প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অবহেলায় তিনশ বছরের ইতিহাস খ্যাত পুরনো অর্ধ বঙ্গেশ্বরী মহারানী ভবানীর বাসভবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে নাটোরের ঐতিহ্য। নাটোর শহরের প্রাণ কেন্দ্রের উত্তরে ১৮০ বিঘা জমির
ওপর নাটোর রানী ভবানী রাজবাড়ী অবস্থিত। জানা যায়, নাটোর রাজবাড়ি এলাকাটি এক সময় বিল ছিল। যাকে অনেকেই ভাতঝাড়ার বিল আবার কেউ ছাই ভাঙার বিল বলে ডাকে।
রাজবাড়ীর চারিদিকে ঘিরে রয়েছে বৃহৎ দুটি জলাশয়, ইনার বেড় এবং আউটার বেড় চৌকি। রাজবাড়ি চত্বরে রয়েছে ছোট বড় পাঁচটি জলাশয়। রাজবাড়ীতে প্রবেশের একটি মাত্র পথ। প্রবেশ পথের দুধারে ছিল প্রহরীদের ব্যারাক। এ ব্যারাকে মোতায়েন থাকত রাজপ্রহরী।
রানী ভবানী রাজবাড়ীতে প্রবেশ করতেই সামনে পড়বে বড় তরফের রাজ প্রাসাদ। আর সামান্য বামেই ছোট তরফের রাজপ্রাসাদ। ভেতরে রয়েছে রানী ভবানীর প্রাসাদ ও মন্দির। রাজবাড়ীর নিরাপত্তা কিংবা বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য চারিধারে খনন করা হয়েছে পরিখা। যার কারণে একটি মাত্র প্রবেশপথ ছাড়া রাজবাড়ীতে প্রবেশ ছিল অসম্ভব।
বড়তরফের প্রাসাদের সামনেই রয়েছে খাজনা আদায়ের জন্য কাচারী ঘর। যা সবসময়ই জমজমাট থাকত দাস-দাসী ও পাইক-পেয়াদার পদচারণায়। কালের পরিক্রমায় আলো ঝলমল দাস-দাসী, পাইক-পেয়াদা পরিবেষ্টিত নাটোরের সেই রাজবাড়ী এখন প্রায় মৃত্যুপুরী। অনেকগুলো ভবন ধসে পড়েছে। তবে অরক্ষিত অবস্থায় কালেরসাক্ষী হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে ৩টি প্রাসাদ, মন্দির এবং রাজা আমলাদের থাকার বাসস্থান।
নাটোর রাজের গোড়া পত্তন করেন পরগনা লস্করপুরের অন্তর্ভুক্ত বাড়ইহাটি গ্রামের তহসিলদার কামদেবের দুই পুত্র রঘু নন্দন এবং রামজীবন। রঘু নন্দন নবাব মুর্শিদ কুলিখার অধীনে চাকরি পাওয়ার পর নিজ যোগ্যতা বলে কৌশলে ভাই রামজীবনের নামে অনেকগুলো জমিদারি বন্দোবস্ত নেন। এভাবে রামজীবন রাজা উপাধিপ্রাপ্ত হন। এরপর রাজা রামজীবনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়ণ নাটোরের ছাইভাঙ্গার বিল কিংবা ভাতঝাড়ার বিল ব্রহ্মোত্তর দান করেন। ১৭০৬ সাল থেকে ১৭১০ সালের মধ্যে রাজা রামজীবন মাটি কেটে পুকুর, চৌকি ও দীঘি খননের মাটি ফেলে বিল ভরাট করে রাজবাড়ি নির্মাণ করেন।
ক্রমশ নাটোর রাজের জমিদারি বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে নাটোর রাজের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে রানী ভবানীর শাসনকালে। বর্তমানে নাটোর রাজবাড়ীকে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে মূল প্রাসাদ ৩টির কিছু সংস্কার করা হয়েছে। অন্য ভবনগুলো সংস্কার না করায় ধ্বংস হতে বসেছে। এদিকে অরক্ষিত অবস্থায় থাকার ফলে মেঝের অনেক শ্বেতপাথর চুরি হয়ে গেছে।
প্রাসাদ গাত্রে জন্মেছে আগাছা। ফাটলও ধরেছে অনেক স্থানে। দেয়ালের কারুকার্য খচিত পলেস্তরা খসে পড়েছে। অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে মহারানীর অন্দর মহল। এটি এখন গরু ছাগলের বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
বড় তরফ ও ছোট তরফ প্রাসাদ দুটি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে সত্বর সংস্কার না করলে যেকোনো সময় ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। নাটোর রাজবাড়ীর ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে ১৯৮৫ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক শেখ আকরাম আলী উদ্যোগী হন। তার প্রচেষ্টায় ইনার বেড় চৌকির কিছুটা খনন করে মাছ চাষের ব্যবস্থা করা হয়। আর বড় তরফের প্যালেসের পিছনে ভূমি উন্নয়নের মাধ্যমে তৈরি করা হয় রানী ভবানী যুব পার্ক।
অযত্ন অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাওয়া সেই যুব পার্কটি এখন মাদক সেবিদের দখলে। মূল ফটকের পাশে দর্শনার্থীদের সমাবেশ এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে আনন্দ ভবন। ভাড়ার বিনিময়ে যে কোনো দর্শনার্থী আনন্দ ভবন ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়াও রাজবাড়ি চত্বরে নির্মাণ করা হয়েছে কয়েকটি পিকনিক স্পট। নাটোরবাসীর জন্য একমাত্র বিনোদনের এই জায়গাটিতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসেন দর্শনার্থীরা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।