অদ্ভুত উটের পিঠে বরংবার কাল্পনিক নায়ক নায়িকার সুখ-দুঃখের কথা লিখে ব্যর্থ হয়ে লিখছিলাম নিজেরই ব্যর্থ জীবনের মর্মান্তিক কাহিনী। এমন মর্মস্পর্শী ভাষায় যে আমারই চোখ পানিতে ভেসে যাচ্ছিল। ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল চারদিক। হঠাৎ দেখি এক অশ্রুমন্ডিত এক বুড় আমার সামনে দাঁড়িয়ে। চমকে চোখ কচলে দেখি আমার সামনে স্বয়ং কবিগুরু।
আমি কাঁদবো না হাসবো... চিল্লে হোস্টেলের সবাইকে ডাকবো নাকি চুপ করে থাকবো?
সসংকোচে অপ্রতিভ স্বরে বললাম, 'সালাম, নমস্কার আদাব!' এক সাথে তিনটা সম্ভাষণ শুনে তার মুখে মোনালিসার মতো দুর্বোধ্য হাসি।
ঢোক গিলে বলি-'কবিগুরু, আপনি?'
কথাটা শেষ করার মাঝপথেই তিনি হাত তুললেন,
-আমি কি আসতে পারি না!
-না মানে... আমার মত এক... ব্যর্থ লেখকের কাছে...
আমি বিস্ময়ে এমন ভড়কে যাই যে ওই দুটি শব্দ ছাড়া আর বাকস্ফূর্তিই হল না। যে আমি শত চেষ্টাতেও লেখক হতে পারিনি সেই আমাকে কি না-ওঃ অভাবিত সৌভাগ্যে আমি মুহ্যমান হয়ে পড়ি। আমার হতভম্ব রূপ দেখে তাঁর দয়া হয়। মুখের হাসিটি আর এক ইঞ্চি বাড়িয়ে বললেন, -'ওরে তুঁই কেন ব্যর্থ হবি।
'
পুলকে আমার শরীর কেঁপে উঠল।
-'তোর খুব দুঃখ তাই না?'
-'জ্বী, আজ্ঞে। ' বলেই জিভ কাটি আমি।
- 'কিছু নয়। কিসের দুঃখ কিসের ক্লেশ, এত পরিশ্রমের ফল না পাওয়ায় ক্লান্ত-হতাশাগ্রস্ত।
' আমার ডায়লগ শুনে আমি নিজেই অভিভূত। এ ডায়লগ সিনেমার স্ক্রিপে দিতে পারল তো লোকের মুখেমুখে ঘুরবে।
-'ভাবিস না। তোর পরিশ্রম বিফলে যাবে না। '
আমি গদগদ স্বরে বললাম- 'আপনি দাঁড়িয়ে কেন? বসুন।
বসুন। '
-'নারে। বসব না, তাড়া আছে। আরও কয়েকজনের কাছে যেতে হবে। '
এই শুনে আমি দুঃচিন্তায় পড়ে গেলাম।
আরও অনেক যদি পাইপ লাইনে থাকে তা হলে তো ঘোর কম্পিটিশন। আমার ভয়ার্ত মুখ দেখে তিনি আশস্ত করলেন হাত তুলেন।
'ভয় নেইরে। প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা প্রেসক্রিপশন আছে। '
ভারি আনন্দ হল শুনে।
বললাম- 'তাহলে বলুন কি করব আমি। '
-'বলছি। তার আগে এক গেলাস পানি খাওয়া তো। এত সবার সঙ্গে বকে বকে গলা শুকিয়ে গেছে। '
আমি হন্তদন্ত হয়ে পানি নিয়ে এলাম।
হিমেস রেসামমিয়া কর্ডলেস মাইক যেভাবে মুখের সামনে ধরেন, উনি সে ভঙিতে বোতলটি ধরে ঢকঢক করে পানি খেয়ে বললেন,
-'তুই এতদিন কী কী লিখেছিস?'
তালিকা দিলাম। বেশ দীর্ঘই বলা যায়। আড়াই হাজার ছড়া, দেড় হাজার কবিতা, বারো ডজন উপন্যাস, পাঁচশ' গল্প, দশ হালি নাটক বলে হাঁফ ছাড়লাম। গম্ভীর মুখে বললেন,
-'হুঁ! তা এগুলো ছাপা হয়েছে?'
-'কে ছাপাবে। প্রকাশকরা আমার জন্য ১৪৪ ধরা জারি করেছে বাংলাবাজারে।
বেনামেও পাণ্ডুলিপি পাঠিয়েছি, কাজে দেয়নি। অনেকে নিজের টাকায় ছাপান বটে কিন্তু আমার তো টাকাও নেই। টিউশনি আর বাবার পাঠানো সামান্য টাকায় কি বই ছাপানো যায়?
-'হুঁম! তুই বরং এক কাজ কর। ' কবিগুরুর মুখে এবার বিটিভির উপস্থাপকদের মত প্রসন্ন হাসি দেখা দেয়। বিশদে যান তিনি, -'তুই রিমেক কর।
'
-'রিমেক! সে তো গানে হয়। '
-'সবেই হয়। সিনেমাতেও হয়। দেবদাস দেখিসনি? কতবার যে রিমেক হল শতৎও বলতে পারবে না। '
-'তা তো,' আমি ঘাড় নাড়ি।
'কিন্তু সাহিত্যে কী তা সম্ভব?'
-'সম্ভব। সবই সম্ভব এই পৃথিবীতে। সাহিত্য তো রিমেক চলছেরে। সেই প্রেম সেই বিরহ, সেই পরকীয়া, সেই ক্ষোভ, হতাশা, প্রতিশোধ... দফায় দফায় একই ঘুরে ফিরে!
-'তা ঠিক। ' আমি মাথা নাড়ি।
-তবে সেই ক্ষমতা তোর নেই। তুই সরাসরি রিমেক কর।
-সরাসরি রিমেক?
সরি- বলে আমি সরতে চাই। কারণ কবিগুরুর বয়স এখন ১৫০ বছর। স্বর্গে থেকে মর্তের খবর কেমনে জানবে, কপিরাইটের ধরা খেলে কোর্টের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে জীবন যাবে।
আবার কোন রবীন্দ্র ভক্ত র্যাবের ক্রসফায়ার ডিপার্টমেন্টে থাকলে ক্রসফায়ারের শঙ্কা আছে। আর ২ বাংলার বুদ্ধিজীবী আর মিডিয় তো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে।
-এর জন্য তোর কিছু হল না। সহজে পিছিয়ে যাস, পেছাতে পেছাতে কোথায় এসেছিস দেখেছিস? শোন-
একটু ভেবে নিয়ে কবিগুরু ফের বলেন,- 'তুই অতীতের বিখ্যাত লেখকদের লেখা রিমেক কর। ' হুবহু এই শুনে আমার হৃদকম্পন হয়।
জ্ঞান হারাবার পূর্বমুহূর্ত এগিয়ে আসছে মনে হয়।
-এ বছর তো আমার দেড়শোতম জন্মদিন হচ্ছে। তুইও সেই আয়োজনে অংশ নে। এ সুযোগে কিছু করেনে।
-সেটা কী ভাবে?
'সুযোগের' কথাতে আমার হৃৎপিণ্ডে ফের কাঁপন লাগে।
তুই আমার 'নৌকাডুবি' উপন্যাসটাই রিমেক কর। ডুবিয়ে দে সাহিত্যের সোনার তরী।
-কিন্তু সেটা করলে লোকে যে ঠ্যাঙাবে। বলবে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনটায়-
-বলুক। তুইও তো আমার মতো বলবি, " তোমারা যা বলো তা বোল আমার লাগে না মনে।
" বুঝলি কিছু।
-বুঝেছি।
-না, সবটা বুঝিসনি। নামটা 'নৌকাডুবি'-ই রাখিস। তবে এখনকার রেওয়াজ অনুযায়ী পাশে একটা ইংরেজি জুড়ে দিস।
'নৌকাডুবি'-রিটার্ন বা এ স্টোরি আফ এ ম্যাসাকার ডিজাস্টার' এ জাতীয় কিছু বুঝলি?
-বুঝেছি। কিন্তু লেখাটা?
-লেখাটা একটু সহজ করে দিবি। সহজপাঠ্য যাকে বরে।
পাঠদান শেষ করেন কবিগুরু। আমার ভয় তবু শেষ হয় না।
-ধরুন, এরকম করলে যদি-
-যদি তুই করতে পারিস!
তিনি যদির কথা নদীর পানিতে ফেলতে দেন না।
-তোর সিদ্ধিলাভ ঠেকায় কে! লেখক হিসাবে তুই একটা নজির রাখবি। নতুন পথ দেখাবি। পথিকৃৎ হবি তুই!
-সত্যি বলছেন?
আমি সন্দেহী প্রশ্ন করি। কবিগুরুর কপালেও ঘাম দেখা দেয়।
বোধয় এমন একটি বৈপ্লবিক পরামর্শ পাচার করার কারণে না আমার প্রতি বিরক্ত হয়ে, বোঝা গেল না।
-আমি যাই এবার। মালমসলা দিয়ে গেলাম,
রুমাল দিয়ে ঘাম মুছে অবশেষে তিনি বললেন,
-এবার তুইও এগিয়ে যা। কান্নাকাটি না করে রান্না চাপা সেটা খাওয়া সবাইকে। পাবলিককে খাওয়াতে পারলেই তোর টাকা আর টাকা, খ্যাতি, সম্মান আর পুরস্কার ।
আমার পর শরৎচন্দ্র ধরবি, তারপর বাংলা সাহিত্যের 'বিমাতা' মানে বিভূতিভূষণের বি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা এবং তারাশংকরের তা-এদের ধরবি। ধর্তব্যের মধ্যে রাখবি বিখ্যাতদের। তরুণ লেখকদের ধারের কাছেও যাবি না। ধার করবি না তাদের কাছে থেকে। 'নৌকাডুবির' পর 'পল্লীসমাজ'-এ যা, সেখান থেকে 'আরোগ্য নিকেতন'-এ।
তারপর 'পদ্মানদীর মাঝি'-দের কাছে এবং শেষে 'পথের পাঁচালি' দিয়ে আপাতত এই চালিয়াতিটা শেষ কর। তোর জয় হোক।
বলতে না বলতেই উধাও কবিগুরু। আমি অকূলে পড়লাম। কুলকুল করে ঘামতে থাকি।
বোতলের দিকে হাত বাড়াই। সামান্য পানি আর অবশিষ্ট আছে। এতে কী আর তেষ্টা মিটবে? আদৌ কী নৌকাডুবি হবে? চারিদিকে রিমেকই চলছে ঠিকই কিন্তু এই রি-মেক সাহিত্য কী নৌকার বদলে আমাকেই ডোবাবে না? ভয়ে ভাবনায় হাত থেকে বোতল খসে পড়ল। ঠকাস করে জোর শব্দ উঠল। আর তাতেই চটকা ভাঙল।
এঃ, একেবারে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম যে লিখতে লিখতে। তাহরে এটা স্বপ্ন! তাহলে ! তিনি কী দেখা দেননি? নৌকাডুবির বদলে আমারই কী ভরাডুবি হবে এবার!
(বিদেশী গল্প অবলম্বনে) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।