আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হতাহত শ্রমিকদের ১২৪ শিশুর শিক্ষাজীবন সংশয়ে

সাভারের রানা প্লাজা ধসের কারণে প্রায় সোয়া শ শিশুর শিক্ষাজীবন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। উপজেলার সাতটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১১৪ জন শিশু শিক্ষার্থীর অভিভাবক রানা প্লাজা ধসে নিহত, আহত অথবা নিখোঁজ হয়েছেন। উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এ সংখ্যা ১০ জনের মতো।
সাভার উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সাতটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪৮ শিক্ষার্থীর অভিভাবক নিহত, ১৩ জনের অভিভাবক নিখোঁজ ও ৫৩ জনের অভিভাবক আহত হয়েছেন।
আর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শাহরিয়ার মেনজিস বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তথ্য সংগ্রহ করিনি।

কিন্তু প্রাথমিকভাবে জেনেছি, শাহীবাগ ও রাজাসনের কয়েকটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আট থেকে দশ জন বাচ্চা আছে, যাদের মা অথবা বাবা ভবনধসে হতাহত হয়েছেন। ’
তবে অন্তত পাঁচটি কিন্ডারগার্টেনে গিয়ে এ রকম কোনো শিশু শিক্ষার্থীকে পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ভর্তি ফিসহ মাসিক বেতন বেশি বলে পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা সাধারণত সেখানে তাঁদের সন্তানদের পড়াতে পারেন না।
সাভারের বাড্ডা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী পাপিয়া আক্তারের মা আনোয়ারা বেগম রানা প্লাজা ধসে নিহত হন। তার বোন ইয়ানূরও গুরুতর আহত হয়েছেন।


বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, পাপিয়ারা আট ভাইবোন। তার বাবা ইউনুস মুন্সী। পাপিয়ার বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। আরেক বোন ইয়ানূর এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পাপিয়ার ছোট ভাই সাকিব ও সজীব যথাক্রমে তৃতীয় ও প্রথম শ্রেণীতে পড়ে এই বিদ্যালয়ে।

আরেক ভাই শরীফ মিরপুরে কাজ করেন। এখন সংসারের রান্না ও অন্যান্য কাজ শিশু পাপিয়ার কাঁধে এসে পড়েছে। এ কারণে তার স্কুলে উপস্থিতি কমে গেছে। স্কুলে এলেও হঠাৎ হঠাৎ শিশুটি উচ্চ স্বরে কেঁদে ওঠে।
প্রধান শিক্ষক বলেন, শিশুটি লেখাপড়ায় খুবই আগ্রহী ছিল।

ভালো নাচে, আবৃত্তি করে। এখন স্কুলে এলেও সহপাঠীদের সঙ্গে বিশেষ কথা বলে না।
আরও কয়েকটি বিদ্যালয় ঘুরে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভবনধসে অভিভাবকহারা শিশুদের ক্লাসে উপস্থিতি কমে গেছে। আর যেসব শিশুর বাবা মারা গেছেন, তাদের বেশির ভাগই স্কুল ছেড়ে দিয়েছে, গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। আর যাদের মা মারা গেছেন, তাদের কষ্ট আরও বেশি।

এই শিশুদের অনেকেই সাভারে থাকলেও প্রচণ্ড কষ্টে কাটছে তাদের দিন।
রানা প্লাজার পেছনে ইমান্দিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হাসানাত রিদি বলেন, তাঁদের বিদ্যালয়ের ১৯ জন শিশু অভিভাবক হারিয়েছে। তাদের মধ্যে ১২ জন শিশু মা, দুজন বাবা, চারজন বোন ও এক শিশু ভাই হারিয়েছে। আরও আটজন শিশুর মা ও দুজন শিশুর বাবা গুরুতর আহত হয়েছেন।
বিদ্যালয়ের শিক্ষক রোকেয়া আক্তার ও নুরুন্নাহার বলেন, বাবা হারানো কয়েকজন শিশু ইতিমধ্যে গ্রামের বাড়ি চলে গেছে।


শিক্ষক হাসানাত রিদি বলেন, মা হারানো শিশুরা এখন আর আগের মতো প্রস্তুত হয়ে স্কুলে আসতে পারছে না। তাদের অনেকেই সকালে না খেয়েই স্কুলে আসছে। তাদের বাবা ও পরিবারের অন্যরা যখন মায়ের লাশ খোঁজা বা লাশ দাফন নিয়ে ব্যস্ত ছিল, তখন শিশুগুলো নিদারুণ অবহেলায় ছিল।
এই শিক্ষক আরও জানান, কয়েকজন শিশুর পরিবারে একজনই উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর কারণে পরিবার এখনো ক্ষতিপূরণ ও সাহায্য পাওয়ার আশায় সাভারে আছে।

কিন্তু পরে তারা আর এখানে থাকবে না বলে শিশুরা শিক্ষকদের বলেছে। গ্রামে চলে যাওয়ার পরে এই শিশুরা বিদ্যালয়ে যেতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান শিক্ষকেরা।
শিক্ষকেরা বলেন, অভিভাবক হারানো এই শিশুদের অনেকের স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে। আগের মতো হাসিখুশি নেই। মেয়েশিশুদের অনেকেই বাড়ির কাজে জড়িয়ে গেছে।

বাড়িতে থেকে তাদের ছোট ভাইবোনদের দেখাশোনা করছে।
সাভারের বাজার রোডে অবস্থিত সাভার মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১২ জন শিশু শিক্ষার্থী অভিভাবক হারিয়েছে। সাতজনের অভিভাবক গুরুতর আহত হয়েছেন। বিদ্যালয়টির চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র সাজ্জাদ হোসেন বলল, তার বাবা মো. সবুজ রানা প্লাজার তৃতীয় তলায় কাজ করতেন। ভবনধসে তাঁর বুকে ও কোমরে আঘাত লেগেছে।

এখনো তিনি ভালোভাবে হাঁটতে পারেন না। অন্যদের সাহায্য নিয়ে একটু একটু করে হাঁটেন। শিশুটি জানায়, তার মা-ও আগে ওই কারখানায় কাজ করতেন। কয়েক মাস আগে কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। তাদের পুরো পরিবারটি বাবার আয়ের ওপর নির্ভরশীল।


মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ডলি রানী ঘোষ রায় বলেন, এ ধরনের শিশুদের তাঁরা অতিরিক্ত যত্ন নিচ্ছেন। তবে তাদের অনেকেই নিয়মিত আসছে না।
সাভার উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জয়ন্তী প্রভা দেবী বলেন, এই শিশুগুলোর জন্য সরকারি বা অন্য কোনো উদ্যোগের খবর তাঁর জানা নেই। তবে তাঁরা উদ্যোগ নিয়ে চাঁদা তুলে শিশুদের আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। এ ছাড়া এই শিশুদের প্রতি শিক্ষকেরা বিশেষ যত্ন নিচ্ছেন।


জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তাজুল ইসলাম বলেন, মা-বাবার মৃত্যুর ফলে শিশুদের সঙ্গে তাঁদের আত্মিক বন্ধন ছিন্ন হয়। এটি শিশুদের মনোজগতে বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি করে। শিশুদের মনোবল ভেঙে যায়। তিনি বলেন, এসব থেকে তাদের রক্ষা করতে হলে খুব দ্রুত স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে আনতে হবে। লেখাপড়া, বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা, বিনোদন, খেলাধুলা ইত্যাদিতে ব্যস্ত রাখতে হবে।

যত বেশি তারা জীবনসম্পৃক্ত হবে, তত দ্রুত তাদের মনের ক্ষত শুকাবে। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.