আমি পেশায় শিক্ষক। পরিমল জয়ধর ঢাকার একটি নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ভিকারুননিসা নুন স্কুল এন্ড কলেজ’- এর শিক্ষক। আমার মতো এই পরিমলও শিক্ষকদের কাছে পাঠ নিয়েই শিক্ষকতা পেশায় এসেছে। তবে পরিমল তার এক ছাত্রীর উপর যে পাশবিকতা চালিয়ে ধরা পড়ে গেলো, তাতে সে তার শিক্ষকদের কাছ থেকে সঠিক শিক্ষা পায়নি; এটাই প্রমাণ হয়েছে। আমি শিক্ষকদের কথা বলছি, শিক্ষিকাদের নয়।
কারণ পরিমলের মতো কাণ্ড শিক্ষকরাই করেন। পরিস্কার করে বললে, বলতে হয়; এমন কর্ম করে পুরুষেরা। আবার সকল পুরুষেরা নয়। কেবল পরিমলের মতো শিক্ষা গ্রহণকারী পুরুষেরা। এ লজ্জা আমরা কি দিয়ে ঢাকবো।
পরিমলের ঘটনা নতুন নয়। অতীতে বাসা-বাড়িতে ছেলে মেয়েদের পড়ানোর জন্য লজিং মাষ্টার রাখা হতো। এখনো রাখা হয়। লজিং মাষ্টারের সাথে কতো মেয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। পরিমলের মতো কাণ্ড করে যখন অঘটন ঘটে গেছে তখন গৃহকর্তা সেই লজিং মাষ্টারের কাছে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ইজ্জত রক্ষা করেছেন।
লজিং মাস্টারের প্রেম-কাহিনী নিয়ে বাংলা সাহিত্যে শত শত গল্প উপন্যাস রয়েছে।
প্রেম ভালোবাসাকে আমি অশ্রদ্ধা করি না। পরিমলের বিষয়টিও প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্কের ভিতরে হলে কেউ কোনো কথা বলত না। তার এই বিকৃত রুচির কর্ম আলোচনায় আসতো না। পাশবিকতার শিকার আমার সন্তানতূল্য ঐ মেয়েটি যদি নিরবে হজম করে যেতো; তা হলেও পরিমলের বিষয় এদেশবাসী জানতে পারতো না।
কিন্তু না। মেয়েটির কল্পনায়ই ছিলো না তার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক যে এমন বিকৃত রুচির হতে পারেন। তাই মেয়েটি এই পাশবিকতার কথা সহপাঠিদের জানিয়েছে। জানিয়েছে তার মা-বাবাকে। আর এতেই ‘শিকারি পরিমল’ ধরা পরে গেলো।
পরিমলের ঘটনা আবারো আমাকে ভাবাচ্ছে, আমারা কোন দিকে যাচ্ছি? এই দেশেই সর্বোচ্চ একটি বিদ্যাপীঠে ছাত্রনেতারা ধর্ষণের সেঞ্চুরি উৎসব পালন করার খবর আমরা পত্রিকায় পড়েছি। সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষক তার বিপরীত লিঙ্গের সহকর্মীকে যৌন হয়রানী; এমন কি ধর্ষণ করেছেন, এমন খবরও ক’মাস আগে পড়েছি।
আমাদের মূল্যবোধ নৈতিকতার অবস্থা যখন এই; তখন আশার আলো কোথায়? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট। যে শিক্ষক তার ছাত্রছাত্রীর ভিতরে নৈতিকতার যে উপাদানগুলো ঘুমিয়ে থাকে; সেই ঘুমিয়ে থাকা উপাদাগুলো জাগিয়ে তুলবেন।
জাগানোর গুরু দায়িত্ব তো শিক্ষকের। আর সেই শিক্ষকই যদি তার ছাত্রীকে ধর্ষণ করেন কিংবা ছলে-বলে কৌশলে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন, তবে এ লজ্জা শিক্ষক সমাজ কি দিয়ে ঢাকবে? ‘পরিমলের’ মত শিক্ষকরাইতো পুরো শিক্ষক সমাজকে কুলষিত করে দিলো। আমি বড় কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে না থাকলেও, শিক্ষকতাই তো করি। পরিমলের পেশারই একজন। পরিমলের এই পাশবিক কাণ্ড আমাকে কলঙ্কিত করেছে।
কলঙ্কিত করেছে শিক্ষকতা পেশাকে। তার এই কলঙ্কে সমাজ কলঙ্কিত। কলঙ্কিত আজ পুরো জাতি।
প্রিয় পাঠক, পরিমল কী কাণ্ড ঘটিয়েছিলো ? সে কা-টির বর্ণনা হচ্ছে এ রকম; ‘তার কাছে নিয়মিত পড়তে যায় যেসব মেয়ে তাদের মধ্যে একটি মেয়ে সেদিন একটু বিলম্বে গিয়েছিলো। সবাইকে বিদায় দিলেও সেই মেয়েটিকে পড়া দেখিয়ে দেওয়ার কথা বলে বসিয়ে রাখে।
তারপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে মেয়েটিকে কিছু বুঝতে দেওয়া আগেই তার মুখ বেঁধে ফেলে। মেয়েটি হাত-পা ছোড়াছুড়ি শুরু করলে ওড়না দিয়ে তার দুহাত বেঁধে ফেলে। গায়ের জামা-কাপড় খুলে তার ছবি তোলে, তারপর তার পশুবৃত্তি চরিতার্থ করে। মেয়েটিকে ভয় দেখায়, এই ঘটনা কাউকে জানালে ইন্টারনেটে তার ছবি ছেড়ে দেওয়া হবে। ’
মেয়েটি পশুর চেয়েও অধম তার এই শিক্ষকের ভয়কে মুহূর্তেই জয় করে।
সে সকলকে জানায় বিষয়টি। তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ভিকারুননিসা নুন স্কুল এন্ড কলেজ’-এর বসুন্ধরা শাখার প্রধানকে লিখিত ভাবে জানায়। তার পরও পরিমলের ব্যাপারে স্কুল কতৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গড়িমসি করেন। শেষে মেয়েটির অভিভাবকের পক্ষ থেকে থানায় অভিযোগ করা হয়। পুলিশ পরিমলকে গ্রেফতার করে।
পরিমল গ্রেফতার হয়েছে। হয়ত তার শাস্তিও হবে। কিন্তু আমার কথা অন্যখানে। সেটা হচ্ছে; শিক্ষকতা সামাজিক মর্যদা সম্পন্ন একটি পেশা। একজন শিক্ষকের চাইতে বেশি চ্যালেঞ্জ আর কে গ্রহণ করে? অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীকে গড়ে তুলতে যে অপরিসীম জীবনী শক্তি লাগে; তা তো কেবল একজন শিক্ষকেরই থাকে।
সে শিক্ষক কিভাবে পারেন ছাত্রীকে ধর্ষণ করতে? কিভাবে ছাত্রীদের ফাঁদে ফেলে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন? শুধু পরিমলই নয় পরিমলের মত আরো অনেক শিক্ষকই সাম্প্রতিককালে মেয়েদের এভাবেই ভোগ করে আসছে।
আমি ভেবে ভেবে একটি প্রশ্নের উত্তরের কোনো কূলকিনারা পাচ্ছিনা। আমার ভেতরে প্রশ্নটি নানা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করছে। যে শিক্ষকরা নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়ার মহানব্রত নিয়ে শিক্ষকতা পেশায় আসেন তাদের মস্তিস্কেকোষ কি ভাবে সক্রিয় হয় একজন ছাত্রী কিংবা সহকর্মীর সাথে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে। উচ্চতর মূল্যবোধ, মানবিক আচার আর সন্তানতূল্য ছাত্রীদের প্রতি দায়িত্ববোধের কথাগুলো তারা ভুলে যান কি করে? একজন শিক্ষক কিভাবে শরীর সর্বস্ব অনিয়ন্ত্রিত পুরুষে পরিণত হন? এর জন্য কি আমাদের এই ভোগবাদী সমাজ দায়ী?
নিশ্চয়ই দায়ী।
যে সমাজ অপরাধী। যে রাষ্ট্র নীতিহীন। সে সমাজে এমন অবস্থা হওয়াইতো স্বাভাবিক। আমাদের বাঙালি সমাজে আজ ভোগের উপকরণের ছড়াছড়ি। তাই সঙ্গত কারণেই সমাজের মানুষ হয়ে যাচ্ছে ভোগবাদী, বিকৃত রুচি সম্পন্ন।
ভোগের সব উপকরণ যেহেতু হাতের কাছে, তাই সবকিছু পেতে হবে। তা হলেই যেন জীবন পূর্ণ হবে। এটাই এখন আমাদের সমাজের আসল রূপ।
অথচ চাওয়াটাতো নিজের কাছে। সেটা যদি কমিয়ে ফেলা যায়, পাওয়া নিয়ে এত মাথা ঘামাতে হয় না।
আমারতো মনে হয় সমাজ আর রাষ্ট্রের চরিত্র যদি না বদলায় তা হলে আমাদের হাজার বছরে বাঙালী সভ্যতা টিকবে না, টিকতে পারে না।
আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি এ রকম ধর্ষনের শিকার হওয়া ছোট ছোট মেয়েগুলো কি ধরণের মনোকষ্ট নিয়ে বেড়ে উঠে? আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, মানবতা, নৈতিকতা কোথায় এসে ঠেকেছে? আমরা কি একবারও ঐ ধর্ষক নারীলোভী শিক্ষকের স্ত্রী পরিজনের মুখের চিত্রটি কল্পনা করতে পেরেছি? কতটুকু লজ্জা সেই স্ত্রীটি পেলো?
হয়তো এমনও হতে পারে স্ত্রীর সাথে তার এমন কিছু ঘটেছে। যে কারণে সে বিকৃত রুচিসম্পন্ন হয়ে উঠেছে। তাই তার সন্তানতূল্য মেয়েকে ভোগ করে আনন্দ পায়। আমি এক পরিমলের কথা বলছি কেনো? আমাদের সমাজে হাজার হাজার পরিমল আছে।
এই পরিমলরা জানে পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে স্ত্রীদের যে বিকল্প আশ্রয়ের কোনো স্থান নেই। তাই তারা স্ত্রীকে রেখে অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে। এইসব পরিমলদের বোধ শক্তি লোপ পায় বলেই তারা নির্ভেজাল ভালোবাসা পাওয়ার স্থলটি অথাৎ স্ত্রীদের ভালোবাসা নিজেরাই যে কুলষিত করছে।
এই লেখার শেষ অংশে এসে আমি বলতে চাই, সমাজকে বদলাতে না পারলে, রাষ্ট্রের ধ্যান ধারনা পাল্টাতে না পারলে, পরিমলদের সংখ্যা ক্রমে বাড়তেই থাকবে। বাড়তে থাকবে ধর্ষণের মত জঘন্য অপরাধ।
আর এটি ভয়ঙ্কর ব্যাধি হিসাবে দেখা দিবে। এই ব্যাধি থেকে উত্তরণের পথ একটিই। আমাদের মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তুলতে হবে। আর এই উদ্যোগ আসতে হবে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। নতুবা এক সময় আমরা দেখবো আমাদের শেকড়ে টান পড়ছে ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।