আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হলদে পাতারা

মিশকালো সিরিঙ্গে চেহারার কালীমোহন বুড়োকে দেখলেই আমার মেছো ভুতের কথা মনে হত। তখন সদ্য সদ্য নিজেই বানান করে গল্পের বই পড়তে শিখে গেছি। ছবিওলা বাংলার ভূতের গল্প মুখস্ত প্রায়। কালী বুড়ো আমাদের জমি দেখা শোনা করার প্রাচীন কামলা। ময়লাটে হেটো ধূতি আর হাতে একটা নারকেলি হুঁকো - এইই হল তার সারাবছরের ভূষণ।

খুব শীতে বড়জোর একটা মার্কিন কাপড়ের টুকরো চাদরের মত গায়ের ওপর ফেলে রাখত । গ্রামের মাটির বাড়িটার বাহিরের চওড়া দাওয়াটার ওপর কুঁজো হয়ে বসে হুঁকো টানত টরর্‌ টরর্‌ । এক একদিন আমাদের ফাঁদ বানিয়ে দিত ডাহুক ধরবার, নয়ত মাছের চারের কেঁচো খুঁড়ে দিত গোবর ধাবি থেকে। একদিন দেখি বিন আগুনেই হুঁকো টেনে সারা। মুখটায় অনেক চিন্তার ভাঁজ।

জিজ্ঞেস করাতে বললে, মায়ের অসুখ, নাকি তুলসি নিয়েছে কদিন হল । তখনও তুলসি নেয়া জিনিষটা জানতাম না। কাজেই ছুটে গেলাম কালিদার বাড়ি। বয়েসে প্রাচীন হলেও মার মুখে শুনে আমিও ঐ কালিদাই ডাকতাম। ঐ বাড়িতে গিয়ে সেদিন খুব অদ্ভুত একটা ব্যপার দেখলাম।

ওনার মুমূর্ষু মাকে উঠোনের তুলসি তলায় শুইয়ে রাখা হয়েছে । চেতন অচেতনের মাঝখানে বৃদ্ধা একটা চাটাইয়ে শুয়ে, মল-মূত্র-বমিতে মাখামাখি । গায়ের নগন্য কাপড়ের টুকরোটি আব্রু বজায় রাখার প্রানপন চেষ্টায় ব্যর্থই হচ্ছে কেবল । উঠানের চারদিকে বাচ্চারা কাইমাই চিল্লা চিল্লি করে খেলছে, বাড়ির বাকি সদস্যরা যার যার কাজে ব্যস্ত । বৃদ্ধা মাঝে মাঝে ক্ষীণ স্বরে কাতরে উঠছে, বউ, অ বউ...।

বউটি তখন ঝামটা মেরে এসে মুখে একটু পানি দিয়ে যাচ্ছে । পুরো ব্যাপারটার মাঝে কেমন যেন অদ্ভুত একটা স্বাভাবিক কাঠিন্য, যেন এইরকম হওয়ারই কথা, কিন্তু আমার ছোট মানব মস্তিস্ক দৃশ্যটা নিতে পারলনা । কাউকে কিছু না বলেই চলে এলাম। দিন কয়েক পর ওখানেই বৃদ্ধা মারা গেলেন। সবাই বলল, উহ্‌, শান্তি পেলেন।

আমারও তাই মনে হল। পড়শিরা ফিসফিস করে বলতে লাগল, অচ্ছুতের ভয়ে মাকে ঘরের খাটে রাখেনি, কাপড়ও দেয়নি, নইলে বুড়ি মরলে পরে সব ফেলে দিতে হত যে ! একদিন খবর পেলাম কালী বুড়ো তুলসি নিয়েছে । মনে পড়ে গেল সেই তুলসিতলার দৃশ্য । দেখা করতে যাওয়ার ইচ্ছা উবে গেল । বছর তিনেক আগের কথা, কি একটা ছুটিতে মা'র ওখানে গিয়েছি।

গরমের এক বেলা পড়ে যাওয়া দুপুরে শুনলাম ক্লান্ত প্রলম্বিত ভাঙ্গাগলায় কে ডাকছে, কচু শাক নিইইবেএএন্‌ ? বেরিয়ে দেখি উঠোনের দরজাটার সামনে এক ভাঙ্গাচোরা বৃদ্ধ মূর্তি কয়েক আঁটি মৃত কচুশাক বিক্রির আশায় দাঁড়িয়ে কম্পমান। জিজ্ঞেস করে জানলাম ছেলেমেয়েরা সব বুড়ো বুড়িকে ফেলে চলে গেছে নিজের জীবনে। আগের দিন থেকে ঐ দুপুর পর্যন্ত উপোষ থেকে শেষতক তাই পেটের দায়ে কচুশাক বিক্রির অপচেষ্টা। ভাত বেড়ে খেতে দিয়ে দেখি প্রচণ্ড ক্ষুধায় এত দুর্বল যে খাবারগুলো চিবিয়ে গিলতেও কষ্ট পাচ্ছে। দুচোখ বিস্ফোরিত করে এত প্রানান্ত চেষ্টায় ভাত খেতে আজতক আমি কাউকে দেখিনি ।

শুনলাম, নাকি গরিবের ঘরে এমনই হয় । সেবারই দেখলাম পড়শির বাসায় ভয়ানক মারপিট শুরু হয়েছে। বাংলার ঘরে ঘরে পরিচিত বিষয় - জমি নিয়ে কোন্দল। এখানে বাদী বিবাদী কিন্তু ভাই ভাই নয়, বরং বাবা বনাম পুত্রেরা। ভদ্রলোক নিজের বিষয় আশয় সবই ছেলেদের নামে লিখে দিয়েছেন।

ছেলেরা তার দখল নেবার জন্য এখন নিত্য বাপ মাকে পেটায় । এবার পড়শিরা তাদের কীর্তিকলাপ নিয়ে রসালো গল্পই করলেন শুধু, কারণ দর্শালেন না । কদিন আগে খবর পেলাম পরিচিত এক ভদ্রলোকের মা মারা গিয়েছেন । শুনে বড় শান্তি পেলাম । মৃত্যু মাঝে মাঝেই অনেক স্বস্তিকর, বিশেষত যখন অর্থবান কোন পরিবারের জননী শয্যাশায়ী থাকেন দীর্ঘদিন এবং তাঁর দেখভালে বিরক্ত সদস্যরা বাথরুমেই তাঁর শয্যা পেতে রাখেন, মল মূত্র বারবার ধোয়া ধুয়ি ইত্যাদির ভয়ে ।

এবার চেনা জানা সবাই কদিন ফিস ফাস করেই ক্ষান্ত দিলেন । অনেককেই বলতে শুনেছি ইউরোপ আমেরিকায় যারা থাকে তারা বাবা মার সম্মান-আদর জানেনা, তারা আমাদের দেশে এসে দেখুক এই দিক দিয়ে আমরা কত উন্নত । আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলে, বাবা মার সম্মান বা যত্নে কার্পণ্য দেখাতে আমরাও কম যাই না। এই জিনিষটা বিশ বছর আগেও ছিল, এখনও আছে এবং ধর্ম- বর্ণ অর্থনৈতিক অবস্থা নির্বিশেষেই আছে । রোজ দিন চারপাশে কত ভালো ভালো কথা শুনি, মানবতার নামে কতরকম উঁচু উঁচু কথা, যার বেশির ভাগ মাথায় ঢোকেই না, অথচ প্রতিনিয়ত তার উলটো ছবিটাই চারপাশে চোখে পড়ে ।

এক একসময় বোকা বিবেক জিজ্ঞেস করে বসে, এটাই কি জগতের স্বাভাবিক নিয়ম ? তাহলে মানতে পারিনা কেন ? তখন গত শীতে দেখা শীতবস্ত্রহীন সন্তান পরিত্যক্তা সেই বৃদ্ধার কথা মনে পড়ে যায়, যে বলেছিল, কষ্টের কাথালা (কথাগুলো) জিজ্ঞাস করিস না মা, বুক ফাটিই যাইবে ! সত্যিই তো, এইসব হলদে পাতারা তাদের রঙ হারানোর গল্প কাদের কাছে করবে ? ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।