দেখে যা অনির্বান কি সুখে আছে প্রাণ...
“নাটোরের কাঁচাগোল্লা” নাটোরের বনলতা সেনের মতোই আলোচিত, আদৃত। বাঙ্গালী ভোজনপ্রিয়, অতিথি আপ্যায়নেও এদের জুড়ি নেই। খাবারের পরে মিষ্টিতো থাকা চাই-ই। যে কোন অনুষ্ঠানে অথবা শুভ সংবাদে মিষ্টি মুখ করানোর প্রচলন বাঙ্গালী সমাজে চলে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। আর সেই মিষ্টি যদি হয় নাটোরের কাঁচাগোল্লা তবে তো সোনায়-সোহাগা।
যারা কোনদিন নাটোরের কাঁচাগোল্লার স্বাদ নেননি তাদের জিভে সব সময় টসটস করে এই অমৃত স্বাদের বিখ্যাত মিষ্টির জন্য। নাটোরের বনলতা সেনের চাইতেও বেশী রয়েছে নাটোরের কাঁচাগোল্লার আন্তর্জাতিক পরিচিতি। নাটোরের কাঁচাগোল্লা শুধু একটি মিষ্টির নামই নয়, একটি ইতিহাসেরও নাম।
কাঁচাগোল্লার গোড়ার কথাঃ কাঁচাগোল্লা গোল নয়, লম্বা নয়, আবার কাঁচাও নয়। তবুও নাম তার কাঁচাগোল্লা! এই নামেই পরিচিতি দেশ-বিদেশে।
আনুমানিক আড়াই’শ বছর পূর্বেও নাটোরের কাঁচাগোল্লার কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়। সুপ্রাচীন কাল থেকে মিষ্টি রসিকদের রসনা তৃপ্ত করে আসছে এই মিষ্টি। তবে ১৭৫৭ সাল থেকে এই মিষ্টি ব্যপকভাবে পরিচিতি লাভ করে। কাঁচাগোল্লা সৃষ্টির রয়েছে চমৎকার কাহিনী। জনশ্রুতি আছে নিতান্ত দায়ে পরেই নাকি তৈরী হয়েছিল এই মিষ্টি।
শহরের লালবাজারের মধুসূদন পালের দোকান ছিল নাটোরের প্রসিদ্ধ মিষ্টির দোকান। দোকানে বেশ কয়েকটি বড় বড় চুলা ছিল। মধুসূদন এসব চুলায় দেড় থেকে দু’মণ ছানা দিয়ে রসগোল্লা, পানিতোয়া, চমচম, কালো জাম প্রভৃতি মিষ্টি তৈরী করতেন। দোকানে কাজ করতেন দশ পনেরজন কর্মচারী। হঠাৎ একদিন মিষ্টির দোকানের কারিগর আসেনি।
মধুসূদনের তো মাথায় হাত! এত ছানা এখন কী হবে? এই চিন্তায় তিনি অস্থির। নষ্টের হাত থেকে রা পেতে ছানাতে তিনি চিনির রস ঢেলে জ্বাল দিয়ে নামিয়ে রাখতে বলেন। এরপর মুখে দিয়ে দেখা যায় ওই চিনিমেশানো ছানার দারুণ স্বাদ হয়েছে। নতুন মিষ্টির নাম কী রাখা হবে? এ নিয়ে শুরু হয় চিন্তা ভাবনা। যেহেতু চিনির রসে ডোবানোর পূর্বে ছানাকে কিছুই করতে হয়নি অর্থাৎ কাঁচা ছানাই চিনির রসে ঢালা হয়েছে, কিন্তু রসগোল্লার ছানাকে তেলে ভেজে চিনির রসে ডোবানো হয়।
তাই তার নাম করণ হয়েছে রসগোলা। এটা কাঁচা ছানার রসে ডোবানো হয়েছে বলেই এর নাম দেয়া হলো কাঁচাগোল্লা। কাঁচাগোল্লার স্বাদ রসগোল্লা, পানিতোয়া, এমনকি অবাক সন্দেশকেও হার মানিয়ে দেয়। এর রয়েছে একটি মিষ্টি কাঁচা ছানার গন্ধ যা অন্য কোন মিষ্টিতে পাওয়া যায়না। ধীরে ধীরে মিষ্টি রসিকরা এই মিষ্টির প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন।
তখন থেকে মধুসূদন নিয়মিতই এই মিষ্টি বানাতে থাকেন। কাঁচাগোল্লা সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। কাঁচাগোল্লার চাহিদা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে মুধুসূদন পালের দোকানে প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন মন ছানার কাঁচাগোল্লা তৈরী হতে লাগল। সে সময় ঢোল বাজিয়ে জানানো হতো কাঁচাগোল্লা কথা।
কি ভাবে কাঁচাগোল্লা তৈরীঃ খাঁটী দুধের ছানা ও চিনি কাঁচাগোল্লা তৈরীর প্রধান উপাদান।
১কেজি কাঁচাগোল্লা তৈরী করতে প্রায় ১কেজি কাঁচা ছানা ও ৪০০গ্রাম চিনির প্রয়োজন। কড়াইতে চিনি গুলো পানি সহ জ্বাল দিতে হয়। চিনি পরিষ্কার করতে সামান্য কাচা দুধ দিতে হয়। কড়াইয়ের গাদ ময়লা পরিষ্কার হয়ে গেলে কড়াইয়ে ছানা ঢেলে দিতে হয়। এরপর জ্বাল এবং একই সাথে কাঠের খন্তা দিয়ে নাড়তে হয়।
এভাবেই ৩০ থেকে ৪০ মিনিট ধারাবাহিকভাবে নাড়তে নাড়তেই পরিপূর্ণ কাঁচাগোল্লা তৈরী হয়ে যাবে। তবে এই নাড়াচাড়ার মধ্যেই রয়েছে শৈল্পিক কৌশল। মোটামুটি এই হচ্ছে ১কেজি কাঁচাগোল্লার হিসাব। বর্তমানে ভাল কাঁচাগোল্লা তৈরীতে শহরের প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন ভান্ডারের পরিচালক এম, এ, রউফ খান জানান তারা কাঁচাগোল্লাতে এলাচ ব্যবহার করেন না। এতে প্রকৃত কাঁচা ছানার গন্ধ পাওয়া যায়।
দেশ-বিদেশে কাঁচাগোল্লাঃ ১৭৬০সালে অর্ধবঙ্গেশ্বরী বাংলার দানশীলা শাসনকর্তা রানী ভবাণীর রাজত্বকালে কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়াতে থাকে। সেই সময় নাটোরে মিষ্টির দোকান ছিল খুবই কম। এসব দোকানে বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা ছাড়াও অবাক সন্দেশ, রাঘবশাহী, চমচম, রাজভোগ, রসমালাই, পানিতোয়া, প্রভৃতি মিষ্টি ছিল অন্যতম। তবে এর মধ্যে সবার শীর্ষে উঠে আসে কাঁচাগোল্লা। ফলে সে সময় রাজা-জমিদারদের মিষ্টিমুখ করতে ব্যবহৃত হতো এই বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা।
এমনকি বিলেতের রাজ পরিবার পর্যন্ত এই কাঁচাগোল্লা যেত। আরও যেত ভারতবর্ষের সর্বত্র। রাজশাহী গেজেট পত্রিকাতেও কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতির কথা বলা হয়েছে। কোলকাতার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতে সেই সময় কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। কোলকাতা এবং নাটোর শহর একই সময় প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ও এই দুই শহরের ঘনিষ্ঠ সার্বনিক যোগাযোগ থাকায় নাটোরের কাঁচাগোল্লার কথা ভারত, ইংল্যান্ডসহ তৎকালীন বিভিন্ন রাষ্ট্রে নাটোরের কাঁচাগোল্লার কথা ছড়িয়ে পরে।
এভাবেই কাঁচাগোল্লা পায় আন্তর্জাতিকতা।
কোথায় পাবেন ভালো কাঁচাগোল্লাঃ নাটোরের কিছু উলেখযোগ্য দোকান ছাড়া এই মিষ্টি নিলে ঠকার সম্ভাবনা রয়েছে। লালবাজারের মধুসূদন পালের দোকান, জয়কালী মিষ্টান্ন ভান্ডার, নীচা বাজারের মৌচাক মিষ্টান্ন ভান্ডার, কুন্ডু মিষ্টান্ন ভান্ডার, অনুকূল দধি ও মিষ্টান্ন ভান্ডার, ষ্টেশন বাজারের নয়ন ও সকাল-সন্ধ্যা। তবে বর্তমানে কাঁচাগোল্লা বিক্রিতে সর্বশীর্ষে রয়েছে মৌচাক মিষ্টান্ন ভান্ডার। এদের রয়েছে নিজের ৩৮টি গাভী।
নিজস্ব জমিতে গো-খাদ্য হিসেবে এরা ঘাসও চাষ করে।
কাঁচাগোল্লা দামঃ বর্তমানে রাজধানী ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এবং কোলকাতাতেও নাটোর থেকে যাওয়ার সময় নাটোরের কাঁচাগোল্লা নিয়ে যেতে কেউই ভুল করেননা। কাঁচাগোল্লার বর্তমান মূল্য প্রসিদ্ধ মিষ্টির দোকান মৌচাকে ২৪০ টাকা কেজি। জনশ্রুতি রয়েছে ১৮৪০ সালের দিকে দিঘাপতিয়ার রাজা প্রসন্ন নাথ রায়ের আমলে শ্রীকৃষ্ণের ঝুলন উৎসবের দিনে উপস্থিত ধর্ম পরায়ন সকলকেই এক বেলচা করে কাঁচাগোল্লা বিতরণ করা হতো। সে সময় প্রতি সের কাঁচাগোল্লার মূল্য ছিল ৩ আনা।
তবে কিছু দিন পূর্বেও নাটোরের কাঁচাগোল্লা বিক্রি হয়েছে ১৮০ থেকে ১৯০ টাকায়। সম্প্রতি মেলামাইনের তিকারক প্রভাবে মানুষ এখন ঝুঁকেছে গরুর দুধের দিকে। তাই দুধের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় মিষ্টির দাম বেশী। তবে মিষ্টি বিক্রিতে মেলামাইনের কোন প্রভাব পড়েনি। শুধু দামটাই বেড়েছে।
সতর্কতাঃ উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং রাজ-রাজড়ার দেশ হওয়ায় নাটোরের কাঁচাগোল্লার সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ায় অনেকেই বাসষ্ট্যান্ড, রেলষ্টেশন থেকে ভেজাল কাঁচাগোলা এক শ্রেণীর ধোঁকাবাজ হকারদের কাছ থেকে কিনে প্রতারিত হচ্ছেন। এটা কখনই নাটোরের ঐতিহ্যবাহী কাঁচাগোল্লার স্বাদ বহন করে না।
তথ্য সরবরাহেঃ নাটোরের সাংবাদিক অহিদুল হক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।