কোথাও পাখির শব্দ শুনি; কোনো দিকে সমুদ্রের সুর;
১
“বুঝলিরে নিমাই, টাকা যে কি জিনিস, জীবনের বেবাগ জিনিস কেনা যায় ট্যাকা থাকলে। ট্যাকা থাকলে সুখে থাকবি, বৌ লইয়া শান্তিতে দিন কাটাইবি। তোর ট্যাকা নাই তো তোরে কেউ চিনবই না। ”- নৌকার গুলুই এর উপরে শুয়ে শুয়েই হঠাৎ আক্কাস তার দর্শন উগরে দিল উদাস নিমাইয়ের উপরে। আক্কাসের কথায় মন ছিল না নিমাই এর, নিমাই এর মাথায় খালি হিসাব আর হিসাব - এই মৌসুমে ধারে বীজ কিনে চাষাবাদ শুরু করেছে, প্রচুর শ্রম দিয়েছে, কিন্তু বিগত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ওকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।
পাড়ের পাশ দিয়ে গমনরত শরীফ মাস্টার এর দিকে তাকিয়েআনমনে শুধু আক্কাসের কথার প্রতিউওর দেওয়ার জন্য বলল – “হু”।
“ঠিক শরীফ চাচার মত, কেউ হ্যার কতার দাম দেয় না, হ্যারে খালি সম্মান দেয়” – সামনাসামনি উদাহরণ পেয়ে যেন কথার খই ফুটল আক্কাসের মুখে। “আর দেখ আরজআলিরে, হ্যার ট্যাকা আছে, হ্যার দাপট আছে, এইলেইজ্ঞা হ্যারে সবাই মাইন্য কইরা চলে”।
“হুমম্ম্ম্ম্” দীর্ঘশ্বাসটা নিজের কাছেই দীর্ঘ লাগল নিমাইএর। নিমাই চিন্তা করল কথা গুলো, মাঝে মাঝে মনে হয় আসলেই টাকাই সব।
নিমাই আবার গভীর চিন্তায় ডুবে গেল, মনে মনে কষতে থাকল লাভ ক্ষতির অঙ্ক।
২
আরজআলি বরাবরই কাজের কথার লোক, নিজের লাভ ছাড়া একটা কথাও বলে না। আজও তার ব্যাতিক্রম হল না - “আক্কাস,তোর বন্ধুর চাষাবাদ কেমন চলছে রে?”। মোমিনের দোকানের পান চিবুতে চিবুতে আরজআলি জিজ্ঞাসা করল।
“খুব একটা ভালা না, বৃষ্টির যে অবস্থা তাতে ফসল নষ্ট হইতে পারে” – চায়ের কাপ থেকে চুমুক নিয়ে ধীরে সুস্থে বলল আক্কাস।
“আপনার দিন কাল কেমন চলছে মহাজন?” – ভদ্রতা করে জিজ্ঞাসা করল আক্কাস।
“খুব একটা ভালা না, গত মাসে বকুলরে ট্যাকা ধার দিছিলাম, কিন্তু এখনও ফেরত দেয় নাই। ভাবতেছি কিছু একটা করতে হইব”। বলেই জোরে জোরে পান চিবুতে চিবুতে নিজেই নিজের চিন্তায় ডুবে গেল আরজআলি। আক্কাসও নিজের মত চায়ে চুমুক দিতে থাকল, কিন্তু এই ছন্দে বাধা পড়ল মহাজনের কথায় – “তোর তো কাজ কাম নাই মিয়া, করবি নাকি কিছু কাজ?”।
আক্কাস প্রথমে মনে হল ঠিক শুনে নাই, তাই সরাসরি মহাজনের চোখের দিকে তাকাল, ঠান্ডা দৃষ্টি আর হাস্যরত মুখ দেখে বুঝল মহাজন মশকরা করছেনা। “কি করতে হইব কন, মহাজন” আক্কাসের অনেক ইচ্ছা মহাজনের হয়ে কাজ করার, তাই এই সুযোগ সে এক নিমিষেই লুফে নিল। মহাজন এক সূক্ষ্ম হাসি ধরে রেখে বলল – “আইজা বিকালে বৈঠাক খানায় আইস, তখন কমুনে কি করতে হইব”।
“জ্বি আচ্ছা” – সরাসরি সম্মতি পেয়ে আরজআলি চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাড়াল। “তাইলে তোর লগে বিকালে কথা অইবনে” ঘাড় ঘুড়িয়ে মহাজন কথাটি বলেই হাটা শুরু করল নিজ গন্তব্যের দিকে।
আক্কাস তার গমন দিকের দিকে তাকিয়ে নিজ ভবিষ্যতের জাল বুনতে থাকল - চায়ের কাপটা হাতের মধ্যেই ঠান্ডা হতে দিয়ে।
৩
নিমাই সজোরে ঢুকল মহাজনের বৈঠক খানায় – “মহাজন এই সবের মানে কি? তুমি আমার জমি দখল করছ কেন? তোমারে আমি ১৮০০০ ট্যাকা দিছি না?”।
আরজআলি আক্কাসের সাথে কি যেন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছিল, চিন্তায় ছেদ পড়ায় বিরক্ত চোখে দেখল বিরক্তির কারণ কে। “তোমারে কি আমি ১৮০০০ ট্যাকা দিছিলাম? তোমারে দিছিলাম ২৫০০০ ট্যাকা, তুমি আমারে ১৮০০০ দিলি কি হবে?” মহা বিরক্ত মহাজন।
“তোমারে তো আমি কইছিলাম যে ৭০০০ ট্যাকা পড়ে দিবনে।
তুমি তো তখন কিছু কও নাই। এখন তুমি আমার জমি দখল করে রাখছ, আমার ঘরে তো বৌ বাচ্চা আছে, তাগের তো কিছু খাওয়াইয়া বাচাইয়া রাখন লাগব”।
“সেইডা তো তোমার চিন্তা,” – একটু চিন্তা করে শয়তানি হাসি মুখে ফুটিয়ে বলল –“তুমি না রাখতে পারলে দিয়া যাইও আমিই দেইক্ষা শুইন্না রাখুম নে”।
মহাজনের ধূর্ত কথা মাথা পুরা ওলট পালট করে দিল নিমাই এর। “কুত্তার বাচ্চা” - নিমাই তেড়ে এল মহাজনের দিকে, কিন্তু তাকে ছুঁতে পারল না রহিম আর সঞ্জীবের পেশীবহুল হাতের জন্য।
মহাজন প্রথমে নিমাই এর রুদ্রমূর্তি দেখে ভয় পেলেও এখন খানিকটা সাহস ফিরে পেয়েছে। ভয়কে রাগে পরিণত করে রাগানিত্ব স্বরে বলল – “ভাল করে ধরে রাখিস শুয়রের বাচ্চাটাকে”। নিমাই কোন ভাবেই রহিম আর সঞ্জীবের পেশীর বাধন থেকে বের হতে পারল না, বৃথা চেষ্টা করে যেতে লাগল। শেষটায় হাল ছেড়ে দিয়ে আক্কাসের দিকে তাকিয়ে বলল – “আক্কাস, তুই মহাজনরে একটু ক না, আমার জমিডা গেলে আমি আমার বাচ্চা কাচ্চাদের খাওয়াব কিভাবে?”।
“ট্যাকা যখন নিছিলি তখন মনে ছিল না কথাটা?” আক্কাস সরাসরি নিমাই এর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা গুলো বলল।
নিমাই এর চেহারা থেকে আকুতির শেষ লেশটুকু চলে গেল এই কথা শুনে, নিমাই যেন আক্কাস কে চিনতে পারছে না, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আক্কাসের দিকে। আক্কাস সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে বেশীক্ষণ তার বর্ম ধরে রাখতে পারলনা। তাই অস্বস্তি দূর করতে সঞ্জীবকে বলল – “ওকে ঘাড় ধরে বাইরে নিয়ে যা”। নিমাই এখন আর কোন কথা বলছেনা। কিন্তু নিমাইএর চোখ কথা বলছে, গাল বেয়ে পড়া অশ্রুর প্রতি ফোটা যেন চিৎকার করে নিমাই এর কষ্ট বর্ণনা করছে।
নিমাইকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যেতে থাকল রহিম আর সঞ্জীব। নিমাই অপলক দৃষ্টিতে আরজআলির চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল আরজআলি হাসছে বিজয়ের হাসি। নিমাই ধীরে ধীরে কিন্তু তীক্ষ্ণ স্বরে বলল –
“আরজআলি - আর কত জমি লাগে তোর?”
আরজআলি নিমাই এর চোখে যেন কাল বৈশাখীর কালো ঝড় দেখতে পেল, তার হাসি যেন সেই ঝোড়ো হাওয়ায় দপ করে নিভে গেল নিমিষেই। এখনও তার কানে বাজছে নিমাইএর কথাটা –
“আর কত জমি লাগে তোর?”
৪
সাকিব বইয়ের শেষ পাতাটা উল্টিয়ে বন্ধ করে বইটা পড়ার টেবিলের উপরে রাখল। বইয়ের নিচে, কাচের তলে বাংলাদেশের মানচিত্র টা দেখে নিজের অজান্তেই সাকিবের দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসল।
টেবিলে এক পাশে পড়ে থাকা খবরের কাগজে ছাপা হওয়া দূর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রীর ছবিটার দিকে তাকিয়ে আনমন বলে উঠল –
“আর কত জমি লাগে তোর?”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।