আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধারাবাহিক বিজ্ঞান-কল্পকাহিনি “রুনের ঘটনাপঞ্জী” (ক্রম-২)

এক/ অপেক্ষার প্রহর অনেক কষ্টের। ধৈর্যেরও। সাতটা দিন রুনের খুব অস্থিরভাবে কাটে। বিজ্ঞানী জেডনের সাথে একজন প্রায়শূণ্য মহাকর্ষবলীয় এলাকা ঘুড়ে এসেছেন, এমন একজন আসছেন। নোরা নক্ষত্রপুঞ্জ, বৃত্তাকারে ঘুড়ে বেড়ানো কয়েক কোটি মাইল বিস্তৃত ধূমকেতু, পর পর দশটি মৃত নক্ষত্র, নক্ষত্রের কবরস্থান, মহাকাশে হটাৎ করে সৃষ্টি হওয়া মহাজ্যোতি, তারপর বিকশমান আরেকটি প্রাণীজগৎ কিংবা নতুন কোন বিশ্বব্রাম্মান্ড- ইত্যাদি রুন শুধু গ্যালাকটিক পোর্টালেই পড়েছে, আজ হয়ত মুখোমুখি বসে একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনাও শুনতে পারবে।

দুপুরের ঠিক আগে, ঘড়ির কাটাঁ ঘণ্টার ঘর পরিবর্তন করার আগেই হালকা আকাশী রঙের একটি স্পেসশীপ ত্রিনারে অবতরন করে। রুন আর লিহা দেখতে পায় গড়পড়তার চেয়ে কিছুটা লম্বা, ফর্সা, খানিকটা ছিপছিপে একজন স্পেসশীপ থেকে নেমে আসেন। কাউকে বলতে হয় না। রুন আর লিহা বুঝতে পারে ইনিই সেই দলপতি অ্যালান। ছিপছিপে হলেও মাংসপেশীর স্পস্ট করে তার অনাবৃত কাঁধে চোখে পড়ে।

কমনীয় চোখ। ঘন চুল। হাসিমাখা মুখ। পরনে হালকা গোলাপীর মাঝে গভীর সাদা রেখা টানা নিও পলিমারের কাপড়। সব মিলিয়ে দলপতি অ্যালানকে অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন বলে রায় দেওয়া যায়।

অল্পসময়েই তিনজনকে একটি মাঝারিমাপের গোলাকৃতি গ্রানাইটের টেবিল ঘিরে আলাপরত অবস্থায় পাওয়া যায়। লিহা ছোট্ট একটি পানীয়ের গ্লাস অ্যালানের দিকে এগিয়ে দেন। রুনের বাবা পদার্থবিজ্ঞানের যে ত্রুটিটি সংশোধন করে ইউরেনাস আর নেপচুনের আন্তমহাকর্ষবল একটি নির্দিষ্ট স্থানে বৃদ্ধি করে ত্রিনারকে বসবাসের উপযোগী করে তোলেন। বিজ্ঞানী জেডন তার একটি আর্টিকেলে পদ্ধতিটির ভূয়সী প্রসংশাও করেন। পদ্ধতিটি মহাকাশে নতুন বসতি স্থাপনের ক্ষেত্রে যে যুগান্তকারী তা বারবার বলতে থাকেন।

তারপর প্রসঙ্গ আসে নোরা নক্ষত্রপুঞ্জ। “বিজ্ঞানী জেডন যেমন বলেছেন নোরা পেড়িয়ে একটি নতুন সৃষ্টিসভ্যতার কথা। সত্যিই কি সেরকম কোন সভ্যতা আছে?” লিহা জানতে চান। “আসলে নোরার নির্দিষ্ট ঐ এলাকার পথ অনেকটা হ্যালুসিনেসনের মত। তবে হ্যাঁ সম্ভবত আশ্চর্য এক সৃষ্টিসভ্যতা সেখানে আছে।

আমরা সে পর্যন্ত যেতে পারিনি। কিন্তু ধারনা করতে পারি নোরার ঐ এলাকার পর মহাবিশ্বের সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতের উপস্থিতির সূচনা রয়েছে। ” “আমি সেদিন এক আর্টিকেলে দেখলাম দুই বিজ্ঞানী ঐ এলাকা নিয়ে কিছু হাইপোথিসিস দাঁড় করিয়েছেন। ” লিহা বলেন। হাল্কা করে কাঁধ ঝাঁকালেন অ্যালান।

বলেন, “আমি পড়েছি, কিন্তু আমি তাদের সাথে একমত নই। সবকিছুই সবসময় আমাদের নিজস্ব জ্ঞান-বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। জ্ঞান-বিজ্ঞান একটা আপেক্ষিক সূচক। অনেকটা দৃষ্টির মত। আবার সবকিছু যে আপনি কিংবা একই রকম দেখব বা একই দৃষ্টিকোন দিয়ে দেখব বা ব্যাখ্যা করব তা কিন্তু নয়, যতখন না পর্যন্ত আমরা সত্যিকারের কার্যকারন না জানতে পারি।

সেখানে পাউলীর নীতি খাটছে না। একই স্থানে একাধিক অস্তিত্ব থাকছে। তাও আবার এক্তা দুটো নয়। রীতিমত হাজার হাজার!” তারপর হটাৎ করেই রুনের দিকে ফিরে প্রশ্ন করেন, “ তুমি পদার্থবিজ্ঞানের সপ্তম মাত্রার ব্যবহারিক প্রয়োগ করেছ?” “হ্যাঁ। ” শুধু পদার্থবিজ্ঞানের সপ্তম মাত্রা না, রিমন হাইপোথিসিসের এক্তা কার্যকরী সমাধানও রুন করেছে।

” রুনের মা লিহা বলে চলেন। “ইতিমধ্যে সেটা প্রাথমিক স্বীকৃতিও পেয়েছেও। গনিতের একান্নতম উপপাদ্য দিয়ে ত্রিমাত্রিক জগতের সাথে দ্বিমাত্রিক জগতের সুষম উপস্থাপন রুন করেও ফেলেছে। ” দলপতি অ্যালান অবাক হন। বলেন, “ইস! এই গুণটা যদি আমার থাকত।

” তিনি পানীয়ের বাকীটুকু চুমুক দিয়ে লিহার দিকে তাকিয়ে বলেন, “মহামান্য দ্যুমা আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা যদি জানতেন?” “কী দায়িত্ব?” মা-ছেলে একসাথে বলে ওঠে। “আমরা আবার নোরায় যাচ্ছি। এবারের মহাকাশযানে থাকবে দশমমাত্রার পাঁচটি ইঞ্জিণ। যার মাত্র একটি ইঞ্জিণ দিয়েই সৌরজগতের এমাথা থেকে ওমাথা একশতবার চক্কর দেওয়া যায়। পর্যায়সারনীর দুইশত বায়ান্নতম মৌলকে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এই মহাকাশযানে।

” হিসেব মতে অনেক অনাবিস্কৃত মৌল নোরাতে আছে। সেগুলো সেখান থেকে সংগ্রহ করে অ্যাণ্ড্রোমিডার মানাব বসতিতে পৌঁছে দিতে হবে। “ইস! আমি যদি পরিপূর্ণ এক পদার্থবিদ হতাম। ” লিহা আফসোস করেন। অ্যালান হাসেন।

লিহার মনের কথাটা বুঝতে পারেন। বলেন, “আপনাকে দলে পেলে ভালই হতো! কিন্তু আমার দূ্র্বলতা হচ্ছে মহামান্য দ্যুমা যে কাজ দিয়েছেন সেটা ঠিকভাবে শেষ হবে কিনা তা নিয়ে!” “আপনারা কি সরাসরি যাবেন? নাকি সংকোচণ নীতি অনুসরন করে বিশাল দূরত্ব পাড়ি দেবেন? অ্যাণ্ড্রোমিডাতে কি বিরতি নিবেন?” “ঠিক ধরেছেন। ” খাওয়া শেষ। লিহা বসতির কেন্দ্রীয় তথ্যকেন্দ্রে আজকের সর্বশেষ অবস্থা দেখতে চলে গেলেন। আর সেসময় অ্যালান রুনের পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞান সম্পর্কে বুঝার চেস্টা করতে লাগলেন।

রুন অ্যালানকে সন্তুষ্ট করতে পারল। অবশেষে অ্যালান রুনকে প্রস্তাব দিলেন, “আমার সাথে নোরাতে যাবে?” রুনের মনে হয় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। কোনমতে বলল, “স-সত্যি!” “যদি তুমি যেতে চাও তাহলে আমার দিক থেকে কোন আপত্তি নেই। হঠাৎ করে উপস্থিত হওয়া পদার্থবিজ্ঞান কিংবা গনিতের কোন ব্যাখ্যা দরকার হলে তুমি ভাল একটা পছন্দ হতে পারো। ” লিহা ইতিমধ্যে আবার ফিরে আসেন।

রুন তার মাকে সব খুলে বলে। লিহা অ্যালানকে বলেন, “রুন মহাকাশ অভিযানের কী বুঝবে? কতো নিয়মকানুন! তাছাড়া সেতো এখনো বিশে পা দেয়নি!” “সেটা নিয়ে আপনি ভাববেন না। আমি ওর পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞানটুকুর বাস্তব ব্যবহার করতে চাই। ” অভিযানটা কত দিনের?” লিহা জানতে চান। “প্রাথমিকভাবে ধরা হয়েছে চল্লিশ বছর।

” “চল্লিশ বছর!” লিহা আঁতকে ওঠেন। “হ্যাঁ। তবে সেটা মহাকাশযানের হিসেবে। আপনাদের হিসেবে প্রায় এক সৌর বছর। ” লিহা কিছুক্ষণ ভাবলেন।

তারপর রাজী হয়ে যান। কিছুদিন পর রুন ত্রিনার থেকে বিদায় নিয়ে পৃথিবী্তে চলে যায়। সেখানে মহামান্য দ্যুমার সাথে তার দেখা করার সৌভাগ্য হয়। মহামান্য দ্যুমা কেন্দ্রীয় কমিশনের সভাপতি। বয়স আশির কাছাকাছি।

রুন ছোটবেলা থেকেই তার অনেক গল্প শুনেছে। পদার্থবিজ্ঞানের যুগান্তকারী অনেক ব্যাখ্যা মহামান্য দ্যুমা নিজে দিয়েছেন যার দ্বিতীয় কোন ব্যাখ্যা গত চল্লিশ বছরে আর কেউ দিতে পারেনি। এছাড়া মহাকাশ বিজ্ঞানের ইতিহাসে চরম রহস্যময় সূ্ত্র “দ্যুমার প্রথম নিয়ম” তার আবিষ্কার। রুন ভেবেছিল মহামান্য দ্যুমা হবেন গম্ভীর কোন ব্যক্তি। কিন্তু বাস্তবে সে দেখল, তিনি অত্যন্ত হাসিখুশী, উদ্যমী আর প্রানোচ্ছল এক মানুষ।

মহামান্য দ্যুমা একটা ছোট্ট নোটবুক রুনের হাতে দিয়ে বললেন, “প্রাচীন পৃথিবীর মিশরীয় কিংবা ইনকা সভ্যতার নাম শুনেছ?” রুন অস্ফুটস্বরে বলে, “না, মহামান্য দ্যুমা, আমি শুনিনি। ” “প্রাচীন পৃথিবীতে কিছু জ্ঞাণী মানুষ ছিলেন যারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে তখনকার সময় থেকে অনেক অগ্রগামী ছিলেন। তাদের সেই জ্ঞান তারা বিভিন্ন জায়গায় লিপিবদ্ধ করে গেছেন। এসবের অনেক কিছু আমরা উদ্বার করতে পেরেছি। তারপরও অনেক কিছুই এখনও অজানা।

সেই অজানার অনেক অসম্পূর্ণ ব্যাখ্যা তুমি এখানে পাবে। আমি কাগজ তৈরী করে সেখানে লিখেছি। দীর্ঘযাত্রায় তুমি সেটা পড়বে। ” “আমি অবশ্যই পড়ব। ” রুন জবাব দেয়।

“মানুষ একসময় ভাবত প্রাচীণকালে হয়তো ভীনগ্রহের প্রানীরা পৃথিবীতে এসেছে। আমিও সেরকম মনে করি। যদিও এখন পর্যন্ত সেরকম কোন প্রাণের দেখা পাইনি। তবে নোরাতে থাকার ব্যাপারে বিজ্ঞানী জেডন আর অ্যালানের যে সন্দেহ আছে আমার বিশ্বাস সেটা সত্যি!” মহামান্য দ্যুমা একটু থামেন। “এই অভিযানে অ্যালানের প্রস্তাবে তোমাকে নেওয়া হয়েছে-” মহামান্য দ্যুমা বলতে থাকেন, “এই কারনে যে মানুষ হিসেবে তোমার বুদ্ধিমাত্রা একটি দশম মাত্রার রোবটের চেয়েও বেশী।

গনিতের সমস্যা সমাধান তুমি যতদ্রুত করতে পার সেটা সুপার রোবটের সমান। যদি নোরায় প্রাণী থাকে আর তারা যন্ত্রপাতির সার্কিট অকেজো করে দেয় তাহলে মানুষ হিসেবে তুমিই সেরা পছন্দ। আমার বিশ্বাস তুমি পারবে। ” রুন খানিকটা হাসে। মহামান্য দ্যুমা বলেন, “মহাকাশযানে তুমি একটা কাগজের খাতা পাবে আর পাবে একটি পেন্সিল।

তুমি যা যা লিখে রাখা বলে মনে করবে সব লিখে রাখবে। তোমার বাবা ছিলেন একজন সত্যিকারের মহাকাশ ইঞ্জিনিয়ার। আশাকরি তুমি তার সম্মান রাখবে। ” রুনের কাঁধে হাত রেখে মহামান্য দ্যুমা আবার বলেন, “অ্যালান একজন দক্ষ দলপতি। এই মুহূর্তে তারচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি আর নেই।

আশা করি তার সাথে তোমার সময় খুব ভালো কাটবে। ওর নির্দেশ মেনে চলবে। শৃঙ্খলা ভঙ্গ করবে না। আর একটা কথা কোন বিপদ আসলে ধৈর্য্য হারাবে না। এ জাতীয় অভিযানে ধৈর্য্যের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।

” মহামান্য দ্যুমার সাথে সাক্ষাতের শেষে রুন কেন্দ্রীয় কমিশন থেকে বের হয়ে আসে। তার মাথায় শুধু মহামান্য দ্যুমার শেষ কথাগুলো বারবার বাজতে থাকে, “ধৈর্য্যের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। ” ধৈর্য্য যে কতটা প্রয়োজন সেটা মহামান্য দ্যুমার সাথে দ্বিতীয়বার দেখা হবার আগেই রুন বুঝতে পেরেছিল। খুব ভালভাবেই বুঝতে পেরেছিল। (ভাল কিংবা খারাপ অথবা বিরক্তিকর যা-ই লাগুক আপনারা মন্তব্য করুন।

আপনাদের মন্তব্য আমাকে আরও ভাল কিছু লিখতে উৎসাহ দিবে। ) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।