বাংলা আমার দেশ শাহরিয়ার কবির
বাঙালি জাতির কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ অর্জন। এই অর্জন সম্ভব হয়েছিল বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসামান্য নেতৃত্বের কারণে।
১৯৪৭ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উদ্ভট, অবাস্তব ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তানের অভ্যুদয় ঘটে। ভারত বিভক্তিকালে বাংলাদেশে ক্ষমতায় ছিল মুসলিম লীগ। তখন বাঙালি মুসলমানদের বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের অনুসারী। মুসলিম লীগের রক্ষণশীলদের নেতা ছিলেন ঢাকার নবাববাড়ির খাজা নাজিমউদ্দিন, মওলানা আকরম খাঁ প্রমূখ। মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম এবং কংগ্রেসের শরৎচন্দ্র বসু বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে ছিলেন। তাঁরা চেয়েছিলেন অখণ্ড স্বাধীন বাংলা। তাঁদের এই প্রস্তাব কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নাকচ করে দিয়েছিলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন ও সম্ভাবনা অঙ্কুরে বিনষ্ট এবং বাংলা বিভক্ত হওয়ার কারণে অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনের পথ বেছে নিয়েছিলেন। সোহরাওয়ার্দীও হতাশ হয়ে কিছু সময় নিজেকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখে পরে পাকিস্তানের মূল ধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ‘জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এবং পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুকে যদিও বলা হয় সোহরাওয়ার্দীর ভাবশিষ্য, তিনি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজনীতি সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন না। মুসলিম লীগ ভেঙে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে অংশগ্রহণ, কিছু সময়ের জন্য প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রীসভার সদস্য থাকাকালে এবং আওয়ামী লীগের নীতি, কৌশল ও কর্মসূচী প্রণয়নকালে তিনি পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের স্বার্থ সম্পর্কেই বেশি আগ্রহী ছিলেন। একমাত্র সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের পরই তিনি পাকিস্তানের ভাবি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জনসভায় ও সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে জাতীয় রাজনীতি ও অর্থনীতি সম্পর্কে নীতি নির্ধারণমূলক কিছু বক্তব্য প্রদান করেছিলেন।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের কথা বঙ্গবন্ধু ছাড়াও অন্যান্য নেতা যেমন মওলানা ভাসানী, অলি আহাদ, ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী (মহারাজ) প্রমূখ ভেবেছিলেন এবং এ বিষয়ে প্রতিবেশী ভারতের সহযোগিতাও চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মওলানা ভাসানী ও অন্যান্য নেতার পার্থক্য ছিল এইখানে যে, প্রথমতঃ বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগের একটি ধারাবাহিক পরিকল্পনা ছিল, দ্বিতীয়তঃ রাজনীতি ও কৌশল নির্ধারণের ক্ষেত্রে দক্ষ সেনাপতির মত তিনি একাধিক পন্থা অবলম্বন করতেন এবং তৃতীয়তঃ তিনি জানতেন কখন ছয় দফার কথা বলতে হবে, কখন এক দফার কথা বলতে হবে। জননেতা হিসেবে মওলানা ভাসানী অসাধারণ ছিলেন কিন্তু তাঁর কর্মকাণ্ডের কোন সাংগঠনিক ধারাবাহিকতা ছিল না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক চেতনা বিকশিত হয়েছে, আবুল হাশিম, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মওলানা ভাসানীর মিলিত ভাবধারায়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, আবার এটাও তিনি জানতেন পাকিস্তানের কাঠামোর ভেতর সংসদীয় রাজনীতির দ্বারা বাংলাদেশকে স্বাধীন করা সম্ভব নয়।
তিনি বিশ্বাস করতেন সংগঠনে। পঞ্চাশের দশকের শেষে তিনি নিজের দলের অতি বিশ্বস্ত কয়েকজনের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন এবং একষট্টি সালে গোপনে গঠন করেছিলেন ‘ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট। ’ এই সংগঠনের নামে পূর্ব বাংলা স্বাধীন করার আহবান জানিয়ে তখন একটি ইশতেহারও প্রচার করা হয়েছিল।
বাষট্টি সালে দলের অতি বিশ্বস্ত, তরুণ ও সাহসী তিনজন নেতাকে নিয়ে গোপনে একটি নিউক্লিয়াস গঠন করেন, যাঁদের দায়িত্ব ছিল দলের ভেতর বাংলার স্বাধীনতার সপক্ষে জনমত গঠন করা। এই নিউক্লিয়াসের সদস্য ছিলেন আবদুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খান ও কাজী আরেফ আহমেদ।
বাষট্টি সালের ২৭ জানুয়ারী শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার এজেন্ডা নিয়ে গোপনে দিল্লী যাওয়ার উদ্দেশ্যে যখন আগরতলা যান তখন তাঁকে ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স গ্রেফতার করে। এর আগে তিনি ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসের প্রথম সচিবের মাধ্যমে দিল্লীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তাঁর একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীর মতে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁকে আগরতলায় যাদের অভ্যর্থনা জানাবার কথা ছিল তারা সেখানে উপস্থিত না থাকায় তাঁর সেই মিশন ব্যর্থ হয়। এরপর আগরতলায় আরেকটি বৈঠকের উদ্যোগও ব্যর্থ হয় তাঁর সহযোগী একজনের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে।
এই সব গোপন উদ্যোগের পাশাপাশি পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী প্রকাশ্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে স্বাধীনতার সংগ্রামে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রণীত হয়েছিল ৬ দফা।
তিনি যখন লাহোরে আনুষ্ঠানিকভাবে ৬ দফা উত্থাপন করেন তখন নিশ্চিত জানতেন এর পরিণতি কী হবে। তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দেয়া হলেও আইনগতভাবে ৬ দফাকে বিচ্ছিন্নতার সনদ হিসেবে প্রমাণ করা কঠিন ছিল, কারণ এটি ছিল অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রীয় ফেডারেল কাঠামোর অনুরূপ। ৬ দফার বাহ্যিক রূপ কিছুটা নিরীহ হলেও তিনি এর সার সংকলন করেছিলেন তাঁর ভাষায় এই বলে ‘কত নিছ, কবে দেবা, কবে যাবা’।
ভারতের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগের প্রাথমিক উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার কারণে বঙ্গবন্ধু কিছুটা অসন্তুষ্ট হলেও এটা তিনি ভালো করেই জানতেন ভারতের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশ কখনও স্বাধীন করা সম্ভব নয়, যেমনটি জানতেন মওলানা ভাসানী। সত্তরের ফেব্র“য়ারিতে বঙ্গবন্ধু তাঁর একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে গোপনে দিল্লী পাঠিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর হয়ে কথা বলার জন্য এবং দিল্লীর কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়ে তিনি দলের তরুণ নেতৃত্বকে যথাসময়ে ভারতে গিয়ে গেরিলা প্রশিক্ষণের বিষয়ে অবহিতও করেছিলেন।
ঘাটের দশকের শুরুতে মওলানা ভাসানী এবং শেখ মুজিবের স্বাধীনতার পরিকল্পনা সম্পর্কে ভারত অবহিত হলেও তারা এতে যুক্ত হতে চায়নি প্রধানত এই বিবেচনা থেকেপূর্ব বাংলার জনগণ এর জন্য তখন প্রস্তুত ছিল না। উনসত্তরের গণঅভ্যূত্থানে বিজয়ের পর এবং বিশেষভাবে সত্তরের নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার আকাঙ্খা মূর্ত হওয়ার পর ভারত এতে সহযোগিতার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতকে বলতে হয়েছে একাত্তরের ২৫ মার্চের আগে এ বিষয়ে তারা কিছু জানতো না।
শেখ মুজিব স্বাধীনতার সকল প্রকাশ্য ও গোপন আয়োজন সম্পন্ন করেও ২৫ মার্চ কেন গ্রেফতার বরণ করলেন এর ব্যাখ্যা আমি অন্যত্র দিয়েছি।
‘বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং কর্মপদ্ধতি যারা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তাঁরা সকলেই আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, ভারতের প্রতি কখনও তাঁর বিশেষ পক্ষপাতিত্ব বা দুর্বলতা ছিল না।
তিনি জানতেন ভারতের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীন করা সম্ভব নয়, এর জন্য মারাÍক ঝুঁকি নিয়েছেন এবং ভারতের চূড়ান্ত প্রতিশ্র“তিও তিনি সত্তরের ফেব্র“য়ারিতে আদায় করেছিলেন; তারপরও ভারতের সহযোগিতার বিষয়টি সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ সন্দেহমুক্ত ছিলেন না। ’৬২ সালে তাঁর গোপন দিল্লী মিশন ব্যর্থ হওয়ার ঘটনাই এর জন্য প্রধানতঃ দায়ী। আওয়ামী লীগ হাইকমাণ্ড এবং তাঁর বিশ্বস্ত ছাত্র-যুব নেতাদের তিনি ভারতে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েও নিজে এক কারণেই থেকে গিয়েছিলেনতিনি ভেবেছিলেন যদি ভারত প্রতিশ্র“তি রক্ষা না করে তাহলে তাঁকে বিশ্বাবাসীর কাছে চিহ্নিত হতে হবে একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে। যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তিনি এক সময় বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন তাদের রাষ্ট্রদূত যখন তাঁকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন মার্কিন সরকার কোনও অবস্থায় পাকিস্তান ভাঙার কোনও পদক্ষেপ অনুমোদন করবে না, তখন তাঁকে আন্তর্জাতিক জনমত সম্পর্কে অধিকতর সতর্কতার সঙ্গে ভাবতে হয়েছে। নিশ্চিত মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে তিনি পাকিস্তানী সামরিক জান্তার গ্রেফতার বরণ করেছিলেন এটা ভেবে যে, কোনও কারণে যদি সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দিন বা শেখ মনি, রাজ্জাক, তোফায়েলদের মিশন ব্যর্থ হয় পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আলোচনার পথ তাঁর সামনে খোলা থাকবে।
‘তিনি বাংলাদেশ স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন একটি মর্যাদাব্যঞ্জক যুদ্ধ বা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে। কমিউনিস্টদের মতো বনে জঙ্গলে ঘুরে বিচ্ছিন্নতাবাদীর অপবাদ নিয়ে তিনি স্বাধীনতার কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতে চাননি। পাকিস্তানীরা তাঁকে গ্রেফতারের সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করতে পারতো ঠিকই কিন্তু রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কারণে এটাও তাঁর কাছে স্পষ্ট ছিল গ্রেফতারের খবর একবার প্রকাশ হয়ে পড়লে তাঁকে হত্যা করা পাকিস্তানের পক্ষে কঠিন হবে। এই বিবেচনা থেকেই তিনি ভারতে না গিয়ে গ্রেফতারের পথ বেছে নিয়েছিলেন।
‘একজন দক্ষ রাজনৈতিক নেতা কিংবা একজন দক্ষ সমরনায়কও কখনও একই সরল রৈখিক পথে অগ্রসর হন না।
লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য একাধিক পথ নির্মাণ করতে হয় তাদের। আমার বিবেচনায় গ্রেফতারের পথ বেছে নিয়ে বঙ্গবন্ধু ভীরুতা বা সিদ্ধান্তহীনতার নয়, সাহসকিতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় তাঁর ঘনিষ্টজনদেরও অনেককে তাঁকে এ ক্ষেত্রে ভুল বুঝেছিলেন। ’ (স্বাধীনতা ও মুজিব হত্যার পটভূমি ঃ বামপন্থীদের ভূমিকা’, জনকণ্ঠ, ১৫ আগস্ট ’৯৬)
এ কথা সত্যি যে, একাত্তরের ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুর ঘাট থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন বলে একটি বেতার ঘোষণা প্রদান করেছিলেন এবং এই বেতার ঘোষণাটি তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামেই দিয়েছিলেন, কারণ এটা তিনি ভালোভাবেই জানতেন মুজিবের নাম ছাড়া স্বাধীনতার কোন ঘোষণা জাতির কাছে বা বিশ্ববাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। বিশ্বের কোন দেশের কোন সংবাদপত্রে একাত্তরের ২৭ বা ২৮ মার্চের সংবাদপত্রে জিয়ার কোন ভাষণের উল্লেখ নেই।
সর্বত্র উল্লেখ রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চের ঘোষণা যা পিটিআই ও ইউএনআই-এর বরাত দিয়ে বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছে।
২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ যখন ভারতে যান এবং সরকার গঠন করেন তখন দিল্লীর নীতিনির্ধারকরা শেখ মুজিবের প্রকৃত উত্তরাধিকারী কে এ নিয়ে সমস্যায় পড়েছিলেন। তাজউদ্দিন আহমেদ নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, যিনি একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের সময় প্রদেশে কেন্দ্রের সমান্তরাল প্রশাসন পরিচালনা করতে গিয়ে সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন। তা সত্ত্বেও তাঁর প্রতি আওয়ামী লীগের তরুণ নেতৃত্বের একাংশের যথেষ্ট আস্থা ছিল না। শেখ মণির নেতৃত্বে এই গ্র“পটি মুজিব বাহিনী গঠন করে পৃথকভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করেন, যা মুজিব নগর সরকারের অনেকে অনুমোদন করেননি।
ভারতের নীতি নির্ধারকদের অঙ্গীকার ছিল নির্দিষ্টভাবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি, কারণ তাঁরা জানতেন স্বাধীনতার মূল স্থপতি কে। যে কারণে বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকারত্বের দাবি যখন দুই গ্র“পের পক্ষ থেকে উত্থাপিত হয় তখন তাঁরা সৈয়দ নজরুল-তাজউদ্দিনের সরকারকে বাংলাদেশের বৈধ সরকার হিসেবে মেনে নিলেও মুজিব বাহিনীর জন্য পৃথক প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছিলেন। অন্য যেসব দল বা ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁরা বঙ্গবন্ধুর প্রতি যেমন আস্থাশীল ছিলেন, তেমনি মুজিবনগর সরকারের কর্তৃত্বও মেনে নিয়েছিলেন। ক্ষুব্ধ ছিলেন খন্দকার মোশতাকদের মত কতিপয় ষড়যন্ত্রকারী। এমনকি মোশতাকও মুজিবনগর সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সময় শেখ মুজিবের নামই ব্যবহার করেছিলেন।
নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধারা শপথ নিতেন বঙ্গবন্ধুর নামেই। ‘জয়বাংলা’ ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল রণধ্বনি। মেজর জিয়াও বঙ্গবন্ধুর নামে ‘জয়বাংলা’ বলেই মুক্তিযুদ্ধ করেছেনএটাই ইতিহাসের নির্মম সত্য।
একাত্তরে যে সমস্ত দেশ পাকিস্তানের এই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চেয়েছে তারা ইয়াহিয়া খানকে পরামর্শ দিয়েছে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি ভাবি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনার জন্য।
জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ স্বাধীনতার যে ঘোষণা পাঠ করেছিলেন বা যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার প্রেক্ষিতে বলা যেতে পারে তিনি স্বাধীনতার ঘোষক হলে তাঁর নামে বা তাঁর নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হতো। বিভিন্ন দেশ যখন ইয়াহিয়াকে পরামর্শ দিচ্ছিল বা অনুরোধ করছিল গণহত্যা বন্ধের জন্য, সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য তখন জিয়াউর রহমানের নাম তারা আদৌ জানতো না। মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা ততখানি গুরুত্বপূর্ণ হলে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা শেখ মুজিবের বিচারের প্রস্তুতিপর্বে যে শ্বেতপত্র প্রণয়ন করেছিল সেখানে নিশ্চয়ই তাঁর নাম থাকতো এবং মুজিব নগর সরকারে তাঁর অবস্থান প্রধান সেনাপতি না হলেও উপপ্রধান সেনাপতির কাতারে থাকতো। প্রকৃত সত্য হচ্ছে এসব কিছুই হয়নি, যা হওয়ার কথা ছিল তাই হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস জিয়াউর রহমান অন্যসব সেক্টর কমাণ্ডার বা ফোর্সেস কমান্ডারদের মতো মুজিব নগর সরকারের বেতন গ্রহণ করেছেন এবং এই সরকারের অধীনেই যুদ্ধ করেছেন।
তাঁর সম্পর্কে এটুকু বলা যায় ২৭ মার্চে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত তাঁর কণ্ঠস্বর, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহ ঘোষণা সামরিক বাহিনী এবং সাধারণ মানুষের এক বড় অংশকে অনুপ্রাণিত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার সহযোগী ভারতীয় সমরনায়করাও বলেছেন জিয়া একজন দক্ষ অধিনায়ক ছিলেন। তাঁর এই মহৎ অর্জন পরবর্তীকালে তিনি নিজেই ধ্বংস করেছেন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের সংবিধানকে হত্যা করে একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমতার অংশীদার বানিয়ে।
একাত্তরের ঘাতক-দালাল-যুদ্ধাপরাধীদের দল জামাতে ইসলামীর সঙ্গে জোট বেঁধে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছে। একাত্তরে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ প্রতিহত করেছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর প্রধান সহযোগী হিসেবে, পরবর্তীকালেও যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যাবতীয় ষড়যন্ত্র করেছে তাদের মন্ত্রীসভার সদস্য বানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অধিনায়ক জিয়াউর রহমানের বিএনপি।
বিএনপি-জামাতের জোট সরকার ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে চাইছে এ কারণেই যে, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি সৃষ্টি করেছেন। বাংলাদেশ যারা চায়নি বঙ্গবন্ধু চিরকাল তাদের প্রধান শত্র“ হিসেবে বিবেচিত হবেন।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর অবদান অস্বীকার করা শুধু ইতিহাস অস্বীকার নয়, বাংলাদেশকেই অস্বীকার করা। এই সহজ সরল সত্যটি গ্রহণ করার ভেতরই নিহিত রয়েছে বাঙালির দেশপ্রেম ও আÍমর্যাদা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।