিচালনা নিয়ে ইউএস নেভি খুবই চিন্তিত ছিল। আর এই সময় সি ডার্টকে এর সঠিক সমাধান বলে মনে করা হয়। তার কারণ টেকঅফের সময় এটি টুইন হাইড্রো স্কি এর সহায়তায় আকাশে ওড়ে। শেষবারের ভয়ানক উড্ডয়নে বাদ পড়ার আগে সি ডার্ট শব্দের চেয়ে দ্রুত ভ্রমণে সিপ্লেনের একমাত্র রেকর্ডটি করেছিল।
ডায়না-সোয়ার
নাম শুনেই ধারণা করা যায়, ডায়না-সোয়ার প্লেনটি আকর্ষণীয়ই হবে। ডায়নামিক সোয়ারার বা এক্স-২০ ডায়না-সোয়ার আমেরিকার বিমানবাহিনীর সেনা অভিযানে মহাশুন্যে বিমান ব্যবহার প্রকল্পের একটি অংশ। এই বিমানটি ১৯৫৭ সালে তৈরি করা হয়েছিল। বোমা নিক্ষেপ, শত্রু উপগ্রহ ধ্বংস, নিজস্ব উপগ্রহ রক্ষণাবেক্ষণ, মহাকাশে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা সহ আরও সব জরুরি কাজে ব্যবহার উপযোগী করে এটি নির্মাণ করা হয়। সে সময় অন্যান্য স্পেস প্লেন ছিল স্পেস ক্যাপসুলভিত্তিক।
সে সব বিমান গতি কমানোর জন্য বায়ূমণ্ডলে হেঁচড়ে যাওয়ার ওপর নির্ভরশীল ছিল। অন্যদিকে ডায়না-সোয়ার সেসব স্পেস সাটলের মতো, যেগুলো পাইলটের নির্দেশমতোই পৃথিবীতে নেমে আসে। তবে এই ডায়না-সোয়ারও কিন্তু টেস্ট প্লেনের গণ্ডি পেরোতে পারে নি। তার কারণ একে নিয়ে মার্কিন বিমানবাহিনীর নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা ছিল না। অন্যদিকে এর নির্মাতারাও নিশ্চিত ছিলেন না এর বুস্টারগুলো আদৌ এটিকে মহাশুন্য পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবে কী না।
হর্টেন হো ২২৯ (হর্টেন ব্রাদার্স ফ্লায়িং উইংস)
বিমান নক্সায় কোনোরকম প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই জার্মানির হর্টেন ব্রাদার্স জেট ইঞ্জিনে চলা প্রথম ডানাওয়ালা বিমান প্রস্তত করেন। গ্লাইডারের মতো স্থায়ী ডানার এই ধরনের এয়ারক্রাফটের কোনো লেজ নেই। এদের নির্দিষ্ট কোনো কাঠামোরও দরকার হয় না। ডানার মূল অংশের মাঝে বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি এবং ক্রুর জায়গা করে দেয়া হয়। স্টিলথ প্রযুক্তির যুক্ত করার দিক দিয়েও হর্টেন হো ২২৯ ছিল প্রথম এয়ারক্রাফট।
গঠনশৈলীর কারণেই রাডারের সাহায্যে একে চিহ্নিত করা ছিল কষ্টকর। আসল হর্টেন হো’র মাঝে একটি ওয়েল্ডিং করা স্টিলের পড রয়েছে। এতে আছে টব আর পাখা। আর এর ডানাগুলো তৈরি হয়েছে কয়লা, কাঠের গুড়ার তৈরি কার্বন মিশ্রিত প্লাই উডের প্যানেল দিয়ে। যুদ্ধ শেষে এই ধরনের মান্ধাতার আমলের বিমানের আর কোনো দরকারই রইলো না।
তাই আলোর মুখও দেখতে পারলো না হর্টেন হো। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।