বলছিলেন সাংবাদিক সুপন রায়:- ‘রুমানা আপনি একা নন’- এ শিরোনামে মানবজমিনে একটি লেখা প্রকাশিত হবার পর অবাক করার মতো কিছু প্রতিক্রিয়া পেলাম। কেউ ধন্যবাদ দিলেন। কেউ প্রকাশ করলেন বিস্ময়। অনেকে রুমানাকে দায়ী করলেন। খুলনা থেকে একজন পরিচিত সাংবাদিক টেলিফোন করে বললেন, ‘রুমানার কথাতো জানলাম, হাসান সাঈদের কথা কবে জানবো’? বলতে দ্বিধা নেই, টেলিফোনে, প্রতিবেদনের মতামত অংশে, ইন্টারনেটে, ব্লগে, পুলিশ বিভাগে, ব্যক্তিগত আলোচনায়, যারা মতামত দিয়েছেন কিংবা যাদের মতামত শোনার সুযোগ হয়েছে, তাদের বড় অংশই পুরুষ।
এবং তাদের মতামতের বড় অংশও রুমানার বিরুদ্ধে। আমি খেয়াল করে দেখেছি, তারা সকলেই যার যার অবস্থান থেকে ব্যাখ্যা কিংবা বিশ্লেষণ করেছেন। নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গির উপস্থিতি ছিল কম।
হাসান সাঈদ যেদিন ঢাকার মুগদা’র বাসা থেকে ধরা পড়লেন, সেই সন্ধ্যায় তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়। হাতে হ্যান্ডকাফ পরা।
গায়ে কালো রঙের একটি গেঞ্জি। চোখে চশমা। চেয়ারে বসে আছেন। আমাকে দেখে সরাসরি চোখের দিকে তাকালেন। পরিচয় জানতে চাইলেন।
পরিচয় দিলাম। বললাম, আপনার স্ত্রী’র কথা শুনেছি। আপনার কথা শুনতে চাই। আপনি যদি অনুমতি দেন। তিনি উত্তরে বললেন, ‘আজতো আমি সার্কাসের জোকার হয়ে গেছি।
সাংবাদিকদের অনেকে (সংবাদ সম্মেলনের সময়) আমার চোখ তুলে নেয়ার কথাও বলেছেন। আপনিই প্রথম সুন্দর করে আমার সঙ্গে কথা বলছেন’।
কোন প্রশ্ন না করে আমি তার মুখ থেকে তার মতো করে ঘটনা শুনতে চাইলাম। তিনি চশমা খুলে চোখ মুছলেন। লম্বা করে নিঃশ্বাস নিলেন।
তারপর বললেন, ‘আমি হেমাকে (রুমানার ডাক নাম) অনেক ভালোবাসি। সন্তানকে অত্যন্ত ভালোবাসি। আমি চাইনি, এ নিয়ে আমাকে কথা বলতে হোক’। তখন সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রক্টর ঢুকলেন। তার সঙ্গে আরও দু’জন।
একজন ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক। অন্য জনের পরিচয় জানা হয়নি।
হাসান সাঈদ কাঁদছেন। বারবার চোখ মুছছিলেন। বললেন, ‘হেমাকে কানাডায় পড়াশোনা করার ব্যবস্থা আমিই করে দিয়েছি।
আমার থ্রি হুইলার ছিল। ওগুলো বিক্রি করে ওকে কানাডায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি। বিশ্বাস করুন, ও এমন ছিল না। অত্যন্ত ভালো মেয়ে ছিল। আমার খেয়াল করতো।
আমার সন্তানের খেয়াল করতো। আমি ও আমার মেয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করে ছিলাম। ২৬৯ দিন আমরা অপেক্ষা করেছি। কিন্তু কানাডা থেকে ফিরে আসার পর দেখি, আমার হেমা আগের মতো নেই। আমার খেয়াল করে না।
সন্তানের খেয়াল করে না। আমি কষ্ট পেলাম’।
কথা বলছেন সাঈদ। আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছেন। চশমা খুলে হাতের তালুতে চোখ মুছছেন।
এক নিঃশ্বাসে বলে যাচ্ছেন। পাশে দাঁড়িয়ে মুগদার যে বাসায় তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন, সে বাসার অভিভাবক। হাসানের স্বজন। একটু দূরে চট্টগ্রামে যে বাসায় ছিলেন, সে বাসার আশ্রয়দাতা তরুণ। তিনি মাঝখানে ব্যাখ্যা করছিলেন, কোন পরিস্থিতিতে হাসানকে আশ্রয় দিয়েছিলেন।
হাসানের মায়ের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্কের কথা।
হাসান বললেন, ‘হেমার সঙ্গে এ নিয়ে অনেক ঝগড়া হয়। ও আমার কাছে তার সবকিছু খুলে বলে। স্বীকার করে। আমরা সিদ্ধান্ত নিই, একসঙ্গে ‘ডরমিকম’ (ঘুমের ওষুধ) খেয়ে আত্মহত্যা করবো।
পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো। আমি ১৯২টি ডরমিকম খেয়ে ফেলি। এক পর্যায়ে নিঃস্তেজ হয়ে পড়ি। ওরাই (হেমা ও তার বাবা) আমাকে ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করে। ২৫-২৭শে মে, ২০১১ আমি হাসপাতালে চিকিৎসা নিই।
তারপর ওদের বাসায় চলে যাই। ২রা জুন আমাদের মধ্যে আবার ঝগড়া হয়’।
৫ই জুন বিকালে ঘটনার শুরু কেমন করে হলো- সে ব্যাপারে জানতে চাই। হাসান বলেন, ‘কম্পিউটার খোলা রেখে হেমা ওয়াশরুমে যায়। আমি সামনে গিয়ে দেখি, ফেসবুক খোলা।
তার এক বন্ধুর সঙ্গে (নাভিদ বিন তাহের, ইরানি নাগরিক) আলাপ চলছিল। হেমা আমাকে কথা দিয়েছিল, নাভিদের কথা ভুলে যাবে। কোন ধরনের যোগাযোগ আর রাখবে না। আমি ফ্রেন্ড লিস্ট থেকে ওই ছেলেটিকে বাদ দিয়ে দিই। ওয়াশরুম থেকে ফিরে হেমা দেখে তার ফ্রেন্ডলিস্টে ওই ছেলেটি আর নেই।
এটি দেখে সে ক্ষেপে যায়। আমার ওপর হামলে পড়ে। আমাদের মধ্যে অনেকক্ষণ ধস্তাধস্তি হয়। তারই একপর্যায়ে হেমা আমার চশমা টেনে খুলে ফেলে। আমি জানি না, তারপর কিভাবে কি হয়ে গেল?’
হাসানের কথা মন দিয়ে শুনছি।
আমার পাশে বসে প্রক্টর, ইতিহাস বিভাগের সেই শিক্ষকও শুনছিলেন। জানতে চাইলাম, ‘আপনি তো চোখে ভালো দেখতে পান না বলে শুনেছি, চশমা হারিয়ে কেমন করে আপনি আপনার স্ত্রী’র মুখমণ্ডল, চোখের ওপর এমন আঘাত হানলেন? হাসান বললেন, ‘আমি জানি না। সত্যি, আমি জানি না। আমিও হয়তো হেমার মতো তখন আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছিলাম। হয়তো নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম।
তিনি তার সব কথাই বলছিলেন বাংলায়। হঠাৎ অস্ফুটস্বরে বললেন, ‘(ও পধহ্থঃ ংঃড়ঢ় ষড়ারহম যবৎ.. ংঃরষষ..ংঃরষষ..ংঃরষষ). চশমা খুলে হাতের তালুতে আবারও চোখ মুছলেন তিনি। বললেন, ‘জানেন, ওর বাবার অতো টাকা নেই। আমি আমার থ্রি হুইলার বিক্রি করে ওর পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছি। ডরমিকম খাওয়ার সময় ওর নামে সব এফডিআর (সাড়ে ১১ লাখ টাকা) লিখে দিই।
শেয়ার সার্টিফিকেটগুলো ওর নামে লিখে দিই। ’
বললাম, আপনার কষ্ট আমি বুঝি। আপনাকে কথা দিয়েও কথা রাখা হয়নি। স্বামী হিসেবে আপনি ছোটো হয়েছেন। বঞ্চিত হয়েছেন।
প্রতারণার শিকার হয়েছেন। কিন্তু আপনার সামনে তো অনেক বিকল্প ব্যবস্থা ছিল। আপনি পারিবারিক আদালতে যেতে পারতেন। আইনের আশ্রয় নিতে পারতেন। কিন্তু তা না করে আপনি নাকের মাংস কামড়ে ছিঁড়ে ফেললেন।
চোখ তুলে নেয়ার চেষ্টা করলেন। আপনার সেই চেষ্টার ফলে আপনার প্রিয়তম স্ত্রী হেমার বাম চোখ আজ নষ্ট। ডান চোখেও জখম অনেক। এ মন্তব্য ল্যাবএইডের। আমি পড়ে দেখেছি।
মন্তব্যের জায়গায় ডাক্তার লিখেছেন: (১.খবভঃ: এষড়নব ৎঁঢ়ঃঁৎব রিঃয ফরংড়ৎমধহরুব ুবং. ঞযবৎব রং হড় ঢ়বৎপবঢ়ঃরড়হ ড়ভ ষরমযঃ. ২. জরমযঃ: এষড়নব রহঃধপঃ নঁঃ ঢ়বৎ ড়ৎনরঃধষ পড়ষষবপঃরড়হ রং ঃযবৎব, যিরপয রং ঢ়ৎড়নধনষু যবসড়ৎৎযধমরপ রিঃয ংঁংঢ়বপঃ ংসধষষ মষড়নব ৎঁঢ়ঃঁৎব. ঠরংরড়হ পড়ঁষফ হড়ঃ নব পষবধৎ).
আমার মুখে এ কথা শুনে হাসান বলে ওঠেন, ‘আপনি দুই চোখ নষ্ট হবার কথা বলছেন তো। আপনি দেখবেন, ২ মাস পর হেমা কানাডায়। চোখে সব দেখতে পাচ্ছে। আপনি আমার কথা আজ শুনলেন। সময় যাক।
আপনি মিলিয়ে দেখবেন। ল্যাবএইডে হেমার এক ডাক্তার মামা আছেন। তিনি চাইলে অনেক কিছুই লিখাতে পারেন’।
বললাম, আপনার কথামতো তাহলে চোখে কিছু হয়নি। সবই বাড়িয়ে বলা।
কিন্তু আমিতো নাকের ক্ষত অংশ দেখেছি। গালে, হাতে আঘাতের চিহ্ন দেখেছি। আপনার কথামতো দুই পক্ষে ধস্তাধস্তি হলে আপনার মুখমণ্ডলে, চোখে, শরীরে রুমানার মতো আঘাতের চিহ্ন থাকতো। আমিতো তা দেখতে পাচ্ছি না। আপনি বলছেন, আপনি এখনও আপনার স্ত্রীকে ভালোবাসেন।
আপনার বক্তব্য যদি সত্যি হয়, তাহলে তার ওপর কেমন করে এ ধরনের আঘাত করতে পারলেন?
হাসান বললেন, ‘আমি জানি না, কেমন করে কী হয়ে গেল। আমি হয়তো তখন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি জানি, এর জন্য আমাকে ক্রসফায়ারে দেয়া হবে। ভাই, আমিতো এমনিতেই মৃত। চোখে দেখতে পাই না।
ডরমিকম খাওয়াতে দৃষ্টিশক্তি আরও কমে গেছে। হেমা আসলে আমাকে ওই দিন ওষুধ খাইয়ে মুক্তি দিতে চেয়েছিল। আমি বুঝতে পারিনি। আপনি দেখবেন, বেশিদিন লাগবে না। দুই মাসের মধ্যেই আমার মৃত্যু হবে।
আমার আসলে কেউ নেই। মা-বাবা, ভাই কেউ নেই’। বললাম, আপনার সবাই আছেন। কেন থাকবে না? হাসান বলেন, ‘আমার কেউ নেই। থাকলে ওরা আমার পাশেই থাকতো।
আপনি দেখতে পেতেন। আমার এ অবস্থা দেখে সবাই পালিয়েছে। ভাবছে, ওতো এমনিতেই মৃত। থাক, ওর মতো। কপাল আমার’।
হাসানের কথা শুনে রাত ৯টার দিকে বেরিয়ে এলাম। পরদিন তাকে আদালতে পাঠানো হলো। গোয়েন্দা পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই দিনের রিমান্ডে আনলো। ওদিকে, ভারতের চেন্নাইয়ের শঙ্কর নেত্রালয় থেকে জানানো হলো, রুমানাকে আরও একমাস পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। তারপর বোঝা যাবে, অপারেশনের প্রয়োজন হবে কিনা?
রুমানার ঘটনা অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে নিয়ে এলো।
সমাজ, সমাজের মানুষ, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, দৃষ্টিভঙ্গির অবস্থান, অবস্থানের তারতম্য-সবকিছুই যেন দাঁড়িয়ে আছে, ধারণার ওপর। আর এ দেশে এখন সবকিছুই যেন ধারণার ওপরই প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। অনেকেই ঘটনার গভীরে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করার প্রয়োজন বোধ করছেন না। সময়ের অপেক্ষা না করে, যে যার অবস্থান থেকে পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে ফেলছেন। এবং তারপর সত্য হোক আর মিথ্যে হোক, সেই মূল্যায়নের ওপরই স্থির হয়ে থাকছেন।
রাষ্ট্রের আইন, যথাযথ তদন্ত, বিচার ব্যবস্থা যেন তার কাছে গৌন হয়ে পড়ছে। মানবজমিন ডেস্ক ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।