পরে আমি অবশ্য ওর সাথে বন্ধুত্ব অ করেছি। বিশ্বাস করেন আমাদের মাঝে আর কোন সম্পর্ক নেই। আমরা খুব ভাল বন্ধু।
পরদিন আমরা একটা প্রাইভেট মাইক্রো বাস এ চড়ে রওনা হয়ে গেলাম। আমরা বলতে আমি – আমার মা, আমার ফুফাত ভাই- ভাবি আর পুতুল- আমরা পাঁচ জন।
বান্দর বানের পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তায় আমাদের গাড়ি চলেছে হেলে দুলে। শীতের আমেজে সূর্য প্রায় ডুবি ডুবি করছে। আমি আমার ক্যামেরা দিয়ে ছবি নিচ্ছি বিস্তীর্ণ নীলচে পাহাড়ের।
এভাবে ছবি নিতে নিতে একসময় আমি সূর্যাস্তের ছবি নিয়ে শুরু করি। সুদুর নিলচে পাহাড়ের বুকে লাল একটা সূর্য যেন এক পলকেরই মাঝে হাইয়ে গেল।
তারপর ও আমি ছবি নিচ্ছি- কখনো এদিকে কখনো ওদিকে। কি অপরূপ প্রকৃতি- আর তার রুপ। ছবি নিতে নিতেই আমার লেন্স এ নীলচে একটা রেখা ধরা পড়ল। আমি দেখেই দুই তিনটা স্নাপ নিয়ে ফেললাম। গাড়ি দাড় করিয়ে রাস্তার একটা বাঁকে নেমে ক্যামেরার লেন্স দিয়ে ভাল করে দেখলাম যায়গাটা।
কেমন যেন লেজার রশ্মির মত কিছু একটা মাটি থেকে উঠে গেছে সোজা আকাশে। আমি ঘটনাটা সবাই কে দেখালাম। কেঊ কোন ব্যাখা দিতে পারলোনা।
তারপর মনের মাঝে খচখচানি নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম। আর এর আধাঘণ্টার মাঝেই পৌছে গেলাম আমাদের জন্য ঠিক করে রাখা নীলগঙ্গা রেষ্ট হাঊজে।
সারাদিন খুব ধকল গেছে শরীরের ঊপর- তাই খেয়ে দেয়ে সেদিন রাতে আমি তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। ভাই আর ভাবি অনেক রাত পর্যন্ত পুতুলকে সাথে নিয়ে আড্ডা দিল। কিন্তু আমি ওদের সাথে যোগ দেইনি। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন- অনেক ভোরে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল।
আমি দাঁত ব্রাশ করতে করতে গিয়ে দাড়ালাম বারান্দায়-দেখি সূর্য তার অশেষ সৌন্দর্য বিলিয়ে দিয়ে পূর্ব দিকে ঊঠছে। আর এটা দেখেই আমার মনে পড়ে গেল সেই নীল আলোর কথা। আমি মাঠে নেমে এলাম- সেখানে আঙ্গিনা ঝাড়ু দিচ্ছিল এক পাহাড়ি দারোয়ান। আমি ওর সাথে ভাব জমালাম। আর এটা ওটা জিজ্ঞেস করতে করতে সেই নীল আলোটার কথা জিজ্ঞেস করলাম- আর করতেই দেখি ঝাড়ু ফেলেদিয়ে মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে গিয়ে নমস্কার করে কানে হাত দিয়ে বলল-
“বাবু ওটা আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না।
আমি বলতে পারবোনা। আমি বোলতে পারবোনা বাবু”
আমি অবাক হলাম। পাশে একটূ শব্দ হতেই দেখি পুতুল এসে দাড়িয়েছে পাশে। সে ও আমার মত অবাক। তারপর সেই দারোয়ান যা বলল আমরা তাতে আরও বেশী অবাক হলাম।
দারোয়ান বলল- এটা নাকি টিপরা দের আকাশ দেবতা বোমাং দেব এর আলো। আমি শুনেই বললাম-
“ আমাকে নিয়ে যেও তো সেই আলোটার দিকে। আমি কিছু ছবি তুলবো”
সে ভয় পেয়ে বলল-
‘ না না বাবু –ওদিকে যাবেন নাই- ঐ আলোর দিকে যেই গেছে সেই আর ফিরে আসেনি। অনেকে গেছে- সেই আলো আনতে- যাবেন নাই বাবু- দিদি মনি বাবুকে বোলেন যেন ওদিকে না যায়- ওখানে শয়তান আছে”-
বলেই আবার দুহাতে গালে চড় খেয়ে দৌড়ে পালাল সামনে থেকে।
আমরা দুজনেই অবাক।
সারা জীবন এডভেঞ্চার প্রিয় মন আমার- আমি এখানে বেড়াতে এসে এরকম একটা জিনিসের সন্ধান পেয়ে যাবো- স্বপ্নেও ভাবিনি। পুতুলের মনে কি খেলা চলছে জানিনা- আমি ততক্ষণে ওই আলোর দিকটায় যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।
দুপুরের মাঝে পুতুল সেই দাড়োয়ানকে মেনেজ করে ফেলেছে বকশিশ দিয়ে- সে এখন আমাদের কে মানে আমাকে আর পুতুলকে সেই যায়গায় নিয়ে যাবে- কিন্তু সে পুরো রাস্তা আমাদের সাথে যাবেনা- এক ভাগ রাস্তা আমাদের একলাই যেতে হবে।
আমি অবশ্য সুযোগটা পেয়ে খুব খুশি হলাম- এই ফাঁকে পুতুলের সাথে বেশ অনেক ক্ষন সময় কাটানো যাবে। ভাবিকে চুপি চুপি যাবার কথাটা বলে আমি আর পুতুল দারোয়ান কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম- মাকে জানাইনি- মা আর ভাইয়া কে ম্যানেজ করার দায়িত্ব দিলাম ভাবিকে।
তারপর ব্যাগে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
আমরা আসলে কোন রাস্তা দিয়ে চাচ্ছিলাম না। যাচ্ছিলাম পাহাড় থেকে পাহাড়ে। গন্তব্য পশ্চিমে- কিন্তু দুঘণ্টা এক নাগাড়ে হেটে আমরা মাত্র দুটো পাহাড় ডিঙ্গাতে পারলাম। আমি আর পুতুল বেশ ক্লান্ত বোধ করলেও ঐ দারোয়ান বেচারার কোন ক্লান্তিই নেই।
কিছুদুর যেতেই একটা পাহাড়ি ছরা পড়ল সামনে- আমরা বেশ সহজে পেরিয়ে গেলাম সেটা। একটু দুরেই দেখা যাচ্ছে হালকা নীলচে যেই আলো। আমাদের সেখানেই বিদায় দিল সেই পাহাড়ি দারোয়ান। এর পর আমাদের একাই যেতে হবে। আমাদের জন্য এই ছড়ার পাশেই অপেক্ষা করবে কথা দিল সে।
আমরা ও ওকে বিদায় দিয়ে এগিয়ে গেলাম একটা উচু পাহারের দিকে।
আধা ঘণ্টা পর ধীরে ধীরে আমরা পৌছে গেলাম যায়গাটায়। যেমনটা কল্পনা করেছিলাম- তার ছিটেফোটা ও নেই সেখানে। একটা ভাঙ্গা পুরনো মন্দির। সেই মন্দির বেয়ে ছেয়ে গেছে শতবর্ষের গাছ পালা।
আমরা আরেকটু এগিয়ে গেলাম- সেই মন্দিরটার দিকে। খোলা মন্দিরের দরজা দিয়ে দেখা যায় সব। দেখি একটা কালো মূর্তি একটা নীলচে পাথর হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আর সেই নীলচে পাথর থেকে একটা তীক্ষ্ণ আলো বের হয়ে চার পাশ আলোকিত করে আছে- আর মন্দিরের ঊপরে একটা ছিদ্র দিয়ে সেই আলো পৌঁছে যাচ্ছে মহাশুন্যে। আমি অবাক হলাম- মানুষের এই অপূর্ব সৃষ্টি দেখে।
আমি মন্দিরে ঢুকতে চাইলাম- কিন্তু পুতুল ইতস্তত করল। আমাকে কোনভাবেই যেতে দেবেনা। আমি গো ধরলাম যাবোই- শেষে তর্কে না জিততে পেরে সে আমার সাথে যাবে এই শর্তে আমার সাথে এগিয়ে এল মন্দিরের ভেতর যাবার জন্য।
মন্দিরের ভেতর ঢুকতে গিয়ে একটা পচা গন্ধ নাকে বাড়ি খেল। মাটিতে তাকিয়ে দেখি অনেক গুলো কঙ্কাল- মানুষের সত্যিকারের কঙ্কাল।
আমি ভয় পেয়ে গেলাম। বুঝলাম কেন এখানে এসে কেউ আর ফিরে যায়না- কোন এক কারনে সবাই এখানে মারা যায়। তাই সভ্য জগতের কাছে এটার কথা এখনো পৌছায়নি।
আমি ধীরে ধীরে মন্দিরের চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম।
ঠিক দুইহাত দুরেই একটা কঙ্কাল পড়ে আছে।
আমি সেটার সামনে গেলাম। নেড়ে চেড়ে দেখতেই সেটার হাতের একটা হাড় থেকে একটা ধাতব শব্দ করে কিছু একটা মাটিতে পড়ল। আমি জিনিস টা মাটি থেকে তুলে নিলাম। ভাল মত নীল আলোতে দেখা যাচ্ছেনা- অনেকটা সুইয়ের ফলার মত-ধারালো। মনে হল কেউ একজন এটা ছুড়ে মেরেছে বলে এই লোক তার মৃত্যু হয়েছে।
আমি একটু দুরেই আরেকটা কঙ্কালের পাশে বসে সারা শরীরের সব জামা কাপড় ছিড়ে সরিয়ে ফেলতেই বুকের পাঁজর থেকে বেরিয়ে আসল একই রকম আরেকটা সুঁই এর মত তীরের ফলা- বুঝতে বাকি থাকল না যে এটা এই মন্দিরের কোন একটা ট্রিক- যার ফলে কেউ এখানে থেকে এই মুল্যবান নীল পাথর টা নিয়ে যেতে না পারে।
আমি ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম মন্দিরটার দেয়াল গুলো। টেরাকোটা আর পাথরের এক অদ্ভুত সম্মেলনে বানানো এই মন্দিরের ভেতরের গায়ে অসংখ্য ছিদ্র। মনে হচ্ছে এ গুলো থেকে বের হয় এই বিষাক্ত জিনিস গুলো। আমি পুতুল কে কিছুই জানালাম না।
আমি এগিয়ে গিয়ে ভাল মত দেখলাম সেই নীল পাথরটাকে। কোন এক অদ্ভুত মেকানিজমে এই পাথরের ঊপর কেঊ হাত দিলেই একটা করে তীর বের হয়ে আসে আর আগন্তুকের শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেয় এক বিষ যেটার প্রভাবে মানুষ সাথে সাথে ই মারা যায়।
আমার মাথায় ভুত চেপে গেল। যতটানা সেই নীল পাথরের দ্যুতি দেখে তার চেয়ে বেশী লোভে। নিজের মাঝে এক অদ্ভুত অনুভুতি হল।
আমি বুদ্দি খাটিয়ে সেই মূর্তিকে পেছন থেকে ধাক্কা দিলাম। দিতেই মূর্তির হাত থেকে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল সেই নীল পাথর। আর সাই সাই করে বেরিয়ে আসল একটা সুক্ষ তীর ডান পাশের একটা ছিদ্র থেকে। একটু পড়েই আরেকটা ছিদ্র থেকে বেরিয়ে আসল আরেকটা তীর। কিন্তু আমার অবস্থান মূর্তির পেছনে হবার কারনে আমি বেঁচে গেলাম।
আমি দৌড়ে সেই নীল পাথরটাকে হাতে নিলাম। নিতেই শরীরে কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভুতি হল। মনে হল আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ট ধনী। আমি ই শ্রেষ্ট পুরুষ। আমি ই পরম ক্ষমতাশালী।
এমন একটা অনুভুতি যখন আমার মাথায় আকুলি বিকুলি করছে- তখন পুতুল আমার হাত থেকে ছো মেরে নিয়ে সেই পাথরটাকে আবার সেই মূর্তির হাতে রেখে দিল।
মাথটা যেন চক্কর দিয়ে ঊঠল। আমার সামনে থেকে হাজার হাজার স্বপ্ন গুলো যেন নিমিশেই ধুলোয় ঊড়ে গেল। আমি অবাক হলাম- এত ক্ষন আমার মাঝে যা চিন্তা ভাবনা চলছিল- এক নিমিশেই সব নাই হয়ে গেল। বুঝলাম না-কিভাবে এই পাথর আমার মনের ভেতর এই চিন্তা গুলো নিয়ন্ত্রন করছিল।
হটাত আলোটা বেড়ে গেল অনেক। দ্বিগুণ ঊজ্জব্লতায় আমার চোখ ধাধিয়ে গেল। আমি দৌড়ে চলে এলাম বাইরে। পুতুল ও একটুও দেরি করল না। আমার সাথে সাথে সে ও ভয়ে বাইরে চলে এল।
তারপর সেই মূর্তি থেকে একটা সাদাআলো বের হয়ে গেল মিলিয়ে গেল চারপাশে। তারপর সব আবার আগের মত হয়ে গেল। আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। অশুভ কিছু একটা মনের ভেতর খেলা করতে শুরু করল। তবুও পাত্তা না দিয়ে দৌড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম।
তারপর পুতুলের হাত ধরে দৌড়ে সেখান থেকে যত দূরে যাওয়া যায় চলে এলাম। আমি পথ ভুলে গেলেও পুতুল ভোলেনি। আমরা সেই ছড়ার পাশে চলে এলাম। দেখি দারোয়ান সেখানে বসে আছে আমাদের জন্য। ওর সাথে আরও কয়েকজন পাহাড়ি- সবার চোখ মুখে ভয়- আমাদের আসতে দেরি দেখে ওরা জল্পনা কল্পনা করছিল- আমাদের দেখে স্বস্তি পেল যেন।
ওদিকে মা আর ভাইয়া ও অনেক চিন্তা করছেন জানি। কিন্তু কিছুই করার নেই- হাজারো বকুনি আর চোখ রাঙ্গানি জুটবে জানি- কিন্তু এটার ভয় পেলে কি দেখতে পেতাম এই নীল আলো?
তারপরের ঘটনা খুব সাধারন। মা আর ভাইয়া আমাকে প্রচন্ড বকা দিল। ভাবি ছিল বলে রক্ষা। তারপর আমার একা একা বাইরে বের হয়া বারন সবার সাথে থাকতে হবে - শর্ত জুড়ে দেয়া হল।
দুইদিন বেড়িয়ে আমরা আবার ফেরত গেলাম আমাদের নিজ নিজ বাসায়।
আর সেই নীল আলো- আছে আগের মতই- নিজের মাঝ থেকে নীল রশ্মি বিলিয়ে দিচ্ছে মহাশুন্যে- সে এক অপরূপ দৃশ্য -দেখলে জীবনেও ভুলতে পারবেন না। যাবেন নাকি? বান্দরবান গেলে দেখে আসতে পারেন- তবে ভুলেও লোভে পড়ে পাথরটা হাতে ধরে দেখতে যাবেন না- ধরতে গেলেই বিপদ কিন্তু.........
(সমাপ্ত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।