আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হাঁটি হাঁটি পা পা, উ উ মাম মাম

হাঁটি হাঁটি পা পা, উ উ মাম মাম .................. খুবই অর্থহীন কয়েকটি শব্দ। শুনে বা পড়ে কিছুই বোঝা যায় না। এই গুলো আমার ছোট বেলার বুলি। যে বয়সে বাচ্চারা আধো আধো কথা বলতে শেখে, সেই বয়সেই আমি এই বুলিগুলো আউড়াতাম। তখন কিন্তু এর অনেক অর্থ ছিলো।

হাসছেন ??? !!! আমি সত্যিই বলছি। হাঁটি হাঁটি পা পা- এর মানে হচ্ছে হেঁটে হেঁটে বাইরে যাওয়া। আর উ উ মাম মাম - এর মানে ঐদিকে পানির কাছে যাওয়া। কি এবার ঠিক আছে ??? একটু অর্থবহ মনে হচ্ছে তাই না !!! কিন্তু আমার কীভাবে মনে আছে ??? না, আসলেই আমার মনে নেই। আমি যখন থেকে বুঝতে শিখি তখন থেকেই সবার মুখে মুখে আমরা এইসব কথা শোনা।

আমি জানি, সবারই এমন অনেক স্মৃতি আর আধো আধো বুলির ভান্ডার থাকে। সেই আধো আধো বুলিগুলোই পরিণত বয়েসে এসে আমরা যক্ষের ধনে মতো আকঁড়ে ধরি। আমার ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি সত্যি। কারণ সেই সময়টা তো আর ফিরে আসবে না, আসবে না সেই আদর পাবার আর আবদার করার দিনগুলো। এই বিশেষ বুলিটা নিয়ে লেখা শুরু করলাম কারণ এই বুলিটা ছিলো আমার বিকেলে ঘুরতে যাওয়ার আবদার।

ছোট বেলাতেই আব্বুর সাথে ঘোরার অভ্যাসটা তৈরি হয়েছিলো; আব্বুরই কল্যাণে। এই বুলিগুলো নাকি ছিলো আব্বুরই জন্য। তখন নানার বাড়িতে থাকতাম আর সেই বাড়ির পাশেই ছিলো একটা ঝিল। আমরা বিকেল ভ্রমণ ছিলো রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে ওই ঝিলে ধারে যাওয়া। সেইরকম করে সেইসব দিনের কথা মনে নাই আমার।

কিন্তু আব্বুর হাঁট ধরে হাঁটার কথা মনে আছে। বড় হবার পরও অনেকদিনই সকালে আব্ব্রুর হাত ধরে হাঁটতে বের হতাম। কি যে আনন্দের সময় ছিলো সেইটা। খুবই মজা লাগতো। সেই হাঁটতে গিয়ে আমরা প্রথম সূর্যদোয় দেখা, কীভাবে রাত ভোরে রূপান্তর হয় তা দেখা, ভোরে স্নিগ্ধতায় মুগ্ধ হওয়া।

সবসময় আব্বু সাথে নিতো না। যেদিন শুধু হাঁটার জন্য মানে বাজার বা কোন কাজে যেতেন না সেদিনই সাথে নিতেন। এখনও মনে আছে কত আধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম হাঁটার সুযোগ পাওয়ার জন্য। রোজার মধ্যে ভোর রাতে উঠে ভাত খেয়ে না ঘুমিয়ে বসে থাকতাম আব্বুর সাথে বাইরে যাবার জন্য। আব্বুও ভোর রাতে উঠে ঘুমাতেন না।

নামায ও কোরান শরীফ পড়ে তারপর হাঁটতে বের হতেন। না, ওনার ডায়েবেটিস ছিলো না। উনি এমনি হাঁটার জন্য বা বাজার করার জন্য বা টাটকা সবজি-মাছ কেনার জন্য বের হতেন। সেই ছোট বয়েসেই ঢুলু ঢুলু চোখে ঘুমের মায়া বাদ দিয়ে আব্বুর হাত ধরে হাঁটতে যাবার জন্য বসে থাকতাম। আবার সকালে স্কুলে যাওয়ার সময়েও আব্ব্রু হাত ধরে স্কুলে যাওয়া হতো।

আমরা তিন বোন একসাথে স্কুলে যেতাম। আব্বু চেষ্টা করতো আমাদের ছোট বোনটার হাত ধরে নিয়ে যাবার (যেহেতু সে ছোট), আর আমরা বড় দুই জন নিজেরা নিজেদের হাত ধরে থাকতাম আব্বুর সামনে। তবে মাঝে মাঝে আমি একটু চালাকি করে আব্বুর হাত ধরতাম আর আমার ছোট দুই বোন হাত ধরে থাকতো সামনে। এইভাবে অনেকদিন প্রায় ক্লাস VI পর্যন্ত স্কুলে যাওয়া হয়। তারপর বাসা স্কুলে কাছে নিয়ে আসা হয়।

সকালে আব্বুর সাথে যাওয়াও কমে যায়। তারপরও প্রায়ই আব্বু একসাথে স্কুল পর্যন্ত যেত। গেইটে ঢুকিয়ে দিয়ে তারপর যেত। জীবনে অর্ধেক সময় পার করে আজ বলতে পারি; অনেকের সাথেই পথ হাঁটা হয়েছে- বন্ধু, কাছের মানুষ, ভাই-বোন, চেনা কতজন.........তারপরও সেই অনুভূতি ফিরে পাইনি। আজকে কত দিন হয়ে গেছে আব্বুর হাত ধরে হাঁটা হয় না।

শেষ কবে হেঁটেছি বলতে পারবো না। চরম বাস্তবতার মতো সত্যিটা মেন নিতে দম বন্ধ হয়ে আসে- সেই সত্যি হলো বেঁচে থাকতে আর কোনদিন হাঁটতেও পারবো না। এই কষ্টটা আরও বড় পাহাড়ের মতো বুকের ওপর চেপে বসে যখন চিন্তা করি আমার ছোট দুই ভাই (যাদের বয়স ১০ আর ৬) তারাও কোন দিন সেই সুযোগ পাবে না। এইটা মনে হলেই ইচ্ছা করে একটা চিৎকার করে এই পৃথিবীটাকে ধ্বংস করে দেই। আর যিনি এই দূর্ভাগ্য আমাদের কপালে লিখেছেন তাঁর সামনে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করি - কেন, কেন, কেন তিঁনি এটা করলেন ????? বাবা দিবসেই চেয়েছিলাম এই লেখাটা লিখতে কিন্তু লিখতে বসেও শেষ করতে পারিনি।

খুব খারাপ লাগছিলো। আমার বাবার জন্য আমরা কিছুই করতে পারিনি। সারা জীবন তিনি নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বির্সজন দিয়ে আমাদের ভালো রাখার চেষ্টা করেছেন। জানি সব বাবাই হয়তো তাই করে। তারপর আমার বাবা, বাবা হিসেবে সবার চেয়ে ভালো।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।