:-)
কোন স্কুলে পড়,বাবু?—“আন্টি,ভিকারুননিসাতে পড়ি”
"ক্লাস থ্রীতে ভিকারুননিসার ধানমন্ডি শাখার ছোট্ট প্রাঙ্গনে আমার পদার্পণ। তারপর অনেকগুলো সুন্দর সময় কেটে গেছে এখানে। পড়াশোনা,বন্ধুদের সাথে খুনসুটি,মাঝে মাঝে ক্লাস টেষ্টের যন্ত্রনা আর চুলে তেল দিয়ে আসার কড়াকড়িতে ক্লান্ত আমরা। তবুও সেই জীবনে একটা আনন্দ ছিল। মনে আছে,রোজ চুলে তেল দিতে ইচ্ছা করত না দেখে ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় আমি চুলে পানি দিয়ে আসতাম! তবুও সবসময় পরিপাটি থাকা,থাকতে চাওয়া—আমাদের সেই সময়ে ভিকিদের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল।
আর ছিল নিয়মের প্রতি অগাধ আনুগত্য.."
স্কুল জীবন নিয়ে ভেবেছিলাম একটা পোষ্ট লিখব। সেই পোষ্টের শুরুর অংশটুকু উপরে দেওয়া। কিন্তু লেখাটা শেষ হ্ওয়ার আগেই আমার প্রিয় স্কুল খবরের কাগজে,কিংবা ব্লগে আর ফেসবুকে শিরোনাম হয়ে গেল। কেন শিরোনাম হল—সেই ঘটনা সবার জানা। আমাদের স্কুলের একজন শিক্ষকের(!) অমানবিক কর্মকান্ডে প্রচণ্ড লজ্জিত হয়ে,একই সাথে তীব্র ক্ষোভ নিয়ে একজন এক্স ভিকি হিসেবে আমার এই পোষ্ট।
আমরা যখন ক্লাস এইটে বা নাইনে পড়ি,আমাদের ক্লাস নিতেন মান্নান স্যার। স্যার আমাদের পিতৃতুল্য ছিলেন। কতদিন স্যারের সাথে ক্লাসের ফাঁকে আমরা কত্ত গল্প করতাম,স্যার কি সুন্দর করে আমাদের পড়াতেন। কোনদিন মনে হয়নি স্যার একজন পুরুষ মানুষ। সব সময় স্যারকে মনে হয়েছে বাবার মত,কিংবা একজন “স্যার”।
যিনি আমাদের ভালবাসেন সন্তানের মত।
ফিজিক্স আর হায়ারম্যাথের ক্লাস নিতেন জসিম স্যার। স্যারের কাছে আমি কোচিং করতাম না। কিন্তু বলতে গেলে আমাদের পুরো ব্যাচ-ই স্যারের কাছে কোচিং করত। প্রি-টার্মের আগে দিয়ে স্যার আমার অন্য বন্ধুদের কাছে আমার পড়াশোনার খোঁজ নিয়ে বলেছিলেন,"ও যদি চায় তাহলে আমার সাজেশনগুলোও দিও।
আর কোন সমস্যা হলে যেন কথা বলে। '' স্যারের সেই কথা শোনার পর বিনম্র শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে গিয়েছিল আমার। ম্যাট্রিক পরীক্ষার রেজাল্টের পর স্যারের বাসায় মিষ্টি দিতে যাওয়ার পর স্যারের দোয়া কোনদিন ভুলে যাওয়া যাবেনা,কক্ষণো না।
তাহমিনা আপার কাছে ফিজিক্স-কেমিষ্ট্রির কোচিং করতাম। ক্লাস শেষ হ্ওয়ার পর আম্মু নিতে না আসা পর্যন্ত ম্যাডামের বাসায় বসে থাকতাম একা একা।
অনেকদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকতে হত। ম্যাডাম বারবার এসে দেখে যেতেন আমাকে। বলতেন,আম্মু না আসলে নীচে নামবে না একদম। কি মায়া সেই আদেশে! কতটা মাতৃসুলভ ম্যাডামদের পেয়েছি প্রিয় ভিকারুননিসায়!
আজ্ও মাঝে মাঝে স্যারের সাথে দেখা করতে খুব ইচ্ছা করে। ব্যস্ত জীবনে হয়ত আর পুরোনো প্রাঙ্গনে পুরোনো শ্রদ্ধা আর আবেগ মিশে থাকা মানুষগুলোর কাছে ফিরে যাওয়ার সময় হয়না।
তবুও কোনদিন সেই মানুষগুলোর সাথে দেখা করতে গেলে অনেক কথার ভীড়ে অবশ্য-ই মান্নান স্যার বা জসিম স্যারকে জিজ্ঞেস করতে হবে,--“পরিমলরা কেন আপনাদের মত পিতৃতুল্য হতে পারেনি স্যার?” কিংবা তাহমিনা আপাকে কাছে পেলে অবশ্য-ই জানতে চাইব—“কেন অধ্যক্ষ হোসনে আরা একজন মা না হয়ে শুধুই একজন অধ্যক্ষ হলেন,আপা? কেন তিনি হামিদা আলী আপা হতে পারলেন না,কেন?”
জানি তাঁদের কাছে কোন উত্তর থাকবেনা। কারণ তাঁরা তো এরকম অমানুষ নন,তাঁরা ছিলেন আমাদের শ্রদ্ধা ভাজন,আমাদের শিক্ষক,আমাদের অভিভাবক। একজন পরিমল,একজন হোসনে আরা খুব কম-ই জন্মায়। কিন্তু যখন জন্মায়,তখন একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তিলে তিলে গড়ে ওঠা সুনাম ধসিয়ে দেওয়ার জন্য-ই মনে হয় জন্মায়! তারা শিক্ষক নামের কলঙ্ক।
ছোটবেলায় আম্মুর অফিসে গেলে আন্টিরা আমাকে আদর করে জিজ্ঞেস করতেন,"কোন স্কুলে পড় বাবু?” একবুক গর্ব নিয়ে বলতাম,"আন্টি ভিকারুননিসা নূন স্কুল।
" আজ যখন একটা ফোর-ফাইভে পড়া পিচ্চিকে এরকম আদর করে জিজ্ঞেস করা হবে,"কোন স্কুলে পড় বাবু?” সে কি আমার মত গর্বভরে বলতে পারবে স্কুলের নাম? কিংবা বলতে পারলেও সেই আন্টির চেহারায় স্কুল নিয়ে প্রশংসার বদলে কি ফুটে উঠবেনা বর্বর পশু পরিমলের ছাত্রী নির্যাতনের কাহিনী? আন্টি নিশ্চয় সেই পিচ্চি মেয়েটির মাথায় হাত রেখে বলবেন,"সাবধানে ক্লাস করো,মা”।
আমরা চাইনা আমাদের প্রিয় ভিকারুননিসার একটি মেয়েও শিক্ষকের কটূক্তি কিংবা নির্যাতনের ভয়ে ভীত হোক। আমরা পরিমল এবং তাকে সাহায্যকারী সকলের বিচার চাই। পরিমল হিন্দু না মুসলিম,সেই ভ্রান্ত কথাগুলোকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে আমরা একজন পশুর উপযুক্ত বিচার চাই। আমরা আমাদের প্রাঙ্গনকে পশুমুক্ত দেখতে চাই।
সবার উপরে মানুষ সত্য
আমি নারীবাদ জানিনা,পুরুষবাদ জানিনা,ধর্মান্ধতা জানিনা। আমি শুধু জানি—আমরা সবাই মানুষ। ধনী,গরীব,হিন্দু,মুসলিম,নারী-পুরুষ—আমরা সবাই আসলে মানুষ।
রোমানা ম্যাডামের উপর নির্যাতনের ঘটনাকে যদি কেউ পরকীয়ার প্রশ্ন তুলে ধামাচাপা দিতে চায়—আমি বলব,সে মানুষ নয়।
লিমনকে যদি কেউ রাজনৈতিক ঘটনার সাথে জড়িয়ে তাকেই অপরাধী করে—আমার চোখে সেই ব্যক্তি মানুষ নয়।
কনোকো ফিলিপসের আওয়ামীলীগের সাথে চুক্তি নিয়েও কেউ যদি আওয়ামীলীগের সাফাই গায়,আমার কাছে সেই ব্যক্তি দেশদ্রোহী জানোয়ার,মানুষ না।
শিবিরের সাথে ধর্মকে মিলিয়ে ফেলে কেউ যদি “শিবির শিবির” করে মুখে ফেনা তুলে,রগ কাটে,আমার কাছে সে বাংলাদেশের নিকৃষ্টতম প্রানী।
এবং এই মানুষরূপী পশুদের বিবেক কোনদিন জাগ্রত হবেনা। কারণ তাদের কোন শিক্ষা নেই,ধর্ম নেই,দেশ নেই। তবুও প্রতিদিন ব্লগে,ফেসবুকে কিংবা পেপারে আমি এই মানুষগুলোর প্রতিচ্ছবি দেখে যাচ্ছি।
কিছুই করার নেই আমার। আগে প্রচন্ড কষ্ট হত। এখন দিনে দিনে অনূভূতিশূন্য হয়ে যাচ্ছি। ব্লগে আসিনা,ফেসবুকে যাইনা,পেপার পড়াও ছেড়ে দিচ্ছি প্রায়। সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাচ্ছে,যাক।
আমি নিজেও এই ঘুনেধরা,অন্ধকার,মেরুদন্ডহীন সমাজের রূপটাকে দেখে ফেলছি। একদিন হয়ত আমিও মিশে যাব নষ্টদের ভীড়ে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।